জাহানারা বললেন, থাক এইসব।
আহ্ শোন না মা। ভেরি ইন্টারেস্টিং। এত দিন আমরা জানতাম বড় চাচা তাঁর দোতলাটা বিক্রি করে দিয়েছেন। ব্যাপারটা সত্যি না। বিক্রির কথা বলে টাকা নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু কাগজপত্রে সই করেন নি, সবই মুখে মুখে।
সাইফুদ্দিন বললেন, বলিস কি তুই?
বিজু বলল, পাকা খবর বাবা। কোনো ভুলে নাই। এখন বড় চাচি বলছেনবাড়ি তো বিক্রি হয় নাই। বাড়ি ভাড়া অ্যাডভান্স নিয়েছি।
সাইফুদ্দিন খাওয়া বন্ধ করে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বিজু বলল, এখন বাবা অবস্থাটা দেখ, নিজের অংশ তাঁর নিজেরই আছে, প্লাস আমাদের অর্ধেকটা তাঁর দখলে।
জাহানারা বললেন, এই খবর পেলি কবে?
অনেক আগেই পেয়েছি। তোমাদের কিছু বলি নি কারণ সিওর ছিলাম না। এখন সিওর হয়েছি।
আজ রাতটা এমনিতে ঠাণ্ডা। তার ওপর মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। অসহ্য গরমে জেগে থাকার কথা নয়, কিন্তু সোমা জেগে আছে। তার অনিদ্রা রোগ আজকের নয়, অনেক দিনের। বিয়ের পরপরই অসুখটা হল—সে জেগে আছে, পাশেই কামাল মরার মতো ঘুমুচ্ছে। মাঝে-মাঝে ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় করছে এবং কথা বলছে। খুব উত্তেজিত ভঙ্গির কথা। যেন ভয়াবহ কোনো স্বপ্ন দেখছে। প্রথম দিকে ভয় পেয়ে সোমা কামালের গায়ে ধাক্কা দিত।
এই, এরকম করছ কেন? কী হয়েছে—এই।
কামাল সঙ্গে-সঙ্গে জেগে যেত তবে কিছুই বলত না, চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকত। সোমা বলত, এরকম করছিলে কেন? কি স্বপ্ন দেখছিলে?
মনে নাই।
পানি খাবে? পানি এনে দেব?
দাও।
সোমা পানি এনে দেখত কামাল আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ঘুমের মধ্যে বিড় বিড় কথা। উত্তেজিত ভঙ্গি। হো হো শব্দ। ভয়ে সোমা কাঠ। লোকটা এরকম করে কেন? আবার ডেকে তুলবে? পানি খেতে বলবে? এই মানুষটাকে তার গোড়া থেকেই পছন্দ হয় নি। বিয়ের রাতেই তার মনে হয়েছে এই মানুষটা অন্যরকম। আশেপাশে সে যাদের দেখে এ তাদের মতো নয়। আলাদা। কি রকম আলাদা? সোমা ঠিক বুঝতে পারে নি। গোড়াতে অবশ্যি বোঝার চেষ্টাও করে নি। এই মানুষটাকে বোঝর জন্যে সারা জীবনই তো সামনে পড়ে আছে। এত তাড়া কীসের?
অবশ্যি বাসর রাতে লোকটির প্রতি সে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা বোধ করছিল। তাকে বিয়ে করবার জন্যে কৃতজ্ঞ। এই বাড়ি থেকে সরিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে কৃতজ্ঞ। সোমার কৃতজ্ঞ হবার কারণ ছিল। এই বাড়িতে কিংবা এই পাড়ায় সে আর থাকতে পারছিল না। তার সারাক্ষণ ইচ্ছা করত ছুটে পালিয়ে যেতে। এমন কোথাও যেতে, যেখানে একটি মানুষও তাকে খুঁজে পাবে না। কেউ আঙুল দিয়ে তাকে দেখিয়ে বলবে না—ঐ দেখ সোমা যাচ্ছে। কোন সোমা বুঝতে পারছে তো?
হুঁ হুঁ—ঐ সোমা।
দেখতে তো বেশ শান্তশিষ্ট বলে মনে হচ্ছে।
শান্ত? তা শান্ত তো বটেই। হা-হা-হা। নিজে শান্ত চারদিকে অশান্ত।
আঠার বছর বয়স পর্যন্ত সোমাকে সবাই শান্ত মেয়ে, ভদ্র মেয়ে এবং খুবই লাজুক ধরনের মেয়ে বলেই জানত। পাড়ার অতি বখা ছেলেও তাকে দেখে কোনোদিন শিস দেয় নি, বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে নি। কিংবা করলেও সোমা শোনে নি। সোমা রাস্তায় বেরুত মাথা নিচু করে। এমনভাবে হাঁটত মনে হত আশেপাশে কেউ নেই, সে যেন একা জনশূন্য পথে হেঁটে চলে যাচ্ছে।
একটা ক্ষুদ্র এবং প্রায় তুচ্ছ ঘটনায় সব বদলে গেল। সোমাদের বাড়ির তিনটা বাড়ির পর নারকেল গাছওয়ালা বাড়ির দোতলায় নতুন ভাড়াটে এল। এক প্রফেসর তাঁর সাত বছরের ফুটফুটে মেয়ে এবং অসুস্থ স্ত্রী। ভদ্রলোক প্রথম দিনেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন, কারণ ভদ্রলোকের সঙ্গে এল ট্রাক ভরতি বই। এত বই কারোর থাকে? বাড়িটাকে কি সে লাইব্রেরি বানাবে? মানুষগুলো থাকবে কোথায়? ভদ্রলোকের স্ত্রী এলেন এম্বুলেন্সে করে। এ-ও এক রহস্য। এম্বুলেন্স করে রুগীরা হাসপাতালে যায় এটাই জানা। এম্বুলেন্সে করে ভাড়া বাড়িতে থাকতে আসে এটা কারোর জানা ছিল না।
এক দুপুরে সোমা ভদ্রমহিলাকে দেখতে গেল।
মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে। প্যারালাইসিস হয়ে পড়ে আছে। সমস্ত শরীর শুকিয়ে। কাঠি অথচ মুখটা ভরাট। চোখ জ্বল-জ্বল করছে। তার নাম অরুণা। তার স্বামী তাকে ডাকে অরু নামে এবং ডাকে খুব মিষ্টি করে।
ভদ্রমহিলা সোমার সঙ্গে তেমন কোন কথা বললেন না। কি নাম? কি পড়? বাসা কোথায়? এইটুকু জিজ্ঞেস করেই খুব সম্ভব ক্লান্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ভদ্রমহিলার স্বামী অনেক কথা বললেন। তাঁর নাম আশরাফ হোসেন। ফিলসফির অধ্যাপক। ভদ্রলোকের গলার স্বর মোটা। কথা বলার সময় চারদিক গম-গম করে, তবে কথা বলার মাঝখানে মাঝখানে হঠাৎ করে তিনি থেমে যান এবং কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে পড়েন।
আশরাফ সাহেব বললেন, তোমার কি নাম খুকি?
সোমা লজ্জিত গলায় বলল, সোমা।
সুন্দর নাম তো। বলতে লজ্জা পাচ্ছ কেন? সোমবারে জন্ম নিশ্চয়ই? সোমবারে জন্ম হলে বাবা-মারা নাম রাখে সোমা। তোমার কি সোমবারে জন্ম?
জি।
কী পড়?
আই এস সি।
বাহ্, আমি আরো কম ভেবেছিলাম। বাচ্চা মেয়েরা আজকাল উঁচু-উঁচু ক্লাসে পড়ে।
সোমা কিছু বলল না। কেন জানি তার লজ্জা কিছুতেই কাটছে না।
তুমি কি গল্পের বই পড় সোমা?
অল্প-অল্প পড়ি।
অল্প অল্প পড়বে কেন? অনেক বেশি-বেশি পড়বে। বই যে মানুষের কত ভালো বন্ধু এটা বই পড়ার অভ্যাস না হলে বুঝতে পারবে না। আমার কাছে অসংখ্য বই আছে। গল্প-উপন্যাসই বেশি। এস তোমাকে দেখাই।