কামাল মিনু-সমস্যার কয়েকটা সমাধান বের করল—ঘরে তালা দিয়ে মিনুকে ঘরের বাইরে বসিয়ে রেখে চলে যাওয়া। দুই, মিনুকে চায়ের দোকানে রেখে যাওয়া। ফেরার পথে উঠিয়ে নেওয়া। মিনুর হাতে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে তাকে তার কলতাবাজারে খালার কাছে পাঠিয়ে দেওয়া। কোনো সমাধানই তার মনে ধরল না। মুখ অন্ধকার করে একের পর এক সিগারেট টেনে যেতে লাগল।
ঊর্মির ঘরে নতুন ফ্যান
ঊর্মির ঘরে নতুন ফ্যান লাগানো হচ্ছে। কড়ই গাছ বিক্রির টাকায় কেনা ফ্যান। বিজুর উৎসাহের সীমা নেই। যদিও নীল গেঞ্জি গায়ে এক জন ইলেকট্রিশিয়ান আনা হয়েছে তবু পুরো কাজটা করল বিজু। কানেকশন দিয়ে সুইচ টিপল। ফ্যান ঘুরল না। ইলেকট্রিশিয়ান টেস্টার দিয়ে দেখে বলল, লাইন তো ভাইজান ঠিক আছে।
ঊর্মি বলল, ফ্যান ঠিক আছে তো? দোকানে চালিয়ে দেখেছ?
বিজু বিরক্ত গলায় বলল, না চালিয়ে ফ্যান কিনব না-কি?
ঊর্মি বলল, লোক-ঠকানো টাকায় কেনা তো, তাই ঘুরছে না।
বিজু চোখ লাল করে বলল, লোক-ঠকানো টাকা মানে? কি বলছিস তুই? গাছটা কার, আমাদের না অন্যদের?
আচ্ছা বাবা যাও—আমাদের। চিৎকার করছ কেন?
এমন চড় দেব না—জন্মের শিক্ষা হয়ে যাবে।
ঊর্মি বলল, চেঁচামেচি না করে চড় দিয়ে ফেল। তাও ভালো।
বিজু সত্যি-সত্যি চড় বসিয়ে দিল। ঊর্মি হতভম্ব হয়ে গেল। বিজ যে বাইরের একটা মানুষের সামনে চড় মারতে পারে তা তার কল্পনাতেও আসে নি। কেমন করে এটা সম্ভব হল? হচ্ছে কি এসব? নীল গেঞ্জি পরা ইলেকট্রিশিয়ান ব্যাপারটায় খুব মজা পাচ্ছে। দাঁত বের করে আসছে। ঊর্মির ইচ্ছা করছে বিজুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে। ছোটবেলায় এই জিনিসই করত। ছোটবেলায় যা করা যায় এখন তা করা সম্ভব না। সে নিঃশব্দে ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
বারান্দায় জাহানারা কেলি থেকে কাপে চা ঢালছেন। তাঁর মুখ গম্ভীর। কাজের ছেলেটা সকালে বাজারের টাকা নিয়ে পালিয়েছে, আর ফেরে নি। সত্তর টাকা নিয়ে ভেঙ্গে গেছে। অথচ তার বেতন পাওনা ছিল দেড় শ টাকার ওপরে।
জাহানারা বললেন, সোমা কোথায় গেছে তুই জানিস?
ঊর্মি জবাব দিল না। সে কান্না থামাবার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। জাহানারা বললেন, কথা বলছি না কেন? সোমা কোথায় গেছে জানিস?
না।
চাটা বিজুকে দিয়ে আয়।
আমি পারব না মা।
জাহানারা কঠিন চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর ফর্সা গাল রাগে লাল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তিনি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, কি বললি?
কিছু বলি নি, দাওচা দাও দিয়ে আসছি।
ঊর্মি চায়ের কাপ বিজুর সামনে রেখে সহজ গলায় বলল, বিজু ভাইয়া চায়ে চিনি হয়েছে কি-না দেখ।
বিজু বলল, যা রহমানের জন্যে চা নিয়ে আয়—দেখ তাকিয়ে, প্রবলেম সলন্ড। ফ্যান বন-বন করছে। হা-হা।
ঊর্মি তাকাল। নীল-রঙা ফ্যান ঘুরছে। ঘরে প্রচুর বাতাস। অথচ তার নিজের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। সে বারান্দার দিকে রওনা হল রহমানের জন্যে চা আনতে হবে। যে একটু আগে তাকে চড় খেতে দেখেছে। দেখে দাঁত বের করে হেসেছে।
ঊর্মি চা ঢালছে।
জাহানারা পাশের চেয়ারে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন। তিনি বিরস মুখে বললেন, কার চা?
রহমানের।
রহমানটা কে?
ইলেকট্রিশিয়ান।
ইলেকট্রিশিয়ানকে আবার চা-বিসকিট খাওয়াতে হচ্ছে? সোমা কোথায় গেছে। তুই জানিস না?
না, জানি না।
কাউকে কিছু না বলে গেল কোথায়?
ঊর্মি চা নিয়ে চলে গেল। বিজু এসে বলল, ফ্যান কেমন ঘুরছে দেখে যাও মা। বন- বন-ফন-ফন। ঘরে বাতাসের ফ্লাড হয়ে যাচ্ছে।
জাহানারা বললেন, সোমা কোথায় গেছে জানিস?
না।
কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেল?
বিজু চিন্তিত গলায় বলল, কখন গেছে?
দুপুর থেকে তো দেখছি না।
মাই গড।
দুজনের মনেই যে চিন্তা একসঙ্গে কাজ করল তা হচ্ছে—আগের জায়গায় ফিরে যায় নি তো? কাউকে কিছু না বলে যাওয়ার অর্থ তো একটাই। বিজু বলল, এক বার চট করে দেখে আসব প্রফেসরের বাসাটায় আছে কি না?
সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। সন্ধ্যার মধ্যে যদি না ফেরে তখন না হয়…….
যদি দেখি ঐখানে আছে তখন কি করব?
জাহানারা কোনো জবাব দিলেন না।
সোমা দূরে কোথাও যায় নি। গিয়েছে তার চাচার বাসায়। একসময় বড় চাচা ছদরুদ্দিন তাকে খুব স্নেহ করতেন। ঈদে নিজের মেয়েদের জামার সঙ্গে বাড়তি একটি জামা কেনা হত সোমার জন্যে। এক রাতের কথা সোমার পরিষ্কার মনে আছে, সে তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বড় চাচা থাকেন সোবহানবাগে। রাত তিনটার দিকে হেঁটে হেঁটে সোবহানবাগ থেকে এখানে এসে উপস্থিত। তিনি সোমাকে নিয়ে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছেন। দুঃস্বপ্ন দেখে মনটা অস্থির হয়েছে কাজেই খোঁজ নিতে এসেছেন।
সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে মানুষ বদলায়, সোমার ধারণা, বড় চাচা অনেকখানি। বদলেছেন, তবু কিছুটা টান এখনো নিশ্চয়ই অবশিষ্ট আছে। তা বোঝা যায়। কড়ই গাছ। নিয়ে বিরাট একটা হৈ চৈ হত। সোমা এ-বাড়িতে উপস্থিত বলেই হয় নি। বড় চাচা চুপ করে গেছেন।
ছদরুদ্দিন সাহেব দুপুরে ঘুমের আয়োজন করছিলেন। সোমাকে ঢুকতে দেখে উঠে বসলেন। কোমল গলায় বললেন, আয় মা, আয়।
সোমা বলল, বাসা খালি কেন বড় চাচা চাচি কোথায়?
ও তার ভাইয়ের বাড়িতে গেছে। ঘোট মেয়েটাও গেছে। বাকি সব আছে ঐ ঘরে, কি যেন করছে। আসবে। তুই এখানে বোস খানিকক্ষণ।
আপনি ঘুমুচ্ছেন ঘুমুন। আমি ওদের সঙ্গে গল্প করি। ঘুমটুম কিছু না, শুয়ে থাকি। বিরাট যন্ত্রণার মধ্যে আছি। এর মধ্যে ঘুম হয় না। কীসের যন্ত্রণা?