এক বিষুদবার রাতে হাফেজ জাহাঙ্গীর কার্তিককে ডেকে পাঠালেন।
কার্তিক এসে ষষ্ঠাঙ্গে প্রণাম করল। হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, আপনি যে গল্পটা জনে জনে বলে বেড়াচ্ছেন, গল্পটা কি সত্যি?
কার্তিক বলল, যদি সত্যি না হয় তাহলে যেন আমার মাথায় বজ্রাঘাত হয়। আমি যেন নির্বংশ হই।
হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, এমন কঠিন শপথে যাবেন না। আপনার গল্প সত্যি না। সত্যি হলে আমি জানতাম। আপনি প্রবল ঘোরের মধ্যে আমাকে দেখেছেন। অন্য কেউ আপনাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছে। আমি না।
কার্তিক বলল, আপনি আমাকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। আমার যে হাত আপনি ধরেছিলেন সেই হাতে এখনো আতরের গন্ধ। বাবা! আপনি আমার হাত তাঁকে দেখেন।
হাফেজ জাহাঙ্গীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মানবজাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয়ে নিজেকে নিরাপদ মনে করে।
শফিক এবং সিআইডি ইন্সপেক্টর শেখ হাসানুজ্জামান খান
শফিক এবং সিআইডি ইন্সপেক্টর শেখ হাসানুজ্জামান খান।
স্থান : পুলিশ হেডকোয়ার্টার, রাজারবাগ। তারিখ ২৭ নভেম্বর। সময় সন্ধ্যা সাতটা।
শফিকের চোখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে। ফাঁসির সময় যে ধরনের কালো টুপি আসামিকে পরানো হয়, সেরকম একটা টুপি শফিককে পরানো। শফিকের কেমন অদ্ভুত লাগছে। সে নানান ধরনের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না বলেই কি এত শব্দ? ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। পুলিশ হেডকোয়ার্টারে নিশ্চয়ই ঘুঘু বাসা বাঁধবে না।
আপনার নাম?
শফিক।
শুধু শফিক? আগে পেছনে কিছু নেই। মোহাম্মদ কিংবা আহমেদ।
পেছনে আহমেদ আছে স্যার, শফিক আহমেদ।
প্রশ্ন করলে এমনভাবে জবাব দেবেন যেন দ্বিতীয়বার একই প্রশ্ন করতে না হয়। আমার সময় তেমন মূল্যবান না, তারপরেও সময় নষ্ট করবেন না।
জি আচ্ছা।
টেবিলে আলপিন দেখতে পাচ্ছেন?
জি-না, পাচ্ছি না। আমার চোখ বন্ধ।
চোখের কাপড় সরিয়ে দিচ্ছি। এখন বলুন, কয়টা আলপিন?
একজন পেছন থেকে শফিকের মাথার টুপি সরিয়ে দিল। শফিকের চোখে ধাঁধা লেগেছে। মনে হচ্ছে ঘরে সার্চলাইট জ্বলছে। সে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, স্যার, নয়টা আলপিন।
ভালোমতো শুনে বলুন। স্যার দশটা।
কোনো প্রশ্নের মিথ্যা উত্তর দিলে একটা আলপিন নখের নিচে এক ইঞ্চির মতো ঢুকিয়ে দেব। দশটা ভুল উত্তর দেবেন, দশ আঙুলে দশটা আলপিন নিয়ে হাজতে ফিরে যাবেন। বুঝতে পারছেন?
জি স্যার।
কর্নেল তাহেরকে চেনেন?
জি-না।
নাম শুনেছেন।
জি-না।
কর্নেল তাহেরের কোনো আত্মীয়স্বজনকে চেনেন?
জি-না।
আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
নেত্রকোনা। কেন্দুয়া থানা।
পূর্বধলার নাম শুনেছেন?
জি।
পূর্বধলার কাজলা গ্রামে কখনো গিয়েছেন?
জি-না।
আপনি পাঁচটা প্রশ্নের ভুল উত্তর দিয়েছেন। প্রথম ভুল উত্তর হলো—আপনি কর্নেল তাহেরকে চেনেন না বলেছেন।
স্যার চিনি, তবে পরিচয় নাই।
মুক্তিযুদ্ধে তিনি কোন পা হারিয়েছেন?
বাম পা।
আপনি তো তাকে ভালোমতোই চেনেন। ভালোমতো না চিনলে বলতে পারতেন না কোন পা। কর্নেল তাহেরের এক ভাই আনোয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁকে চেনেন?
জি-না। আনোয়ারের নাম এই প্রথম শুনলাম।
উনি দু’বার আপনার প্রেসে এসেছিলেন। একবার রাতে আপনার সঙ্গে থেকেও গিয়েছিলেন। আপনি বললেন, আনোয়ার নাম এই প্রথম শুনলাম।
এখন থেকে আর মিথ্যা বলব না স্যার। সত্য বলব। আনোয়ার আমার বন্ধু মানুষ। আমি ইউনিভার্সিটিতে ম্যাথমেটিকসে আবার ভর্তি হতে চাই। আনোয়ার
এই ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করছে।
আমি এখন আপনার ডান হাতের তর্জনীতে একটা আলপিন ঢুকাব। আবার কিছু প্রশ্ন করব। আমার ধারণা তখন সত্য উত্তর পাব।
স্যার, আলপিন ঢুকাতে হবে না। এখন থেকে আমি সত্য কথা বলব। একটাও মিথ্যা বলব না। কর্নেল তাহেরের পরিবারের সঙ্গে আমি ভালোমতো পরিচিত। পূর্বধলার কাজলা গ্রামে আমার নানার বাড়ি। কর্নেল তাহেরের পরিবারের কাছে আমার নানাজানের পরিবার নানানভাবে ঋণী। কর্নেল তাহেরের মায়ের নাম বেগম আশরাফুন্নিসা। তার এক বোনের নাম…।
স্টপ।
স্যার আমি স্টপ করব না। কর্নেল তাহেরের মা’কে আমিও মা ডাকি। কর্নেল তাহেরের এক বোনের নাম শেলী…।
[প্রশ্নোত্তর বন্ধ। আচমকা শফিকের তর্জনীতে আলপিন ফুটানো হয়েছে। শফিক শুরুতে একটা বিকট চিৎকার দিল। তারপর পশুর মতো গোঙাতে লাগল।]
ব্যথা পেয়েছেন? [উত্তর নেই। চাপা গোঙানি।]
রাজসাক্ষী হবেন? কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা হচ্ছে সেখানে সাক্ষ্য দেবেন। আপনাকে কী বলতে হবে তা শিখিয়ে দেব।
এই কাজ আমি কখনোই করব না।
বুড়ো আঙুলে আরেকটা আলপিন ঢুকানো হলে আনন্দের সঙ্গে রাজসাক্ষী হবেন।
আমি রাজি হব না। আঙুলে ঢোকান।
[আবারও আর্তচিৎকার। আবারও গোঙানি।]
রাজসাক্ষী হবেন?
না। আরও আলপিন ঢোকাতে চাইলে ঢোকাতে পারেন। আমি আর যা-ই হই, মীরজাফর হব না।
আপনার সাহস দেখে ভালো লাগল।
আমি মোটেই সাহসী মানুষ না। আমি ভীতু। তবে মাঝে মাঝে সময় ভীতুদের সাহসী করে তোলে।
সুন্দর কথা বলেছেন।
কথাটা আমার না স্যার। পুশকিনের। আলেকজান্ডার পুশকিন। স্যার, আপনি কি পুশকিনের নাম শুনেছেন?
পুলিশে চাকরি করলেই মানুষ মূখ হয় না। আমি পুশকিনের লেখা ক্যাপ্টেনের মেয়ে’ বইটা পড়েছি।
স্যার, আপনি কি তুর্গেনিভ পড়েছেন।
আমরা এখানে সাহিত্য আলোচনায় বসি নি।