তোমাকে অতি দীর্ঘ পত্র লিখলাম, কারণ আমার মন দুর্বল। মন দুর্বল অবস্থায় মানুষ বাচাল হয়। চিঠিপত্রেও বাচালতা প্রকাশ পায়। আমার দুর্বল মনের কারণ হলো—আমি অসুস্থ। প্রচণ্ড কাশি হয়। কাশির সঙ্গে মাঝে মাঝে রক্ত যায়। আমার ধারণা যক্ষা। আমি কোনো চিকিৎসা নিচ্ছি না। আল্লাহপাকের কাছে নিজেকে সোপর্দ করেছি। আল্লাহ শাফি। আল্লাহ কাফি।
ইতি
হাফেজ জাহাঙ্গীর।
দীর্ঘ চিঠির অতি সংক্ষিপ্ত জবাব অবন্তি পাঠাল। তার চিঠি–
হাফেজ সাহেব,
আমার বাবা ঘোর নাস্তিক। তিনি কোনোকিছুই বিশ্বাস করেন না। তবে মানুষের ক্ষমতায় বিশ্বাস করেন। চিকিৎসাবিজ্ঞান মানুষের বিশাল অর্জন। আপনি চিকিৎসা নেবেন, আপনার প্রতি এই আমার অনুরোধ। আরেকটা কথা, মায়মুনা সম্বােধনে কখনোই আমাকে চিঠি লিখবেন না। আমি মায়মুনা না, আমি অবন্তি।
ইতি
অবন্তি।
হাফেজ জাহাঙ্গীরের চিঠি পোস্ট করার এক ঘন্টার মধ্যে অবন্তি তার ঘোর নাস্তিক বাবার এক আস্তিক পত্র পেল। তার চিঠিটি এই–
মা অবন্তি
কুটকুট, ভুটভুট, মুটমুট।
তোমার মায়ের সেবাযত্ন এবং মুখের কঠিন বাক্যবাণে আমার শরীর অনেকখানি সেরেছে। ডাক্তার বলেছে, লিভার ফাংশন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। ডাক্তার অবাক, আমিও অবাক। আমি ভেবেছিলাম শেষটায় লিভার সিরোসিস হবে। তারপর মহান মৃত্যু। বন্ধু খালেদ মোশাররফ গিয়েছে যেই পথে, আমিও যাব সেই পথে। তার মৃত্যু হয়েছে গুলি খেয়ে। আমার মৃত্যু হবে সিরোসিস খেয়ে।
কয়েকদিন আগে শুনলাম কর্নেল তাহেরও বন্দি। ব্যাপারটা কী? কর্নেল তাহেরের পরিবারের কাছে বাংলাদেশ ঋণী। এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। তবে আমার মনে করায় কিছু আসে যায় না। দেশের আমজনতা কী ভাবছে তাতেও কিছু যায় আসে না। শুধু যায় আসে রাষ্ট্রচালকেরা কী ভাবছেন। তবে তাদের ভাবনা রাজনৈতিক ভাবনা। এই ভাবনার সঙ্গে আমরা কেউ যুক্ত না। যাক রাজনীতি, অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলি।
গত বুধবার সকালে তোমার মা প্লেটে করে আমাকে সাত রকমের ফল কেটে দিল। সে নিউট্রিশনের কোনো-এক ম্যাগাজিনে পড়েছে যে প্রতিদিন সাত রকমের ফল খায় তাকে কোনো রোগব্যাধি স্পর্শ করে না। যে সাত রকমের ফল আমাকে দেওয়া হলো তার তালিকা
একটি আপেল।
পাঁচটা লাল আঙুর।
একটি কমলা।
একটি কিউই।
একটি পীচ।
এক ফালি আনারস।
এক ফালি গুয়ানা বানা (গুয়েতেমালার ফল)।
ফলগুলির দিকে তাকিয়ে তোমার নাস্তিক বাবার মাথায় আস্তিক এক চিন্তা এসেছে। সেই চিন্তাটা তোমার সঙ্গে শেয়ার করি।
এই সুমিষ্ট ফলগুলি ফলদায়িনী গাছের বংশবিস্তার ছাড়া কোনো কাজে আসছে না। ফলগুলির লক্ষ্য মানুষ এবং পাখি। পশুরা ফল পছন্দ করে না। গাছেরা কি জানে এই ফল সে কেন দিচ্ছে? অবশ্যই জানে না। তাহলে অন্য কেউ জানে। যার ইশারায় ঘটনা ঘটছে। পৃথিবীতে পাখি ও মানুষের আসার আগেই ফলদায়িনী বৃক্ষরাজি এসেছে। অর্থাৎ কেউ একজন পাখি ও মানুষের আহারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।
মা শোনো, এখন আমার মাথায় বই লেখার এক চিন্তা এসেছে। বইয়ের নাম An Atheist’s God। বইয়ের প্রথম লাইন লিখে ফেলেছি। যে-কোনো গ্রন্থের প্রথম লাইন লেখাটাই সবচেয়ে দুরূহ কর্ম। প্রথম লাইনটি হলো—Every creation started from zero, is it so?
ইতি তোমার বাবা
নাস্তিক নাম্বার ওয়ান
আস্তিক নাম্বার ওয়ান।
হাফেজ জাহাঙ্গীর অবন্তির চিঠির নির্দেশের কারণেই ময়মনসিংহে ডাক্তার দেখাতে গেলেন। অল্পবয়সী ডাক্তার নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, মওলানা সাহেব, আপনার জন্যে একটি দুঃসংবাদ আছে।
হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, আমার কি টিবি হয়েছে?
ডাক্তার বললেন, টিবি হওয়া কোনো দুঃসংবাদ না। টিবির চিকিৎসা আছে। আমার ধারণা আপনার ফুসফুসে ক্যানসার হয়েছে।
হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, ক্যানসারের কি চিকিৎসা নাই?
ডাক্তার বললেন, আছে। সেই চিকিৎসা ফুসফুস ক্যানসারে প্রায়শই কাজ করে না। আপনি ঢাকায় যান, ক্যানসার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যান।
হাফেজ জাহাঙ্গীর ঢাকায় গেলেন না। হুজরাখানায় ফিরে এলেন। তাকে খুব বিচলিত মনে হলো না। হুজরাখানার কাজকর্ম আগের মতোই চলতে লাগল। প্রতি ওয়াক্ত নামাজের শেষে বিশেষ এক দোয়ায় তিনি বলতে লাগলেন, হে আল্লাহপাক, তুমি আমার জন্যে যা নির্ধারণ করে রেখেছ তা-ই আমার জন্যে যথেষ্ট।
এই সময়ে হাফেজ জাহাঙ্গীরকে নিয়ে কিছু গল্প গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। একটি গল্প উল্লেখ করা যেতে পারে।
কার্তিক নামের মধ্যবয়স্ক মানুষ। পেশায় স্বর্ণকার। সে ঢাকায় যায় স্বর্ণ কিনতে। তার সঙ্গে আঠার হাজার টাকা। সে পড়ে ছিনতাইকারীদের হাতে। তার সর্বস্ব খোয়া যায়। ছিনতাইকারীরা তার তলপেটে ছোরা মেরে তাকে রাস্তার পাশে নর্দমায় ফেলে যায়।
কার্তিক তলপেটে হাত রেখে বলতে থাকে, বাবা হাফেজ জাহাঙ্গীর, আমাকে বাঁচান। এই সময় সে দেখে হাফেজ জাহাঙ্গীর তার পাশে দাঁড়ানো। হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, চোখ বন্ধ করে আমার হাত ধরেন। কার্তিক তা-ই করল। একসময় হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, চোখ মেলুন।
কার্তিক চোখ মেলে দেখে সে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সির বারান্দায় শোয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার চিকিৎসা শুরু হয়। এগার দিনের মাথায় সে সুস্থ হয়ে গ্রামে ফিরে এই গল্প জনে জনে বলতে শুরু করে।