ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে এম. এ. প্রথম পর্ব সমাপ্ত। সেনাবাহিনীতে যোগদান। পাকিস্তানের বেলুচ রেজিমেন্টে কমিশন লাভ।
১৯৬৫ সনে কাশ্মীর রণাঙ্গণে যুদ্ধে কৃতিত্বের পুরস্কার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনার ফোর্ট ব্রানে পড়ার সুযোগ পান। সেখানকার স্পেশাল অফিসার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট থেকে সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর সনদে লেখা ছিল—এই যোদ্ধা পৃথিবীর যে-কোনো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যেকোনো অবস্থায় কাজ করতে সক্ষম।
তিনি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মান ‘বীর উত্তম’ পান।
১৪ নভেম্বর ঠিক তার জন্মদিনেই কামালপুর অভিযানে গোলার আঘাতে বাম পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সবাই ধরে নেয় তিনি মারা যাচ্ছেন।
অবন্তিকে লেখা হাফেজ জাহাঙ্গীরের চিঠি
অবন্তিকে লেখা হাফেজ জাহাঙ্গীরের চিঠি–
পত্নী মায়মুনা,
আসসালামু আলায়কুম।
পর সমাচার এই যে, আমি বাতেনি পদ্ধতিতে সংবাদ পেয়েছি যে, তোমার দাদাজান ইন্তেকাল করেছেন। আল্লাহপাক তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন বিধায় উনি সম্মানিত স্থানে অবস্থান করছেন।
আমার এই জাতীয় কথাবার্তায় তোমার বিশ্বাস নাই, তা আমি জানি। তোমার বিশ্বাস আনার চেষ্টাও আমি করব না। তবে একটি বিষয় তোমাকে জানাতে চাই—আমি নবি-একরিমের (দঃ) একটি সুন্নত সারা জীবন পালন করেছি। তা হলো মিথ্যা না বলা। আমার একার চেষ্টায় তা সম্ভব হয় নাই। আল্লাহপাকের অসীম করুণায় সম্ভব হয়েছে।
কাতল মাছে বিষ মিশানোর বিষয়ে তুমি আমাকে কঠিন অভিযোগে অভিযুক্ত করেছিলে। তোমার অভিযোগ ছিল বিষ মিশানোর বিষয়টি মিথ্যা। আমি দরবারশরিফের ভাব উজ্জ্বল করার জন্যে মিথ্যাচার করেছি। মায়মুনা! তোমার অভিযোগ শুনে আমি মনে কষ্ট পেয়েছিলাম, কিন্তু তর্কে যাই নাই। আমি তর্ক-বিতর্ক পছন্দ করি না।
আল্লাহপাক আমাকে অভিযোগ থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। ভৈরবের যে বাবুর্চি এই কাজ করেছিল সে অপরাধ স্বীকার করে তওবা করার জন্যে আমার কাছে এসেছিল। আমি দরবারশরিফের বাবুর্চি হিসাবে তাকে নিয়োগ দিয়েছি। কোনো-একদিন তার সঙ্গে তোমার নিশ্চয়ই দেখা হবে। তুমি ঘটনা বিস্তারিত জানবে।
মায়মুনা! তোমাকে নিয়ে একটি স্বপ্ন দেখে মন অস্থির হয়ে ছিল। স্বপ্নের তাবীর’ বের করার পর অস্থিরতা কমেছে। আগে স্বপ্নটা বলি, তারপর তার তাবীর বলব।
শুক্লপক্ষের রাতে ফজরের আজানের আগে আগে স্বপ্নটা দেখি। স্বপ্নে তুমি হুজরাখানায় মুসুল্লিদের উদ্দেশে কী যেন বলছ। মুসুল্লিরা আগ্রহ নিয়ে তোমার কথা শুনছেন। মুসুল্লিদের মধ্যে আমিও আছি। আমি অবাক হয়ে দেখছি, তুমি সম্পূর্ণ নগ্নগাত্র। শরীরে একটা সুতাও নাই।
এই ধরনের স্বপ্ন দেখলে অস্থির হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি অল্প সময়ে স্বপ্নের তাবীর বের করে মনে প্রভূত শান্তি পেয়েছি।
স্বপ্নের তাবীর হলো—পোশাক মানুষের আবরণ। পোশাক মানুষকে ঢেকে রাখে। পোশাক হলো পর্দা। তুমি সবার সামনে উপস্থিত হয়েছ পর্দা ছাড়া। অর্থাৎ তুমি কোনোরকম ভনিতা ছাড়া নিজেকে প্রকাশ করেছ। আলহামদুলিল্লাহ।
বাতেনি জগতে সংবাদ আদানপ্রদান হয় প্রতীকের মাধ্যমে। এইসব প্রতীকের ব্যাখ্যা জটিল হয়ে থাকে। আমার জানামতে একমাত্র বড় পীর সাহেবই প্রতীকের নির্ভুল ব্যাখ্যা করতে পারতেন।
মায়মুনা! বাতেনি জগতের নানান বিষয় নিয়ে তোমার সঙ্গে আলাপ করার আমার শখ ছিল। যেমন, মানুষের বেলায়েতি ক্ষমতা। যা আমার পিতার ছিল, আমার নাই। তোমাকে আমার সঙ্গে জোর করে বিবাহ দিবার কারণে তুমি উনার প্রতি নারাজ। মুখে তুমি কোনোদিন কিছু না বললেও আমি তা বুঝতে পারি।
মায়মুনা! আমার পিতার উপর থেকে তুমি নারাজি ভাব দূর করো। উনার মতো জ্ঞানী মানুষ আমি দেখি নাই। উনি হাদিস, তফছির, ফেকাহ, মন্তেক, হেকমত, বালাগত, উছুল, আকায়েদ এবং ফরায়েজ জ্ঞানে জ্ঞানী ছিলেন। উনি চোখের সামনে ভবিষ্যৎ দেখতে পেতেন। তোমার ভবিষ্যতও উনি নিশ্চয়ই দেখেছিলেন।
দরবারশরিফে জ্বিনের আগমন এবং জ্বিন কর্তৃক দোয়াপাঠের কার্যক্রম তিনি শুরু করেছিলেন। আমি জানি এই বিষয়ে অনেকের মতো তোমার মনেও সন্দেহ আছে। এই বিষয়ে আমার পিতার কী বক্তব্য তা তোমাকে জানাতে ইচ্ছা করি। উনাকে জ্বিন-বিষয়ক কোনো প্রশ্ন করা হলে উনি মহাকবি খসরুর একটি শায়ের পাঠ করতেন। শায়েরটি হলো—
‘খল্ক মি গোয়েদ কে খসরু ভুল পুরস্তি মিকুনদ আরে আরে মিকুম বা খলকে আলম কার নিস্ত।’
এর অর্থ ‘লোকে বলে খসরু ভূতের পূজা করে। সত্যই। আমি তা-ই করি। ইহা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।‘
প্রিয় মায়মুনা! আমার ধারণা আমার পিতারও কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল। যেমন, হুজরাখানায় জ্বিনের আগমন। জ্বিন কর্তৃক মিলাদ পাঠ। জ্বিনের আগমন এবং মিলাদ পাঠ যে ভুয়া তা আমি অল্পবয়সেই ধরতে পারি। আকিকুন্নিসা নামের এক খর্বাকৃতি কুদর্শন তরুণী (মহিলা হাফেজিয়া মাদ্রাসার ছাত্রী) পাঞ্জাবি পরিধান করে জ্বিন সেজে লাফালাফি করত। শূন্যে লাফ দেওয়ার তার অস্বাভাবিক ক্ষমতা ছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হতো সে শূন্যে ভাসছে।
পিতার মৃত্যুর পর আমি জ্বিন আনা খেলা বন্ধ করেছি। তবে মায়মুনা, জ্বিন অস্বীকার করবে না। পবিত্র কোরানশরিফে অনেকবার জ্বিনের কথা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরানশরিফে জ্বিন নামে একটি সূরাও আছে। আমি আমার জীবনে দুইবার জ্বিনের সাক্ষাৎ পেয়েছি। জাত হিসাবে এরা উগ্র এবং খানিকটা নির্বোধ। তোমার সঙ্গে যদি কখনো দেখা হয় তাহলে এই বিষয়ে বলব ইনশাল্লাহ।