হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, কেমন আছ মায়মুনা?
অবন্তি বলল, মায়মুনা কেমন আছে আমি জানি না, তবে আমি ভালো আছি। টিফিন ক্যারিয়ারে কি উরসের খাবার?
খাবার না, সিন্নি। উরসের সিন্নি।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।
হাফেজ জাহাঙ্গীর বললেন, ঘরে ঢুকব না। এখন চলে যাব। কিছুক্ষণ আগে ইশারা পেয়েছি, আমার মা মারা গেছেন। তাঁর নামাজে জানাজা পড়তে হবে।
অবন্তি বলল, ইশারা কে দিল? আপনার পোষ জ্বিন?
জাহাঙ্গীর জবাব দিলেন না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, সিন্নিটা অজু করে খেয়ো। জীবজন্তু পশুপাখিকে খেতে দিয়ো না।
তাদের কেন সিন্নি খেতে দেওয়া যাবে না?
পশুপাখি-জীবজন্তুকে খাওয়ানোর দায়িত্ব মানুষের না। এই দায়িত্ব আল্লাহপাক নিজে নিয়েছেন।
অবন্তি বলল, দরজায় দাঁড়িয়ে কতক্ষণ আর বকবক করবেন? ঘরে এসে বসুন। আমার সঙ্গে সকালের নাশতা করুন।
মায়মুনা, আমি রোজা রেখেছি।
রোজা ভাঙুন।
রোজা ভাঙব?
হ্যাঁ।
হাফেজ জাহাঙ্গীর হতভম্ব গলায় বললেন, আল্লাহপাকের নামে যে রোজা রেখেছি তা তোমার কথায় ভাঙব?
হ্যাঁ। সব মানুষের ভেতরই আল্লাহ অবস্থান করেন। কাজেই আমার কথা এক অর্থে আল্লাহপাকেরই কথা।
জাহাঙ্গীর হতাশ গলায় বললেন, আমি রোজা ভাঙব, তবে তোমার কথা আল্লাহপাকের কথা এই ধরনের আলাপ আর করবে না।
আচ্ছা করব না।
সরফরাজ খান ঘুম ভেঙে এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন হাফেজ জাহাঙ্গীর নাশতা খাচ্ছেন। তার প্লেটে লুচি তুলে দিচ্ছে অবন্তি। তিনি বদটার গলা ঠিকই শুনেছেন। অবন্তি কি কোনো মতলব পাকাচ্ছে?
হাফেজ জাহাঙ্গীর সরফরাজ খানের দিকে তাকিয়ে বললেন, নাশতা খাচ্ছি এইজন্যে সালাম দিলাম না। খাওয়া-খাদ্য গ্রহণ করা হলো ইবাদত। ইবাদতের সময় মানুষকে সালাম দেওয়া যায় না।
সরফরাজ খান খড়খড়ে গলায় বললেন, কী জন্যে এসেছ?
উরসের সিন্নি নিয়ে এসেছি।
উরসের সিন্নি নিয়ে বিদায় হয়ে যাও।
জি আচ্ছা।
সরফরাজ খান বললেন, জি আচ্ছা জি আচ্ছা না। নাশতা শেষ করেই বিদায়।
জি আচ্ছা।
অবন্তি তার দাদাজানকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাফেজ জাহাঙ্গীরকে বলল, আপনি নাশতা শেষ করে আমার সঙ্গে ছাদে যাবেন। ছাদে আমরা চা খাব। তারপর যাবেন।
হাফেজ জাহাঙ্গীর যখন লুচি খাচ্ছেন তখন আরেকটি কাকতালীয় ব্যাপার ঘটছে। লুচি পাচ্ছে শফিক। তার প্লেটে লুচি তুলে দিচ্ছেন রমনা থানার ওসি শামসুদ্দিন পাটোয়ারি। ওসি সাহেব তাকে জেলহাজত থেকে নিয়ে এসেছেন।
ওসি সাহেব বললেন, আপনার জন্যে সুসংবাদ আছে। চা খেয়ে বাসায় চলে যান। আপনার বিরুদ্ধে কোনো চার্জ নেই।
শফিক অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তার মন বলছে, ওসি সাহেব তার সঙ্গে তামাশা করছেন। চা-সিগারেট-মুক্তি সবই পুলিশের তামাশার অংশ। পুলিশমিলিটারি সাধারণ মানুষ না। তাদের তামাশা সাধারণ মানুষের মতো না।
শফিক নিশ্চিত, চায়ে চুমুক দেওয়ার পরপরই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে। গুদামঘরের মতো কোনো ঘরে। সেখানে মার শুরু হবে। মারের প্রস্তুতি শফিক নিয়ে রেখেছে। আলিম ডাকাতের দেওয়া দুটি ট্যাবলেট তার বুকপকেটে। চা খেতে খেতে একফাকে ট্যাবলেট দুটি খেয়ে ফেলতে হবে। মার শুরু হলে দমে দমে বলতে হবে-হুয়াল হাইয়ুল কাইয়ুম।
আল্লাহপাকের এই পবিত্র নাম পড়ার ফলে মারের কারণে কোনো ব্যথা বোধ হবে না।
শামসুদ্দিন পাটোয়ারি বললেন, আপনি চা খাচ্ছেন না, সিগারেটও খাচ্ছেন। ব্যাপার কী?
শফিক বলল, ভয় লাগছে স্যার।
শামসুদ্দিন বললেন, আমাকে বলা হয়েছে আপনি অতিসাহসী একজন মানুষ। আর আপনি ভয় পাচ্ছেন?
পাচ্ছি স্যার।
আপনাকে সাহসী মানুষ কে বলেছে জানতে চান?
জি-না, চাই না।
আশ্চর্য ব্যাপার! জানতে চাইছেন না কেন? আপনাকে সাহসী মানুষ বলেছেন সেনাপ্রধান খালেদ মোশাররফ। তিনি ভুল কথা বলার মানুষ না। উনার কারণেই তড়িঘড়ি করে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বুঝেছেন?
জি স্যার।
আপনি তো ঢাকাতেই থাকবেন?
শফিক বলল, জি-না স্যার। গ্রামে মায়ের কাছে চলে যাব। আর আসব না। ঢাকা শহর আমার মতো অভাজনের জন্যে না।
শামসুদ্দিন বললেন, অভাজন মানে কী?
শফিক বলল, অভাজন হলো আমজনতা।
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক তাঁর আগামসি লেনের ছাদে পাটি পেতে বসে আছেন। তাকে সকালের নাশতা দেওয়া হয়েছে। এখানেও লুচি। লুচির সঙ্গে নেহারি। তিনি নাশতা খাওয়া শুরু করেন নি। পাশে রাখা ফিলিপস ট্রানজিস্টার রেডিওতে সকালের খবর শুনছেন। তবে তাঁর দৃষ্টি চিলেকোঠার দরজার দিকে। তাঁর মনে হচ্ছে দরজার ওপাশে কে যেন দাঁড়িয়ে পাইপ টানছে। তিনি তামাকের গন্ধও পাচ্ছেন। পরিচিত গন্ধ—এরেন মোর।
খন্দকার মোশতাক বললেন, কে ওখানে? কে?
ভারী গলায় কেউ-একজন বলল, আমি। এই গলার স্বর খন্দকার মোশতাকের অতি পরিচিত। তার শরীর হিম হয়ে গেল। বুকে ব্যথা শুরু হলো। ইদানীং তাঁর এই সমস্যা হচ্ছে—তিনি মৃত মানুষদের আশপাশে দেখতে পাচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথাবার্তাও বলছেন। মনে হয় তিনি দ্রুত মস্তিষ্কবিকৃতির দিকে যাচ্ছেন।
গত রাতে ঘুমাবার সময় দেখলেন, হামিদ তার বিছানার এক কোনায় বসে আছে। হামিদ লঞ্চডুবিতে পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। হামিদের কাজ ছিল তার গা, হাত-পা টিপে দেওয়া।
মৃত একজন মানুষকে তার বিছানার পাশে বসে থাকতে দেখে মোশতাক সাহেবের বুকে ধাক্কার মতো লাগল। তার হাঁপানির টান উঠে গেল। হামিদ বলল, স্যারের শইল কেমুন?