আজ বিকেলে যদি আসি আপনাদের অসুবিধা হবে?
না, আমার কোন অসুবিধা হবে না।
আপনি বোধহয় আমার উপর তেমন কনফিডেন্স পাচ্ছেন না। আমি এবার ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট হয়েছি। ডিজাইনে আমি রেকর্ড নাম্বার পেয়েছি।
তাই নাকি?
জ্বি। নিজের মুখে নিজের কথা বলতে আমার খুবই লজ্জা লাগছে– কিন্তু আপনি এত অবহেলার সংগে আমাকে দেখছিলেন বলে বাধ্য হয়ে বললাম।
বলে ভালই করেছ।
আমি আমার জীবনের প্রথম ডিজাইনটা বিনা পারিশ্রমিকে করব বলে কেন ঠিক করেছি সেটাও আপনাকে বলি –লুই ক্যান তাই করেছিলেন।
লুই ক্যান কে?
লুই ক্যান হলেন পৃথিবীর সেরা স্থপতিদের একজন। ঢাকার সেকেণ্ড ক্যাপিটেল– সংসদ ভবন — এইসব তাঁর করা।
ও আচ্ছা।
আপনার সঙ্গে অনেক বকবক করে ফেলেছি। আপনি বোধহয় আমাকে বাঁচাল ভাবছেন। এম্নিতে আমি খুব কম কথা বলি।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, এম্নিতে কম কথা বল –তাহলে এখন এত বেশি কথা কেন বলছ?
ইস্তিয়াক হাসল আর তখনি বাবলু ঢুকল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাচলাম। অপরিচিত কারো সঙ্গে ভদ্রতা বজায় রেখে দীর্ঘ সময় কথাবার্তা বলতে ভাল লাগে না। তাছাড়া অনেক কাজ পড়ে আছে। বাবার হজমের সমস্যা হচ্ছে। তাঁর জন্যে পেপের তরকারী রান্না করতে হবে। পান্নাভাবী আমাকে নিয়ে কোথায় নাকি যাবেন। তিনি এমন এক মহিলা –একবার যখন ঠিক করেছেন আমাকে নিয়ে বের হবেন তখন বের হবেনই। কতক্ষণ লাগবে উনার কে জানে? অল্প সময়ের ব্যাপার হলে –দুপুরের রান্না চড়াবার আগেই সেরে আসা যায়। সমস্যা হচ্ছে– পান্নাভাবী। বলছেন না– তিনি কোথায় যাবেন, কতক্ষণের জন্য যাবেন।
.
.
আমি পান্নাভাবীর সঙ্গে বের হলাম ভরদুপুরে। ইস্তিয়াক তখনো আছে। গজফিতা নিয়ে এসেছে। দুজনে মিলে মাপামাপি করছে। ইস্তিয়াকের যতটা উৎসাহ বাবলুর উৎসাহ তারচে বেশি। বাবা বারান্দায় বসে কিছুটা অবাক হয়েই মাপামাপি দেখছেন।
পান্নাভাবী কোথায় যাচ্ছেন সেই রহস্য রিকশায় উঠে ভেদ করলেন। তিনি যাচ্ছেন অসম্ভব ক্ষমতাসম্পন্ন এক সাইকিকের কাছে। সেই সাইকিক নাকি বিবাহিত মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের স্বামীদের অনেক গুপ্ত ব্যাপার বলে দিতে পারেন। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম –নাজমুল ভাইয়ের গুপ্ত ব্যাপার আপনি জানতে চাচ্ছেন জানুন –কিন্তু আমাকে সঙ্গে নিচ্ছেন কেন? আমি তো কিছু জানতে চাচ্ছি না।
একা যেতে অস্বস্তি লাগে এই জন্যেই তোমাকে নিচ্ছি। আরেকটা কারণও অবশ্যি আছে। ঐ সাইকিক ভদ্রলোকের বাড়ির পাশেই বীনুদের বাসা। ওদের কাছ থেকেও ঘুরে আসব। বাবলুর সঙ্গে বীনুর বিয়ের কতদূর কি হল। তুমি তো বলেছিলে মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে। তারপর কি?
পছন্দ হওয়া পর্যন্তই। আর এগুচ্ছে না। বাবলুর মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে। বলেই মনে হয়। তবে সে ঘোষণা দিয়েছে কোটিপতি না হবার আগে বিয়ে করবে না। মনে হচ্ছে –বাবলুর কোটিপতি না হওয়া পর্যন্ত বীনুকে অপেক্ষা করতে হবে
সাইকিক ভদ্রলোককে এই ব্যাপারেও কাজে লাগানো যাবে। উনি বশীকরণ মন্ত্রও জানেন।
বশীকরণ মন্ত্র দিয়ে বশ করিয়ে তারপর বাবলুকে বিয়ে দিতে হবে?
প্রয়োজনে দিতে হবে।
এই যুগে মন্ত্রতন্ত্র কেউ বিশ্বাস করে ভাবী?
আগের যুগে বিশ্বাস করলে যদি কোন ক্ষতি না হয়ে থাকে –এ যুগে বিশ্বাস করলেও কোন ক্ষতি নেই। মন্ত্র তন্ত্র, কুফুরী কালাম এইসব আছে। তুমি ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবে।
উনি কত টাকা নেন?
ধরাবাঁধা কিছু নেই। খুশি হয়ে তুমি যা দেবে তাই নেবেন। কিছু না দিলেও ক্ষতি নেই।
ভাবী, আমি ঐ লোকের কাছে যেতে চাচ্ছি না।
তোমার নিজের জন্যেও তো তাঁর কাছে তোমার যাওয়া দরকার। পরীক্ষা করে। দেখতে দোষ কি? তুমি তোমার ছেলের কথা তাঁকে জিজ্ঞেস কর। দেখ উনি কি বলেন।
ভদ্রলোক আর্মির রিটায়ার্ড সুবাদার। আর্মির সঙ্গে সাইকিক ক্ষমতার যোগসূত্র –ভাবতেই অস্বস্তি লাগে। লম্বা চওড়া মানুষ। মাথায় এক গাছি চুলও নেই– বেলের মত পরিষ্কার চকচকে একটা মাথা। মুখে প্রকাণ্ড গোঁফ আছে। ধবধবে সাদা। গোঁফ। ভাবভঙ্গি অমায়িক। দুপুরের খাওয়া সেরে পান চিবুচ্ছেন তখন আমরা উপস্থিত। অসময়ে উপস্থিত হওয়ায় ভদ্রলোক বিরক্ত না হয়ে খুশি হলেন বলে মনে হল। পান্নাভাবী এই লোকের অপরিচিত নন। পান্নাভাবীকে দেখেই তিনি হাসিমুখে বললেন, আবারো কোন সমস্যা?
পান্নাভাবী হাসলেন।
ভদ্রলোক বললেন –আপনি আপনার স্বামী নিয়ে শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করছেন। উনি ভাল আছেন –উনার কোন সমস্যা নাই।
ঠিক বলছেন তো?
অবশ্যই ঠিক বলছি।
আমার এক বোনকে নিয়ে এসেছি। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলুন তো।
ভদ্রলোক আমার দিকে তাকালেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আপনাকে কিছু বলতে হবে না। পান্নাভাবী বললেন –না না, আপনি বলুন। আপনি ওর ছেলের সম্পর্কে বলুন। ওর ছেলের নাম টুকুন। ছেলেটা কেমন আছে?
ভাল আছে।
ও এখন কোথায় আছে? দেশে না দেশের বাইরে?
ও এখন দেশেই আছে।
আমি স্পষ্ট বিরক্তি নিয়ে বললাম, পান্নাভাবী, চলুন বাসায় যাই। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
আর একটু বোস না।
না, আমি আর এক সেকেণ্ড বসব না। প্লীজ ভাবী, চলুন।
নিতান্ত অনিচ্ছায় পান্নাভাবী উঠলেন।
.
মানুষের মন যে কত দুর্বল তার সবচে বড় প্রমাণ হল ঐ দিন সন্ধ্যাবেলায় আমার খুব অস্থির লাগতে লাগল। বার বার মনে হচ্ছে –হতেও তো পারে –সাইকিক ভদ্রলোক ঠিকই বলেছেন। টুকুন এসেছে। মানুষের অস্বাভাবিক ক্ষমতা একেবারে যে থাকে না –তা তো না। ইএসপি নিয়ে পশ্চিমা দেশে আজকাল কত গবেষণা হচ্ছে।