- বইয়ের নামঃ ক্ষণিকা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ দি স্কাই পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অকালে
ভাঙা হাটে কে ছুটেছিস ,
পসরা লয়ে ?
সন্ধ্যা হল , ওই – যে বেলা
গেল রে বয়ে ।
যে যার বোঝা মাথার ‘ পরে
ফিরে এল আপন ঘরে ,
একাদশীর খণ্ড শশী
উঠল পল্লীশিরে ।
পারের গ্রামে যারা থাকে
উচ্চকণ্ঠে নৌকা ডাকে ,
হাহা করে প্রতিধ্বনি
নদীর তীরে তীরে ।
কিসের আশে ঊর্ধ্বশ্বাসে
এমন সময়ে
ভাঙা হাটে তুই ছুটেছিস
পসরা লয়ে ?
সুপ্তি দিল বনের শিরে
হস্ত বুলায়ে ,
কা কা ধ্বনি থেমে গেল
কাকের কুলায়ে ।
বেড়ার ধারে পুকুর – পাড়ে
ঝিল্লি ডাকে ঝোপে ঝাড়ে ,
বাতাস ধীরে পড়ে এল ,
স্তব্ধ বাঁশের শাখা—
হেরো ঘরের আঙিনাতে
শ্রান্তজনে শয়ন পাতে ,
সন্ধ্যাপ্রদীপ আলোক ঢালে
বিরাম – সুধা – মাখা ।
সকল চেষ্টা শান্ত যখন
এমন সময়ে
ভাঙা হাটে কে ছুটেছিস ,
পসরা লয়ে ?
অচেনা
কেউ যে কারে চিনি নাকো
সেটা মস্ত বাঁচন ।
তা না হলে নাচিয়ে দিত
বিষম তুর্কি – নাচন ।
বুকের মধ্যে মনটা থাকে ,
মনের মধ্যে চিন্তা—
সেইখানেতেই নিজের ডিমে
সদাই তিনি দিন তা ।
বাইরে যা পাই সম্জে নেব
তারি আইন – কানুন ,
অন্তরেতে যা আছে তা
অন্তর্যামীই জানুন ।
চাই নে রে , মন চাই নে ।
মুখের মধ্যে যেটুকু পাই
যে হাসি আর যে কথাটাই
যে কলা আর যে ছলনাই
তাই নে রে মন , তাই নে ।
বাইরে থাকুক মধুর মূর্তি ,
সুধামুখের হাস্য ,
তরল চোখে সরল দৃষ্টি—
করব না তার ভাষ্য ।
বাহু যদি তেমন করে
জড়ায় বাহুবন্ধ
আমি দুটি চক্ষু মুদে
রইব হয়ে অন্ধ—
কে যাবে ভাই , মনের মধ্যে
মনের কথা ধরতে ?
কীটের খোঁজে কে দেবে হাত
কেউটে সাপের গর্তে ?
চাই নে রে , মন চাই নে ।
মুখের মধ্যে যেটুকু পাই
যে হাসি আর যে কথাটাই
যে কলা আর যে ছলনাই
তাই নে রে মন , তাই নে ।
মন নিয়ে কেউ বাঁচে নাকো ,
মন বলে যা পায় রে
কোনো জন্মে মন সেটা নয়
জানে না কেউ হায় রে ।
ওটা কেবল কথার কথা ,
মন কি কেহ চিনিস ?
আছে কারও আপন হাতে
মন ব’লে এক জিনিস ?
চলেন তিনি গোপন চালে ,
স্বাধীন তাঁহার ইচ্ছে—
কেই বা তাঁরে দিচ্ছে এবং
কেই বা তাঁরে নিচ্ছে !
চাই নে রে , মন চাই নে ।
মুখের মধ্যে যেটুকু পাই
যে হাসি আর যে কথাটাই
যে কলা আর যে ছলনাই
তাই নে রে মন , তাই নে ।
অতিথি
ওই শোনো গো , অতিথ বুঝি আজ
এল আজ ।
ওগো বধূ , রাখো তোমার কাজ
রাখো কাজ ।
শুনছ না কি তোমার গৃহদ্বারে
রিনিঠিনি শিকলটি কে নাড়ে ,
এমন ভরা সাঁঝ !
পায়ে পায়ে বাজিয়ো নাকো মল ,
ছুটো নাকো চরণ চঞ্চল ,
হঠাৎ পাবে লাজ ।
ওই শোনো গো , অতিথ এল আজ
এল আজ ।
ওগো বধূ , রাখো তোমার কাজ
রাখো কাজ ।
নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয়
কভু নয় ।
ওগো বধূ , মিছে কিসের ভয়
মিছে ভয় !
আঁধার কিছু নাইকো আঙিনাতে ,
আজকে দেখো ফাগুন – পূর্ণিমাতে
আকাশ আলোময় ।
নাহয় তুমি মাথার ঘোমটা টানি
হাতে নিয়ো ঘরের প্রদীপখানি ,
যদি শঙ্কা হয় ।
নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয়
কভু নয় ।
ওগো বধূ মিছে কিসের ভয়
মিছে ভয় !
নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে
পান্থ – সনে ।
দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে
দুয়ার – কোণে ।
প্রশ্ন যদি শুধায় কোনো – কিছু
নীরব থেকো মুখটি করে নীচু
নম্র দু – নয়নে ।
কাঁকন যেন ঝংকারে না হাতে ,
পথ দেখিয়ে আনবে যবে সাথে
অতিথিসজ্জনে ।
নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে
পান্থ – সনে ।
দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে
দুয়ার – কোণে ।
ওগো বধূ , হয় নি তোমার কাজ
গৃহ – কাজ ?
ওই শোনো কে অতিথ এল আজ
এল আজ ।
সাজাও নি কি পূজারতির ডালা ?
এখনো কি হয় নি প্রদীপ জ্বালা
গোষ্ঠগৃহের মাঝ ?
অতি যত্নে সীমান্তটি চিরে
সিঁদুর – বিন্দু আঁক নাই কি শিরে ?
হয় নি সন্ধ্যাসাজ ?
ওগো বধূ , হয় নি তোমার কাজ
গৃহ – কাজ ?
ওই শোনো কে অতিথ এল আজ
এল আজ ।
অতিবাদ
আজ বসন্তে বিশ্বখাতায়
হিসেব নেইকো পুষ্পে পাতায় ,
জগৎ যেন ঝোঁকের মাথায়
সকল কথাই বাড়িয়ে বলে ।
ভুলিয়ে দিয়ে সত্যি মিথ্যে ,
ঘুলিয়ে দিয়ে নিত্যানিত্যে ,
দু ধারে সব উদারচিত্তে
বিধিবিধান ছাড়িয়ে চলে ।
আমারো দ্বার মুক্ত পেয়ে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
প্রিয়ার পুণ্যে হলেম রে আজ
একটা রাতের রাজ্যাধিরাজ ,
ভাণ্ডারে আজ করছে বিরাজ
সকল প্রকার অজস্রত্ব ।
কেন রাখব কথার ওজন ?
কৃপণতায় কোন্ প্রয়োজন ?
ছুটুক বাণী যোজন যোজন
উড়িয়ে দিয়ে ষত্ব ণত্ব ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত ক’রে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
হে প্রেয়সী স্বর্গদূতী ,
আমার যত কাব্যপুঁথি
তোমার পায়ে পড়ে স্তুতি ,
তোমারি নাম বেড়ায় রটি ;
থাকো হৃদয় – পদ্মটিতে
এক দেবতা আমার চিতে—
চাই নে তোমায় খবর দিতে
আরো আছেন তিরিশ কোটি ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত ক’রে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
ত্রিভুবনে সবার বাড়া
একলা তুমি সুধার ধারা ,
উষার ভালে একটি তারা ,
এ জীবনে একটি আলো—
সন্ধ্যাতারা ছিলেন কে কে
সে – সব কথা যাব ঢেকে ,
সময় বুঝে মানুষ দেখে
তুচ্ছ কথা ভোলাই ভালো ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
সত্য থাকুন ধরিত্রীতে
শুষ্ক রুক্ষ ঋষির চিতে ,
জ্যামিতি আর বীজগণিতে ,
কারো ইথে আপত্তি নেই—
কিন্তু আমার প্রিয়ার কানে
এবং আমার কবির গানে
পঞ্চশরের পুষ্পবাণে
মিথ্যে থাকুন রাত্রিদিনেই ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
ওগো সত্য বেঁটেখাটো ,
বীণার তন্ত্রী যতই ছাঁটো ,
কণ্ঠ আমার যতই আঁটো ,
বলব তবু উচ্চ সুরে—
আমার প্রিয়ার মুগ্ধ দৃষ্টি
করছে ভুবন নূতন সৃষ্টি ,
মুচকি হাসির সুধার বৃষ্টি
চলছে আজি জগৎ জুড়ে ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
যদি বল ‘ আর বছরে
এই কথাটাই এমনি করে
বলেছিলি , কিন্তু ওরে
শুনেছিলেন আরেক জনে’—
জেনো তবে মূঢ়মত্ত ,
আর বসন্তে সেটাই সত্য ,
এবারো সেই প্রাচীন তত্ত্ব
ফুটল নূতন চোখের কোণে ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
আজ বসন্তে বকুল ফুলে
যে গান বায়ু বেড়ায় বুলে
কাল সকালে যাবে ভুলে—
কোথায় বাতাস, কোথায় সে ফুল !
হে সুন্দরী , তেমনি কবে
এ – সব কথা ভুলব যবে
মনে রেখো আমায় তবে—
ক্ষমা কোরো আমার সে ভুল ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
অনবসর
ছেড়ে গেলে হে চঞ্চলা ,
হে পুরাতন সহচরী !
ইচ্ছা বটে বছর কতক
তোমার জন্য বিলাপ করি ,
সোনার স্মৃতি গড়িয়ে তোমার
বসিয়ে রাখি চিত্ততলে ,
একলা ঘরে সাজাই তোমায়
মাল্য গেঁথে অশ্রুজলে—
নিদেন কাঁদি মাসেক – খানেক
তোমায় চির – আপন জেনেই—
হায় রে আমার হতভাগ্য !
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
বর্ষে বর্ষে বয়স কাটে ,
বসন্ত যায় কথায় কথায় ,
বকুলগুলো দেখতে দেখতে
ঝ’রে পড়ে যথায় তথায় ,
মাসের মধ্যে বারেক এসে
অস্তে পালায় পূর্ণ – ইন্দু ,
শাস্ত্রে শাসায় জীবন শুধু
পদ্মপত্রে শিশিরবিন্দু—
তাঁদের পানে তাকাব না
তোমায় শুধু আপন জেনেই
সেটা বড়োই বর্বরতা—
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
এসো আমার শ্রাবণ – নিশি ,
এসো আমার শরৎলক্ষ্মী ,
এসো আমার বসন্তদিন
লয়ে তোমার পুষ্পপক্ষী ,
তুমি এসো , তুমিও এসো ,
তুমি এসো , এবং তুমি ,
প্রিয়ে , তোমরা সবাই জান
ধরণীর নাম মর্তভূমি—
যে যায় চলে বিরাগভরে
তারেই শুধু আপন জেনেই
বিলাপ করে কাটাই , এমন
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
ইচ্ছে করে বসে বসে
পদ্যে লিখি গৃহকোণায়
‘ তুমিই আছ জগৎ জুড়ে’—
সেটা কিন্তু মিথ্যে শোনায় ।
ইচ্ছে করে কোনোমতেই
সান্ত্বনা আর মান্ব না রে ,
এমন সময় নতুন আঁখি
তাকায় আমার গৃহদ্বারে—
চক্ষু মুছে দুয়ার খুলি
তারেই শুধু আপন জেনেই ,
কখন তবে বিলাপ করি ?
সময় যে নেই , সময় যে নেই ।
অন্তরতম
আমি যে তোমায় জানি , সে তো কেউ জানে না ।
তুমি মোর পানে চাও , সে তো কেউ মানে না ।
মোর মুখে পেলে তোমার আভাস
কত জনে কত করে পরিহাস ,
পাছে সে না পারি সহিতে
নানা ছলে তাই ডাকি যে তোমায়—
কেহ কিছু নারে কহিতে ।
তোমার পথ যে তুমি চিনায়েছ
সে কথা বলি নে কাহারে ।
সবাই ঘুমালে জনহীন রাতে
একা আসি তব দুয়ারে ।
স্তব্ধ তোমার উদার আলয় ,
বীণাটি বাজাতে মনে করি ভয় ,
চেয়ে থাকি শুধু নীরবে ।
চকিতে তোমার ছায়া দেখি যদি
ফিরে আসি তব গরবে ।
প্রভাত না হতে কখন আবার
গৃহকোণ – মাঝে আসিয়া
বাতায়নে বসি বিহ্বল বীণা
বিজনে বাজাই হাসিয়া ।
পথ দিয়ে যে বা আসে যে বা যায়
সহসা থমকি চমকিয়া চায় ,
মনে করে তারে ডেকেছি—
জানে না তো কেহ কত নাম দিয়ে
এক নামখানি ঢেকেছি ।
ভোরের গোলাপ সে গানে সহসা
সাড়া দেয় ফুলকাননে ,
ভোরের তারাটি সে গানে জাগিয়া
চেয়ে দেখে মোর আননে ।
সব সংসার কাছে আসে ঘিরে ,
প্রিয়জন সুখে ভাসে আঁখিনীরে ,
হাসি জেগে ওঠে ভবনে ।
যে নামে যে ছলে বীণাটি বাজাই
সাড়া পাই সারা ভুবনে ।
নিশীথে নিশীথে বিপুল প্রাসাদে
তোমার মহলে মহলে
হাজার হাজার সোনার প্রদীপ
জ্বলে অচপল অনলে ।
মোর দীপে জ্বেলে তাহারি আলোক
পথ দিয়ে আসি , হাসে কত লোক ,
দূরে যেতে হয় পালায়ে—
তাই তো সে শিখা ভবনশিখরে
পারি নে রাখিতে জ্বালায়ে ।
বলি নে তো কারে , সকালে বিকালে
তোমার পথের মাঝেতে
বাঁশি বুকে লয়ে বিনা কাজে আসি
বেড়াই ছদ্মসাজেতে ।
যাহা মুখে আসে গাই সেই গান
নানা রাগিণীতে দিয়ে নানা তান ,
এক গান রাখি গোপনে ।
নানা মুখপানে আঁখি মেলি চাই ,
তোমা – পানে চাই স্বপনে ।
অপটু
যতবার আজ গাঁথনু মালা
পড়ল খসে খসে
কী জানি কার দোষে !
তুমি হোথায় চোখের কোণে
দেখছ বসে বসে ।
চোখ – দুটিরে প্রিয়ে ,
শুধাও শপথ নিয়ে
আঙুল আমার আকুল হল
কাহার দৃষ্টিদোষে !
আজ যে বসে গান শোনাব
কথাই নাহি জোটে ,
কণ্ঠ নাহি ফোটে ।
মধুর হাসি খেলে তোমার
চতুর রাঙা ঠোঁটে ।
কেন এমন ত্রুটি
বলুক আঁখি – দুটি—
কেন আমার রুদ্ধ কণ্ঠে
কথাই নাহি ফোটে !
রেখে দিলাম মাল্য বীণা ,
সন্ধ্যা হয়ে আসে ।
ছুটি দাও এ দাসে—
সকল কথা বন্ধ করে
বসি পায়ের পাশে ।
নীরব ওষ্ঠ দিয়ে
পারব যে কাজ প্রিয়ে
এমন কোনো কর্ম দেহো
অকর্মণ্য দাসে ।
অবিনয়
হে নিরুপমা ,
চপলতা আজ যদি কিছু ঘটে
করিয়ো ক্ষমা ।
এল আষাঢ়ের প্রথম দিবস ,
বনরাজি আজি ব্যাকুল বিবশ ,
বকুলবীথিকা মুকুলে মত্ত
কানন -‘ পরে—
নবকদম্ব মদিরগন্ধে
আকুল করে ।
হে নিরুপমা ,
আঁখি যদি আজ করে অপরাধ
করিয়ো ক্ষমা ।
হেরো আকাশের দূর কোণে কোণে
বিজুলি চমকি উঠে খনে খন ে ,
বাতায়নে তব দ্রুত কৌতুকে
মারিছে উঁকি—
বাতাস করিছে দুরন্তপনা
ঘরেতে ঢুকি ।
হে নিরুপমা ,
গানে যদি লাগে বিহ্বল তান
করিয়ো ক্ষমা ।
ঝরঝর ধারা আজি উতরোল ,
নদীকূলে – কূলে উঠে কল্লোল ,
বনে বনে গাহে মর্মরস্বরে
নবীন পাতা—
সজল পবন দিশে দিশে তুলে
বাদলগাথা ।
হে নিরুপমা ,
আজিকে আচারে ত্রুটি হতে পারে ,
করিয়ো ক্ষমা ।
দিবালোকহারা সংসারে আজ
কোনোখানে কার ও নাহি কোনো কাজ ,
জনহীন পথ ধেনুহীন মাঠ
যেন সে আঁকা—
বর্ষণঘন শীতল আঁধারে
জগৎ ঢাকা ।
হে নিরুপমা ,
চপলতা আজি যদি ঘটে তবে
করিয়ো ক্ষমা ।
তোমার দুখানি কালো আঁখি -‘ পরে
শ্যাম আষাঢ়ের ছায়াখানি পড়ে ,
ঘন কালো তব কুঞ্চিত কেশে
যূথীর মালা ।
তোমারি ললাটে নববরষার
বরণডালা ।
অসাবধান
আমায় যদি মনটি দেবে
দিয়ো , দিয়ো মন—
মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু
রেখো সারাক্ষণ ।
খোলা আমার দুয়ারখানা ,
ভোলা আমার প্রাণ—
কখন যে কার আনাগোনা
নইকো সাবধান ।
পথের ধারে বাড়ি আমার ,
থাকি গানের ঝোঁকে—
বিদেশী সব পথিক এসে
যেথা – সেথাই ঢোকে ।
ভাঙে কতক , হারায় কতক
যা আছে মোর দামি—
এমনি ক’রে একে একে
সর্বস্বান্ত আমি ।
আমায় যদি মনটি দেবে দিয়ো , দিয়ো মন—
মনের মধ্যে ভাবনা কিন্তু রেখো সারাক্ষণ ।
আমায় যদি মনটি দেবে
নিষেধ তাহে নাই ,
কিছুর তরে আমায় কিন্তু
কোরো না কেউ দায়ী ।
ভুলে যদি শপথ ক’রে
বলি কিছু কবে ,
সেটা পালন না করি তো
মাপ করিতেই হবে ।
ফাগুন মাসে পূর্ণিমাতে
যে নিয়মটা চলে
রাগ কোরো না চৈত্র মাসে
সেটা ভঙ্গ হলে ।
কোনো দিন বা পূজার সাজি
কুসুমে হয় ভরা ,
কোনো দিন বা শূন্য থাকে—
মিথ্যা সে দোষ ধরা ।
আমায় যদি মনটি দেবে নিষেধ তাহে নাই ,
কিছুর তরে আমায় কিন্তু কোরো না কেউ দায়ী ।
আমায় যদি মনটি দেবে
রাখিয়া যাও তবে ,
দিয়েছ যে সেটা কিন্তু
ভুলে থাকতে হবে ।
দুটি চক্ষে বাজবে তোমার
নবরাগের বাঁশি ,
কণ্ঠে তোমার উচ্ছ্বসিয়া
উঠবে হাসিরাশি ।
প্রশ্ন যদি শুধাও কভু
মুখটি রাখি বুকে ,
মিথ্যা কোনো জবাব পেলে
হেসো সকৌতুকে ।
যে দুয়ারটা বন্ধ থাকে
বন্ধ থাকতে দিয়ো ,
আপনি যাহা এসে পড়ে
তাহাই হেসে নিয়ো ।
আমায় যদি মনটি দেবে , রাখিয়া যাও তবে—
দিয়েছ যে সেটা কিন্তু ভুলে থাকতে হবে ।
আবির্ভাব
বহুদিন হল কোন্ ফাল্গুনে
ছিনু আমি তব ভরসায় ;
এলে তুমি ঘন বরষায় ।
আজি উত্তাল তুমুল ছন্দে
আজি নবঘন – বিপুল – মন্দ্রে
আমার পরানে যে গান বাজাবে
সে গান তোমার করো সায়
আজি জলভরা বরষায় ।
দূরে একদিন দেখেছিনু তব
কনকাঞ্চল – আবরণ ,
নবচম্পক – আভরণ ।
কাছে এলে যবে হেরি অভিনব
ঘোর ঘননীল গুণ্ঠন তব ,
চলচপলার চকিত চমকে
করিছে চরণ বিচরণ ।
কোথা চম্পক – আভরণ !
সেদিন দেখেছি খনে খনে তুমি
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যেতে বনতল ,
নুয়ে নুয়ে যেত ফুলদল ।
শুনেছিনু যেন মৃদু রিনি রিনি
ক্ষীণ কটি ঘেরি বাজে কিংকিণী ,
পেয়েছিনু যেন ছায়াপথে যেতে
তব নিশ্বাসপরিমল ,
ছুঁয়ে যেতে যবে বনতল ।
আজি আসিয়াছ ভুবন ভরিয়া
গগনে ছড়ায়ে এলোচুল ,
চরণে জড়ায়ে বনফুল ।
ঢেকেছে আমারে তোমার ছায়ায়
সঘন সজল বিশাল মায়ায় ,
আকুল করেছ শ্যাম সমারোহে
হৃদয়সাগর – উপকূল
চরণে জড়ায়ে বনফুল ।
ফাল্গুনে আমি ফুলবনে বসে
গেঁথেছিনু যত ফুলহার
সে নহে তোমার উপহার ।
যেথা চলিয়াছ সেথা পিছে পিছে
স্তবগান তব আপনি ধ্বনিছে ,
বাজাতে শেখে নি সে গানের সুর
এ ছোটো বীণার ক্ষীণ তার—
এ নহে তোমার উপহার ।
কে জানিত সেই ক্ষণিকা মুরতি
দূরে করি দিবে বরষন ,
মিলাবে চপল দরশন ?
কে জানিত মোরে এত দিবে লাজ ?
তোমার যোগ্য করি নাই সাজ ,
বাসর – ঘরের দুয়ারে করালে
পূজার অর্ঘ্য – বিরচন—
একি রূপে দিলে দরশন ।
ক্ষমা করো তবে ক্ষমা করো মোর
আয়োজনহীন পরমাদ ,
ক্ষমা করো যত অপরাধ ।
এই ক্ষণিকের পাতার কুটিরে
প্রদীপ – আলোকে এসো ধীরে ধীরে ,
এই বেতসের বাঁশিতে পড়ুক
তব নয়নের পরসাদ—
ক্ষমা করো যত অপরাধ ।
আস নাই তুমি নবফাল্গুনে
ছিনু যবে তব ভরসায় ,
এসো এসো ভরা বরষায় ।
এসো গো গগনে আঁচল লুটায়ে ,
এসো গো সকল স্বপন ছুটায়ে ,
এ পরান ভরি যে গান বাজাবে
সে গান তোমার করো সায়
আজি জলভরা বরষায় ।
আষাঢ়
নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে
তিল ঠাঁই আর নাহি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে ।
বাদলের ধারা ঝরে ঝর – ঝর ,
আউশের খেত জলে ভর – ভর ,
কালী – মাখা মেঘে ও পারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে ।
ওই ডাকে শোনো ধেনু ঘনঘন ,
ধবলীরে আনো গোহালে ।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু
পোহালে ।
দুয়ারে দাঁড়ায়ে ওগো দেখ্ দেখি
মাঠে গেছে যারা তারা ফিরিছে কি ?
রাখাল – বালক কী জানি কোথায়
সারাদিন আজি খোয়ালে ।
এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু
পোহালে ।
শোনো শোনো ওই পারে যাবে ব’লে
কে ডাকিছে বুঝি মাঝিরে ।
খেয়া – পারাপার বন্ধ হয়েছে
আজি রে ।
পূবে হাওয়া বয় , কূলে নেই কেউ ,
দু কূল বাহিয়া উঠে পড়ে ঢেউ ,
দরদর বেগে জলে পড়ি জল
ছলছল উঠে বাজি রে ।
খেয়া – পারাপার বন্ধ হয়েছে
আজি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে গো তোরা
যাস নে ঘরের বাহিরে—
আকাশ আঁধার , বেলা বেশি আর
নাহি রে ।
ঝরঝর ধারে ভিজিবে নিচোল ,
ঘাটে যেতে পথ হয়েছে পিছল ,
ঐ বেণুবন দুলে ঘনঘন
পথপাশে দেখ্ চাহি রে ।
ওগো , আজ তোরা যাস নে ঘরের
বাহিরে ।
উদাসীন
হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি ,
ছুটি নে কাহারো পিছুতে ।
মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই
কিছুতে ।
নির্ভয়ে ধাই সুযোগ – কুযোগ বিছুরি ,
খেয়াল – খবর রাখি নে তো কোনো – কিছুরি—
উপরে চড়িতে যদি নাই পাই সুবিধা
সুখে পড়ে থাকি নিচুতেই , থাকি
নিচুতে ।
হাল ছেড়ে আজ বসে আছি আমি
ছুটি নে কাহারো পিছুতে—
মন নাহি মোর কিছুতেই , নাই
কিছুতে ।
যেথা – সেথা ধাই , যাহা – তাহা পাই—
ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে ।
তাই ব’লে কিছু কাড়াকাড়ি ক’রে
কাড়ি নে ।
যাহা যেতে চায় ছেড়ে দিই তারে তখুনি ,
বকি নে কারেও , শুনি নে কাহারো বকুনি—
কথা যত আছে মনের তলায় তলিয়ে
ভুলেও কখনো সহসা তাদের
নাড়ি নে ।
যেথা – সেথা ধাই , যাহা – তাহা পাই—
ছাড়ি নেকো ভাই , ছাড়ি নে ।
তাই ব’লে কিছু তাড়াতাড়ি ক’রে
কাড়ি নে ।
মন – দে’য়া – নে’য়া অনেক করেছি ,
মরেছি হাজার মরণে—
নূপুরের মতো বেজেছি চরণে
চরণে ।
আঘাত করিয়া ফিরেছি দুয়ারে দুয়ারে ,
সাধিয়া মরেছি ইঁহারে তাঁহারে উঁহারে—
অশ্রু গাঁথিয়া রচিয়াছি কত মালিকা ,
রাঙিয়াছি তাহা হৃদয় – শোণিত—
বরনে ।
মন – দে’য়া – নে’য়া অনেক করেছি ,
মরেছি হাজার মরণে
নূপুরের মতো বেজেছি চরণে
চরণে ।
এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি ,
মন ফেলে তাই ছুটেছি ;
তাড়াতাড়ি ক’রে খেলাঘরে এসে
জুটেছি ।
বুকভাঙা বোঝা নেব না রে আর তুলিয়া ,
ভুলিবার যাহা একেবারে যাব ভুলিয়া—
যাঁর বেড়ি তাঁরে ভাঙা বেড়িগুলি ফিরায়ে
বহুদিন পরে মাথা তুলে আজ
উঠেছি ।
এতদিন পরে ছুটি আজ ছুটি ,
মন ফেলে তাই ছুটেছি ।
তাড়াতাড়ি ক’রে খেলাঘরে এসে
জুটেছি ।
কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত
আগে পড়িত না নয়নে—
তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম
চয়নে ।
মধুকরসম ছিনু সঞ্চয়প্রয়াসী ;
কুসুমকান্তি দেখি নাই , মধু – পিয়াসী—
বকুল কেবল দলিত করেছি আলসে
ছিলাম যখন নিলীন বকুল—
শয়নে ।
কত ফুল নিয়ে আসে বসন্ত
আগে পড়িত না নয়নে —
তখন কেবল ব্যস্ত ছিলাম
চয়নে ।
দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি ,
মন নাহি মোর কিছুতে ;
তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি
পিছুতে ।
সবলে কারেও ধরি নে বাসনা – মুঠিতে ,
দিয়েছি সবারে আপন বৃন্তে ফুটিতে—
যখনি ছেড়েছি উচ্চে উঠার দুরাশা
হাতের নাগালে পেয়েছি সবারে
নিচুতে ।
দূরে দূরে আজ ভ্রমিতেছি আমি ,
মন নাহি মোর কিছুতে—
তাই ত্রিভুবন ফিরিছে আমারি
পিছুতে ।
উদ্বোধন
শুধু অকারণ পুলকে
ক্ষণিকের গান গা রে আজি প্রাণ
ক্ষণিক দিনের আলোকে
যারা আসে যায় , হাসে আর চায় ,
পশ্চাতে যারা ফিরে না তাকায় ,
নেচে ছুটে ধায় , কথা না শুধায় ,
ফুটে আর টুটে পলকে—
তাহাদেরি গান গা রে আজি প্রাণ
ক্ষণিক দিনের আলোকে ।
প্রতি নিমেষের কাহিনী
আজি বসে বসে গাঁথিস নে আর ,
বাঁধিস নে স্মৃতিবাহিনী ।
যা আসে আসুক , যা হবার হোক ,
যাহা চলে যায় মুছে যাক শোক ,
গেয়ে ধেয়ে যাক দ্যুলোক ভূলোক
প্রতি পলকের রাগিণী ।
নিমেষে নিমেষ হয়ে যাক শেষ
বহি নিমেষের কাহিনী ।
ফুরায় যা দে রে ফুরাতে ।
ছিন্ন মালার ভ্রষ্ট কুসুম
ফিরে যাস নেকো কুড়াতে ।
বুঝি নাই যাহা চাই না বুঝিতে ,
জুটিল না যাহা চাই না খুঁজিতে ,
পুরিল না যাহা কে রবে যুঝিতে
তারি গহ্বর পুরাতে ।
যখন যা পাস মিটায়ে নে আশ ,
ফুরাইলে দিস ফুরাতে ।
ওরে থাক্ থাক্ কাঁদনি !
দুই হাত দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে দে রে
নিজে হাতে বাঁধা বাঁধনি ।
যে সহজ তোর রয়েছে সমুখে
আদরে তাহারে ডেকে নে রে বুকে ,
আজিকার মতো যাক যাক চুকে
যত অসাধ্য – সাধনি ।
ক্ষণিক সুখের উৎসব আজি ,
ওরে থাক্ থাক্ কাঁদনি !
শুধু অকারণ পুলকে
নদীজলে – পড়া আলোর মতন
ছুটে যা ঝলকে ঝলকে ।
ধরণীর ‘পরে শিথিলবাঁধন
ঝলমল প্রাণ করিস যাপন ,
ছুঁয়ে থেকে দুলে শিশির যেমন
শিরীষ ফুলের অলকে ।
মর্মরতানে ভরে ওঠ্ গানে
শুধু অকারণ পুলকে ।
উৎসৃষ্ট
মিথ্যে তুমি গাঁথলে মালা
নবীন ফুলে ,
ভেবেছ কি কণ্ঠে আমার
দেবে তুলে ?
দাও তো ভালোই , কিন্তু জেনো
হে নির্মলে ,
আমার মালা দিয়েছি ভাই
সবার গলে ।
যে – ক’টা ফুল ছিল জমা
অর্ঘ্যে মম
উদ্দেশেতে সবায় দিনু—
নমো নমঃ ।
কেউ বা তাঁরা আছেন কোথা
কেউ জানে না ,
কারো বা মুখ ঘোমটা – আড়ে
আধেক চেনা ।
কেউ বা ছিলেন অতীত কালে
অবন্তীতে ,
এখন তাঁরা আছেন শুধু
কবির গীতে ।
সবার তনু সাজিয়ে মাল্যে
পরিচ্ছদে
কহেন বিধি ‘ তুভ্যমহং
সম্প্রদদে’ ।
হৃদয় নিয়ে আজ কি প্রিয়ে
হৃদয় দেবে ?
হায় ললনা , সে প্রার্থনা
ব্যর্থ এবে ।
কোথায় গেছে সেদিন আজি
যেদিন মম
তরুণ – কালে জীবন ছিল
মুকুলসম ,
সকল শোভা সকল মধু
গন্ধ যত
বক্ষোমাঝে বন্ধ ছিল
বন্দীমত ।
আজ যে তাহা ছড়িয়ে গেছে
অনেক দূরে—
অনেক দেশে , অনেক বেশে ,
অনেক সুরে ।
কুড়িয়ে তারে বাঁধতে পারে
একটিখানে
এমনতরো মোহন – মন্ত্র
কেই বা জানে !
নিজের মন তো দেবার আশা
চুকেই গেছে ,
পরের মনটি পাবার আশায়
রইনু বেঁচে ।
এক গাঁয়ে
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি
সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ ,
তাদের গাছে গায় যে দোয়েল পাখি
তাহার গানে আমার নাচে বুক ।
তাহার দুটি পালন – করা ভেড়া
চরে বেড়ায় মোদের বটমূলে ,
যদি ভাঙে আমার খেতের বেড়া
কোলের ‘ পরে নিই তাহারে তুলে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা ,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা ,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে—
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।
দুইটি পাড়ায় বড়োই কাছাকাছি ,
মাঝে শুধু একটি মাঠের ফাঁক—
তাদের বনের অনেক মধুমাছি
মোদের বনে বাঁধে মধুর চাক ।
তাদের ঘাটে পূজার জবামালা
ভেসে আসে মোদের বাঁধা ঘাটে ,
তাদের পাড়ার কুসুম – ফুলের ডালা
বেচতে আসে মোদের পাড়ার হাটে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা ,
আমাদের এই নদীর নাম অঞ্জনা ,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে—
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।
আমাদের এই গ্রামের গলি -‘ পরে
আমের বোলে ভরে আমের বন ,
তাদের খেতে যখন তিসি ধরে
মোদের খেতে তখন ফোটে শণ ।
তাদের ছাদে যখন ওঠে তারা
আমার ছাদে দখিন হাওয়া ছোটে ।
তাদের বনে ঝরে শ্রাবণধারা ,
আমার বনে কদম ফুটে ওঠে ।
আমাদের এই গ্রামের নামটি খঞ্জনা ,
আমাদের এই নদীর নামটি অঞ্জনা ,
আমার নাম তো জানে গাঁয়ের পাঁচ জনে—
আমাদের সেই তাহার নামটি রঞ্জনা ।
একটি মাত্র
গিরিনদী বালির মধ্যে
যাচ্ছে বেঁকে বেঁকে ,
একটি ধারে স্বচ্ছ ধারায়
শীর্ণ রেখা এঁকে ।
মরু – পাহাড় – দেশে
শুষ্ক বনের শেষে
ফিরেছিলেম দুই প্রহরে
দগ্ধ চরণতল ।
বনের মধ্যে পেয়েছিলেম
একটি আঙুর ফল ।
রৌদ্র তখন মাথার ‘পরে
পায়ের তলায় মাটি
জলের তরে কেঁদে মরে
তৃষায় ফাটি ফাটি ।
পাছে ক্ষুধার ভরে
তুলি মুখের ‘পরে
আকুল ঘ্রাণে নিই নি তাহার
শীতল পরিমল ।
রেখেছিলেম লুকিয়ে আমার
একটি আঙুর ফল ।
বেলা যখন পড়ে এল ,
রৌদ্র হল রাঙা ,
নিশ্বাসিয়া উঠল হু হু
ধূ ধূ বালুর ডাঙা—
থাকতে দিনের আলো
ঘরে ফেরাই ভালো ,
তখন খুলে দেখনু চেয়ে
চক্ষে লয়ে জল
মুঠির মাঝে শুকিয়ে আছে
একটি আঙুর ফল ।
কবি
আমি যে বেশ সুখে আছি
অন্তত নই দুঃখে কৃশ ,
সে কথাটা পদ্যে লিখতে
লাগে একটু বিসদৃশ ।
সেই কারণে গভীর ভাবে
খুঁজে খুঁজে গভীর চিতে
বেরিয়ে পড়ে গভীর ব্যথা
স্মৃতি কিম্বা বিস্মৃতিতে ।
কিন্তু সেটা এত সুদূর
এতই সেটা অধিক গভীর
আছে কি না আছে তাহার
প্রমাণ দিতে হয় না কবির ।
মুখের হাসি থাকে মুখে ,
দেহের পুষ্টি পোষে দেহ ,
প্রাণের ব্যথা কোথায় থাকে
জানে না সেই খবর কেহ ।
কাব্য প’ড়ে যেমন ভাব
কবি তেমন নয় গো ।
আঁধার ক’রে রাখে নি মুখ ,
দিবারাত্র ভাঙছে না বুক ,
গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব
হাস্যমুখেই বয় গো ।
ভালোবাসে ভদ্রসভায়
ভদ্র পোশাক পরতে অঙ্গ ,
ভালোবাসে ফুল্ল মুখে
কইতে কথা লোকের সঙ্গ ।
বন্ধু যখন ঠাট্টা করে
মরে না সে অর্থ খুঁজে ,
ঠিক যে কোথায় হাসতে হবে
একেক সময় দিব্যি বুঝে ।
সামনে যখন অন্ন থাকে
থাকে না সে অন্যমনে ,
সঙ্গীদলের সাড়া পেলে
রয় না বসে ঘরের কোণে ।
বন্ধুরা কয় ‘ লোকটা রসিক’ ,
কয় কি তারা মিথ্যামিথ্যি ?
শত্রুরা কয় ‘ লোকটা হাল্কা’ ,
কিছু কি তার নাইকো ভিত্তি ?
কাব্য দেখে যেমন ভাব
কবি তেমন নয় গো ।
চাঁদের পানে চক্ষু তুলে
রয় না পড়ে নদীর কূলে ,
গভীর দুঃখ ইত্যাদি সব
মনের সুখেই বয় গো ।
সুখে আছি লিখতে গেলে
লোকে বলে , ‘ প্রাণটা ক্ষুদ্র !
আশাটা এর নয়কো বিরাট ,
পিপাসা এর নয়কো রুদ্র । ‘
পাঠকদলে তুচ্ছ করে ,
অনেক কথা বলে কঠোর—
বলে , ‘ একটু হেসে – খেলেই
ভরে যায় এর মনের জঠর । ‘
কবিরে তাই ছন্দে বন্ধে
বানাতে হয় দুখের দলিল ।
মিথ্যা যদি হয় সে তবু
ফেলো পাঠক চোখের সলিল ।
তাহার পরে আশিস কোরো
রুদ্ধকণ্ঠে ক্ষুব্ধবুকে ,
কবি যেন আজন্মকাল
দুখের কাব্য লেখেন সুখে ।
কাব্য যেমন কবি যেন
তেমন নাহি হয় গো ।
বুদ্ধি যেন একটু থাকে ,
স্নানাহারের নিয়ম রাখে ,
সহজ লোকের মতোই যেন
সরল গদ্য কয় গো ।
কবির বয়স
ওরে কবি , সন্ধ্যা হয়ে এল ,
কেশে তোমার ধরেছে যে পাক ।
বসে বসে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে
শুনতেছ কি পরকালের ডাক ?
কবি কহে , ‘ সন্ধ্যা হল বটে ,
শুনছি বসে লয়ে শ্রান্ত দেহ ,
এ পারে ওই পল্লী হতে যদি
আজো হঠাৎ ডাকে আমায় কেহ ।
যদি হোথায় বকুলবনচ্ছায়ে
মিলন ঘটে তরুণ – তরুণীতে ,
দুটি আঁখির ‘পরে দুইটি আঁখি
মিলিতে চায় দুরন্ত সংগীতে—
কে তাহাদের মনের কথা লয়ে
বীণার তারে তুলবে প্রতিধ্বনি ,
আমি যদি ভবের কূলে বসে
পরকালের ভালো মন্দই গনি ।
‘ সন্ধ্যাতারা উঠে অস্তে গেল ,
চিতা নিবে এল নদীর ধারে ,
কৃষ্ণপক্ষে হলুদবর্ণ চাঁদ
দেখা দিল বনের একটি পারে ,
শৃগালসভা ডাকে ঊর্ধ্বরবে
পোড়ো বাড়ির শূন্য আঙিনাতে—
এমন কালে কোনো গৃহত্যাগী
হেথায় যদি জাগতে আসে রাতে ,
জোড় – হস্তে ঊর্ধ্ব তুলি মাথা
চেয়ে দেখে সপ্ত ঋষির পানে ,
প্রাণের কূলে আঘাত করে ধীরে
সুপ্তিসাগর শব্দবিহীন গানে—
ত্রিভুবনের গোপন কথাখানি
কে জাগিয়ে তুলবে তাহার মনে
আমি যদি আমার মুক্তি নিয়ে
যুক্তি করি আপন গৃহকোণে ?
‘ কেশে আমার পাক ধরেছে বটে ,
তাহার পানে নজর এত কেন ?
পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো
সবার আমি একবয়সী জেনো ।
ওষ্ঠে কারো সরল সাদা হাসি
কারো হাসি আঁখির কোণে কোণে
কারো অশ্রু উছলে পড়ে যায়
কারো অশ্রু শুকায় মনে মনে ,
কেউ বা থাকে ঘরের কোণে দোঁহে
জগৎ মাঝে কেউ বা হাঁকায় রথ ,
কেউ বা মরে একলা ঘরের শোকে
জনারণ্যে কেউ বা হারায় পথ ।
সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি ,
কখন শুনি পরকালের ডাক ?
সবার আমি সমান – বয়সী যে
চুলে আমার যত ধরুক পাক । ‘
কর্মফল
পরজন্ম সত্য হলে
কী ঘটে মোর সেটা জানি—
আবার আমায় টানবে ঘরে
বাংলাদেশের এ রাজধানী ।
গদ্য পদ্য লিখনু ফেঁদে ,
তারাই আমায় আনবে বেঁধে ,
অনেক লেখায় অনেক পাতক ,
সে মহাপাপ করবে মোচন—
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
ততদিনে দৈবে যদি
পক্ষপাতী পাঠক থাকে
কর্ণ হবে রক্তবর্ণ
এমনি কটু বলব তাকে ।
যে বইখানি পড়বে হাতে
দগ্ধ করব পাতে পাতে ,
আমার ভাগ্যে হব আমি
দ্বিতীয় এক ধূম্রলোচন—
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
বলব , ‘ এ – সব কী পুরাতন !
আগাগোড়া ঠেকছে চুরি ।
মনে হচ্ছে , আমিও এমন
লিখতে পারি ঝুড়ি ঝুড়ি । ‘
আরো যে – সব লিখব কথা
ভাবতে মনে বাজছে ব্যথা ,
পরজন্মের নিষ্ঠুরতায়
এ জন্মে হয় অনুশোচন—
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
তোমরা , যাঁদের বাক্য হয় না
আমার পক্ষে মুখরোচক
তোমরা যদি পুনর্জন্মে
হও পুনর্বার সমালোচক—
আমি আমায় পাড়ব গালি ,
তোমরা তখন ভাববে খালি
কলম ক’ষে ব’সে ব’সে
প্রতিবাদের প্রতি বচন ।
আমায় হয়তো করতে হবে
আমার লেখা সমালোচন ।
লিখব , ইনি কবিসভায়
হংসমধ্যে বকো যথা !
তুমি লিখবে , কোন্ পাষণ্ড
বলে এমন মিথ্যা কথা !
আমি তোমায় বলব—মূঢ় ,
তুমি আমায় বলবে—রূঢ় ,
তার পরে যা লেখালেখি
হবে না সে রুচিরোচন ।
তুমি লিখবে কড়া জবাব ,
আমি কড়া সমালোচন ।
কল্যাণী
বিরল তোমার ভবনখানি
পুষ্পকাননমাঝে ,
হে কল্যাণী নিত্য আছ
আপন গৃহকাজে ।
বাইরে তোমার আম্রশাখে
স্নিগ্ধরবে কোকিল ডাকে ,
ঘরে শিশুর কলধ্বনি
আকুল হর্ষভরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
প্রভাত আসে তোমার দ্বারে ,
পূজার সাজি ভরি ,
সন্ধ্যা আসে সন্ধ্যারতির
বরণডালা ধরি ।
সদা তোমার ঘরের মাঝে
নীরব একটি শঙ্খ বাজে ,
কাঁকন – দুটির মঙ্গলগীত
উঠে মধুর স্বরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
রূপসীরা তোমার পায়ে
রাখে পূজার থালা ,
বিদুষীরা তোমার গলায়
পরায় বরমালা !
ভালে তোমার আছে লেখা
পুণ্যধামের রশ্মিরেখা ,
সুধাস্নিগ্ধ হৃদয়খানি
হাসে চোখের ‘ পরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
তোমার নাহি শীত বসন্ত ,
জরা কি যৌবন—
সর্বঋতু সর্বকালে
তোমার সিংহাসন ।
নিবে নাকো প্রদীপ তব ,
পুষ্প তোমার নিত্য নব ,
অচলা শ্রী তোমায় ঘে রি
চির বিরাজ করে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
নদীর মতো এসেছিলে
গিরিশিখর হতে ,
নদীর মতো সাগর – পানে
চল অবাধ স্রোতে ।
একটি গৃহে পড়ছে লেখা
সেই প্রবাহের গভীর রেখা ,
দীপ্ত শিরে পুণ্যশীতল
তীর্থসলিল ঝরে ।
সর্বশেষের গানটি আমার
আছে তোমার তরে ।
তোমার শান্তি পান্থজনে
ডাকে গৃহের পানে ,
তোমার প্রীতি ছিন্ন জীবন
গেঁথে গেঁথে আনে ।
আমার কাব্যকুঞ্জবনে
কত অধীর সমীরণে
কত যে ফুল কত আকুল
মুকুল খসে পড়ে—
সর্বশেষের শ্রেষ্ঠ যে গান
আছে তোমার তরে ।
কূলে
আমাদের এই নদীর কূলে
নাইকো স্নানের ঘাট ,
ধূধূ করে মাঠ ।
ভাঙা পাড়ির গায়ে শুধু
শালিখ লাখে লাখে
খোপের মধ্যে থাকে ।
সকালবেলা অরুণ আলো
পড়ে জলের ‘পরে ,
নৌকা চলে দু – একখানি
অলস বায়ু – ভরে ।
আঘাটাতে বসে রইলে ,
বেলা যাচ্ছে বয়ে—
দাও গো মোরে কয়ে
ভাঙন – ধরা কূলে তোমার
আর কিছু কি চাই ?
সে কহিল , ভাই ,
না ই , না ই , নাই গো আমার
কিছুতে কাজ নাই ।
আমাদের এ নদীর কূলে
ভাঙা পাড়ির তল ,
ধেনু খায় না জল ।
দূর গ্রামের দু – একটি ছাগ
বেড়ায় চরি চরি
সারা দিবস ধরি ।
জলের ‘পরে বেঁকে – পড়া
খেজুর – শাখা হতে
ক্ষণে ক্ষণে মাছরাঙাটি
ঝাঁপিয়ে পড়ে স্রোতে ।
ঘাসের ‘পরে অশথতলে
যাচ্ছে বেলা বয়ে—
দাও আমারে কয়ে
আজকে এমন বিজন প্রাতে
আর কারে কি চাই ?
সে কহিল , ভাই ,
না ই , না ই , নাই গো আমার
কারেও কাজ নাই ।
কৃতার্থ
এখনো ভাঙে নি ভাঙে নি মেলা
নদীর তীরের মেলা ।
এ শুধু আষাঢ় – মেঘের আঁধার ,
এখনো রয়েছে বেলা ।
ভেবেছিনু দিন মিছে গোঙালেম ,
যাহা ছিল বুঝি সবই খোয়ালেম ,
আছে আছে তবু , আছে ভাই , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে আজ ঘটে নাই
কেবলি ফাঁকি ।
বেচিবার যাহা বেচা হয়ে গেছে
কিনিবার যাহা কেনা ,
আমি তো চুকিয়ে দিয়েছি নিয়েছি
সকল পাওনা দেনা ।
দিন না ফুরাতে ফিরিব এখন—
প্রহরী চাহিছ পসরার পণ ?
ভয় নাই ওগো , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
কেবলি ফাঁকি ।
কখন বাতাস মাতিয়া আবার
মাথায় আকাশ ভাঙে !
কখন সহসা নামিবে বাদল ,
তুফান উঠিবে গাঙে !
তাই ছুটাছুটি চলিয়াছি ধেয়ে—
পারানির কড়ি চাহ তুমি নেয়ে ?
কিসের ভাবনা , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
কেবলি ফাঁকি ।
ধান – খেত বেয়ে বাঁকা পথখানি ,
গিয়েছে গ্রামের পারে ।
বৃষ্টি আসিতে দাঁড়ায়েছিলেম
নিরালা কুটিরদ্বারে ।
থামিল বাদল , চলিনু এবার—
হে দোকানি , চাও মূল্য তোমার ?
ভয় নাই ভাই , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
সকলি ফাঁকি ।
পথের প্রান্তে বটের তলায়
বসে আছ এইখানে—
হায় গো ভিখারি , চাহিছ কাতরে
আমারো মুখের পানে !
ভাবিতেছ মনে বেচা – কেনা সেরে
কত লাভ করে চলিয়াছে কে রে !
আছে আছে বটে , আছে ভাই , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
সকলি ফাঁকি ।
আঁধার রজনী , বিজন এ পথ ,
জোনাকি চমকে গাছে ।
কে তুমি আমার সঙ্গ ধরেছ ,
নীরবে চলেছ পাছে ?
এ ক’টি কড়ির মিছে ভার বওয়া ,
তোমাদের প্রথা কেড়েকুড়ে লওয়া—
হবে না নিরাশ , আছে আছে , কিছু
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
কেবলি ফাঁকি ।
নিশি দু – পহর , পঁহুছিনু ঘর
দু – হাত রিক্ত করি ,
তুমি আছ একা সজলনয়নে
দাঁড়ায়ে দুয়ার ধরি ।
চোখে ঘুম নাই , কথা নাই মুখে ,
ভীতপাখিসম এলে মোর বুকে—
আছে আছে বিধি , এখনো অনেক
রয়েছে বাকি ।
আমারো ভাগ্যে ঘটে নি ঘটে নি
সকলি ফাঁকি ।
কৃষ্ণকলি
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ,
কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক ।
মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ – চোখ ।
ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে ,
মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে
ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই ,
শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে
কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই ।
আকাশ – পানে হানি যুগল ভুরু
শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
পুবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে ,
ধানের খেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ ।
আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা ,
মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ ।
আমার পানে দেখলে কিনা চেয়ে
আমিই জানি আর জানে সে মেয়ে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
এমনি করে কালো কাজল মেঘ
জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে ।
এমনি করে কালো কোমল ছায়া
আষাঢ় মাসে নামে তমাল – বনে ।
এমনি করে শ্রাবণ – রজনীতে
হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি ,
আর যা বলে বলুক অন্য লোক ।
দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ – চোখ ।
মাথার ‘ পরে দেয় নি তুলে বাস ,
লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ ।
কালো ? তা সে যতই কালো হোক
দেখেছি তার কালো হরিণ – চোখ ।
ক্ষণেক দেখা
চলেছিলে পাড়ার পথে
কলস লয়ে কাঁখে ,
একটুখানি ফিরে কেন
দেখলে ঘোমটা – ফাঁকে ?
ওইটুকু যে চাওয়া
দিল একটু হাওয়া
কোথা তোমার ও পার থেকে
আমার এ পার -‘ পরে ।
অতি দূরের দেখাদেখি
অতি ক্ষণেক – তরে ।
আমি শুধু দেখেছিলেম
তোমার দুটি আঁখি—
ঘোমটা – ফাঁদা আঁধার – মাঝে
ত্রস্ত দুটি পাখি ।
তুমি এক নিমিখে
চেয়ে আমার দিকে
পথের একটি পথিকেরে
দেখলে কতখানি
একটুমাত্র কৌতূহলে
একটি দৃষ্টি হানি ?
যেমন ঢাকা ছিলে তুমি
তেমনি রইলে ঢাকা ,
তোমার কাছে যেমন ছিনু
তেমনি রইনু ফাঁকা !
তবে কিসের তরে
থামলে লীলাভরে
যেতে যেতে পাড়ার পথে
কলস লয়ে কাঁখে ?
একটুখানি ফিরে কেন
দেখলে ঘোমটা – ফাঁকে ?
ক্ষতিপূরণ
তোমার তরে সবাই মোরে
করছে দোষী
হে প্রেয়সী !
বলছে—কবি তোমার ছবি
আঁকছে গানে ,
প্রণয়গীতি গাচ্ছে নিতি
তোমার কানে ,
নেশায় মেতে ছন্দে গেঁথে
তুচ্ছ কথা
ঢাকছে শেষে বাংলাদেশে
উচ্চ কথা ।
তোমার তরে সবাই মোরে
করছে দোষী
হে প্রেয়সী !
সে কলঙ্ক নিন্দাপঙ্ক
তিলক টানি
এলেম রানী !
ফেলুক মুছি হাস্যশুচি
তোমার লোচন
বিশ্বসুদ্ধ যতেক ক্রুদ্ধ
সমালোচন ।
অনুরক্ত তব ভক্ত
নিন্দিতেরে
করো রক্ষে শীতল বক্ষে
বাহুর ঘেরে ।
তাই কলঙ্কে নিন্দাপঙ্কে
তিলক টানি
এলেম রানী ।
আমি নাবব মহাকাব্য—
সংরচনে
ছিল মনে—
ঠেকল যখন তোমার কাঁকন—
কিংকিণীতে ,
কল্পনাটি গেল ফাটি
হাজার গীতে ।
মহাকাব্য সেই অভাব্য
দুর্ঘটনায়
পায়ের কাছে ছড়িয়ে আছে
কণায় কণায় ।
আমি নাবব মহাকাব্য—
সংরচনে
ছিল মনে ।
হায় রে কোথা যুদ্ধকথা
হৈল গত
স্বপ্নমত !
পুরাণচিত্র বীরচরিত্র
অষ্ট সর্গ
কৈল খণ্ড তোমার চণ্ড
নয়ন – খড়্গ ।
রইল মাত্র দিবারাত্র
প্রেমের প্রলাপ ,
দিলেম ফেলে ভাবীকেলে
কীর্তিকলাপ ।
হায় রে কোথা যুদ্ধকথা
হৈল গত
স্বপ্নমত !
সেসব – ক্ষতি – পূরণ প্রতি
দৃষ্টি রাখি
হরিণ – আঁখি !
লোকের মনে সিংহাসনে
নাইকো দাবি—
তোমার মনোগৃহের কোনো
দাও তো চাবি ।
মরার পরে চাই নে ওরে
অমর হতে ,
অমর হব আঁখির তব
সুধার স্রোতে ।
খ্যাতির ক্ষতি – পূরণ প্রতি
দৃষ্টি রাখি
হরিণ – আঁখি !
খেলা
মনে পড়ে সেই আষাঢ়ে
ছেলেবেলা ,
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা ।
বৃষ্টি পড়ে দিবস – রাতি ,
ছিল না কেউ খেলার সাথি ,
একলা বসে পেতেছিলেম
সাধের খেলা ।
নালার জলে ভাসিয়েছিলেম
পাতার ভেলা ।
হঠাৎ হল দ্বিগুণ আঁধার
ঝড়ের মেঘে ,
হঠাৎ বৃষ্টি নামল কখন
দ্বিগুণ বেগে ।
ঘোলা জলের স্রোতের ধারা
ছুটে এল পাগল – পারা
পাতার ভেলা ডুবল নালার
তুফান লেগে—
হঠাৎ বৃষ্টি নামল যখন
দ্বিগুণ বেগে ।
সেদিন আমি ভেবেছিলেম
মনে মনে ,
হতবিধির যত বিবাদ
আমার সনে ।
ঝড় এল যে আচম্বিতে
পাতার ভেলা ডুবিয়ে দিতে ,
আর কিছু তার ছিল না কাজ
ত্রিভুবনে ।
হতবিধির যত বিবাদ
আমার সনে ।
আজ আষাঢ়ে একলা ঘরে
কাটল বেলা ,
ভাবতেছিলেম এত দিনের
নানান খেলা ।
ভাগ্য -‘ পরে করিয়া রোষ
দিতেছিলেম বিধিরে দোষ—
পড়ল মনে , নালার জলে
পাতার ভেলা ।
ভাবতেছিলেম এত দিনের
নানান খেলা ।
চিরায়মানা
যেমন আছ তেমনি এসো ,
আর কোরো না সাজ ।
বেণী নাহয় এলিয়ে রবে ,
সিঁথে নাহয় বাঁকা হবে ,
নাই বা হল পত্রলেখায়
সকল কারুকাজ ।
কাঁচল যদি শিথিল থাকে
নাইকো তাহে লাজ ।
যেমন আছ তেমনি এসো ,
আর কোরো না সাজ ।
এসো দ্রুত চরণ দুটি
তৃণের ‘ পরে ফেলে ।
ভয় কোরো না , অলক্তরাগ
মোছে যদি মুছিয়া যাক—
নূপুর যদি খুলে পড়ে
নাহয় রেখে এলে ।
খেদ কোরো না মালা হতে
মুক্তা খ’সে গেলে ।
এসো দ্রুত চরণ দুটি
তৃণের ‘ পরে ফেলে ।
হেরো গো , ওই আঁধার হল ,
আকাশ ঢাকে মেঘে ।
ও পার হতে দলে দলে
বকের শ্রেণী উড়ে চলে ,
থেকে থেকে শূন্য মাঠে
বাতাস ওঠে জেগে ।
ওই রে গ্রামের গোষ্ঠ – মুখে
ধেনুরা ধায় বেগে ।
হেরো গো , ওই আঁধার হল ,
আকাশ ঢাকে মেঘে ।
প্রদীপখানি নিবে যাবে ,
মিথ্যা কেন জ্বাল ?
কে দেখতে পায় চোখের কাছে
কাজল আছে কি না আছে ?
তরল তব সজল দিঠি
মেঘের চেয়ে কালো ।
আঁখির পাতা যেমন আছে
এমনি থাকা ভালো ।
কাজল দিতে প্রদীপখানি
মিথ্যা কেন জ্বাল ?
এসো হেসে সহজ বেশে
আর কোরো না সাজ ।
গাঁথা যদি না হয় মালা
ক্ষতি তাহে নাই গো বালা ,
ভূষণ যদি না হয় সারা
ভূষণে নাই কাজ ।
মেঘে মগন পূর্ব – গগন
বেলা নাই রে আজ—
এসো হেসে সহজ বেশে ,
নাই বা হল সাজ ।
জন্মান্তর
আমি ছেড়েই দিতে রাজি আছি
সুসভ্যতার আলোক ,
আমি চাই না হতে নববঙ্গ
নব যুগের চালক ।
আমি নাই বা গেলেম বিলাত ,
নাই বা পেলেম রাজার খিলাত ,
যদি পরজন্মে পাই রে হতে
ব্রজের রাখাল বালক
তবে নিবিয়ে দেব নিজের ঘরে
সুসভ্যতার আলোক ।
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে ,
যারা গুঞ্জা ফুলের মালা গেঁথে
পরে পরায় গলে ,
যারা বৃন্দাবনের বনে
সদাই শ্যামের বাঁশি শোনে ,
যারা যমুনাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে
শীতল কালো জলে—
যারা নিত্য কেবল ধেনু চরায়
বংশীবটের তলে ।
‘ ওরে বিহান হল , জাগো রে ভাই’
ডাকে পরস্পরে ।
ওরে ওই – যে দধি – মন্থ – ধ্বনি
উঠল ঘরে ঘরে ।
হেরো মাঠের পথে ধেনু
চলে উড়িয়ে গো – খুর – রেণু ,
হেরো আঙিনাতে ব্রজের বধূ
দুগ্ধ দোহন করে ।
‘ ওরে বিহান হল , জাগো রে ভাই’
ডাকে পরস্পরে ।
ওরে শাঙন – মেঘের ছায়া পড়ে
কালো তমাল – মূলে ,
ওরে এপার ওপার আঁধার হল
কালিন্দীরই কূলে ।
ঘাটে গোপাঙ্গনা ডরে
কাঁপে খেয়া তরীর ‘পরে ,
হেরো কুঞ্জবনে নাচে ময়ূর
কলাপখানি তুলে ।
ওরে শাঙন – মেঘের ছায়া পড়ে
কালো তমাল – মূলে ।
মোরা নবনবীন ফাগুন – রাতে
নীল নদীর তীরে
কোথা যাব চলি অশোকবনে
শিখিপুচ্ছ শিরে ।
যবে দোলার ফুলরশি
দিবে নীপশাখায় কষি
যবে দখিন – বায়ে বাঁশির ধ্বনি
উঠবে আকাশ ঘিরে
মোরা রাখাল মিলে করব মেলা
নীল নদীর তীরে ।
আমি হব না ভাই নববঙ্গে
নবযুগের চালক ,
আমি জ্বালাব না আঁধার দেশে
সুসভ্যতার আলোক ।
যদি ননি – ছানার গাঁয়ে
কোথাও অশোক – নীপের ছায়ে
আমি কোনো জন্মে পারি হতে
ব্রজের গোপবালক
তবে চাই না হতে নববঙ্গ
নবযুগের চালক ।
তথাপি
তুমি যদি আমায় ভালো না বাস
রাগ করি যে এমন আমার সাধ্য নাই—
এমন কথার দেব নাকো আভাসও ,
আমারো মন তোমার পায়ে বাধ্য নাই ।
নাইকো আমার কোনো গরব – গরিমা—
যেমন করেই কর আমায় বঞ্চিত
তুমি না রও তোমার সোনার প্রতিমা
রবে আমার মনের মধ্যে সঞ্চিত ।
কিন্তু তবু তুমিই থাকো , সমস্যা যাক ঘুচি ।
স্মৃতির চেয়ে আসলটিতেই আমার অভিরুচি ।
দৈবে স্মৃতি হারিয়ে যাওয়া শক্ত নয়
সেটা কিন্তু বলে রাখাই সংগত ।
তাহা ছাড়া যারা তোমার ভক্ত নয়
নিন্দা তারা করতে পারে অন্তত ।
তাহা ছাড়া চিরদিন কি কষ্টে যায় ?
আমারো এই অশ্রু হবে মার্জনা ।
ভাগ্যে যদি একটি কেহ নষ্টে যায়
সান্ত্বনার্থে হয়তো পাব চার জনা ।
কিন্তু তবু তুমিই থাকো , সমস্যা যাক ঘুচি ।
চারের চেয়ে একের ‘পরেই আমার অভিরুচি ।
দুই তীরে
আমি ভালোবাসি আমার
নদীর বালুচর ,
শরৎকালে যে নির্জনে
চকাচকীর ঘর ।
যেথায় ফুটে কাশ
তটের চারি পাশ ,
শীতের দিনে বিদেশী সব
হাঁসের বসবাস ।
কচ্ছপেরা ধীরে
রৌদ্র পোহায় তীরে ,
দু – একখানি জেলের ডিঙি
সন্ধেবেলায় ভিড়ে ।
আমি ভালোবাসি আমার
নদীর বালুচর ,
শরৎকালে যে নির্জনে
চকাচকীর ঘর ।
তুমি ভালোবাস তোমার
ওই ও পারের বন ,
যেথায় গাঁথা ঘনচ্ছায়া
পাতার আচ্ছাদন ।
যেথায় বাঁকা গলি
নদীতে যায় চলি ,
দুই ধারে তার বেণুবনের
শাখায় গলাগলি ।
সকাল – সন্ধেবেলা
ঘাটে বধূর মেলা ,
ছেলের দলে ঘাটের জলে
ভাসে ভাসায় ভেলা ।
তুমি ভালোবাস তোমার
ওই ও পারের বন ,
যেথায় গাঁথা ঘনচ্ছায়া
পাতার আচ্ছাদন ।
তোমার আমার মাঝখানেতে
একটি বহে নদী ,
দুই তটেরে একই গান সে
শোনায় নিরবধি ।
আমি শুনি শুয়ে
বিজন বালু – ভুঁয়ে ,
তুমি শোন কাঁখের কলস
ঘাটের ‘ পরে থুয়ে ।
তুমি তাহার গানে
বোঝ একটা মানে ,
আমার কূলে আরেক অর্থ
ঠেকে আমার কানে ।
তোমার আমার মাঝখানেতে
একটি বহে নদী ,
দুই তটেরে একই গান সে
শোনায় নিরবধি ।
দুই বোন
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
দেখেছি কি তারা পথিক কোথায়
দাঁড়িয়ে পথের প্রান্তে ?
ছায়ায় নিবিড় বনে
যে আছে আঁধার কোণে
তারে যে কখন কটাক্ষে চায়
কিছু তো পারি নে জানতে ।
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
দুটি বোন তারা করে কানাকানি
কী না জানি জল্পনা !
গুঞ্জনধ্বনি দূর হতে শুনি ,
কী গোপন মন্ত্রণা !
আসে যবে এইখানে
চায় দোঁহে দোঁহাপানে ,
কাহা র ও মনের কোনো কথা তারা
করেছে কি কল্পনা ?
দুটি বোন তারা করে কানাকানি
কী না জানি জল্পনা !
এইখানে এসে ঘট হতে কেন
জল উঠে উচ্ছলি ?
চপল চক্ষে তরল তারকা
কেন উঠে উজ্জ্বলি ?
যেতে যেতে নদীপথে
জেনেছ কি কোনোমতে
কাছে কোথা এক আকুল হৃদয়
দুলে উঠে চঞ্চলি ?
এইখানে এসে ঘট হতে জল
কেন উঠে উচ্ছলি ?
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
বটের ছায়ায় কেহ কি তাদের
পড়েছে চোখের প্রান্তে ?
কৌতুকে কেন ধায়
সচকিত দ্রুত পায় ?
কলসে কাঁকন ঝলকি ঝনকি
ভোলায় রে দিক্ভ্রান্তে ।
দুটি বোন তারা হেসে যায় কেন
যায় যবে জল আনতে ?
দুর্দিন
এতদিন পরে প্রভাতে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
ঝড় হয়ে গেছে কাল রজনীতে
রজনীগন্ধাবনে ।
কাননের পথ ভেসে গেছে জলে ,
বেড়াগুলি ভেঙে পড়েছে ভূতলে ,
নব ফুটন্ত ফুলের দণ্ড
লুটায় তৃণের সনে ।
এতদিন পরে তুমি যে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
হেরো গো আজিও প্রভাত অরুণ
মেঘের আড়ালে হারা ,
রহি রহি আজো ঘনায়ে ঘনায়ে
ঝরিছে বাদলধারা ।
মাতাল বাতাস আজো থাকি থাকি
চেতিয়া চেতিয়া উঠে ডাকি ডাকি ,
জড়িত পাতায় সিক্ত শাখায়
দোয়েল দেয় না সাড়া ।
আজিও আঁধার প্রভাতে অরুণ
মেঘের আড়ালে হারা ।
এ ভরা বাদলে আর্দ্র আঁচলে
একেলা এসেছ আজি ,
এনেছ বহিয়া রিক্ত তোমার
পূজার ফুলের সাজি ।
এত মধুমাস গেছে বার বার—
ফুলের অভাব ঘটে নি তোমার ,
বন আলো করি ফুটেছিল যবে
রজনীগন্ধারাজি ।
এ ভরা বাদলে আর্দ্র আঁচলে
একেলা এসেছ আজি ।
আজি তরুতলে দাঁড়ায়েছে জল ,
কোথা বসিবার ঠাঁই ?
কাল যাহা ছিল সে ছায়া সে আলো
সে গন্ধগান নাই ।
তবু ক্ষণকাল রহ ত্বরাহীন ,
ছিন্ন কুসুম পঙ্কে মলিন
ভূতল হইতে যতনে তুলিয়া
ধুয়ে ধুয়ে দিব তাই ।
আজি তরুতলে দাঁড়ায়েছে জল ,
কোথা বসিবার ঠাঁই ?
এত দিন পরে তুমি যে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
প্রভাত আজিকে অরুণবিহীন ,
কুসুম লুটায় বনে ।
যাহা আছে লও প্রসন্ন করে ,
ও সাজি তোমার ভরে কি না ভরে
ওই যে আবার নামে বারিধার
ঝরঝর বরষনে ।
এতদিন পরে তুমি যে এসেছ
কী জানি কী ভাবি মনে ।
নববর্ষা
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে , হৃদয়
নাচে রে ।
শত বরনের ভাব – উচ্ছ্বাস
কলাপের মতো করেছে বিকাশ ,
আকুল পরান আকাশে চাহিয়া
উল্লাসে কারে যাচে রে ।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে !
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে , গরজে
গগনে ।
ধেয়ে চলে আসে বাদলের ধারা ,
নবীন ধান্য দুলে দুলে সারা ,
কুলায়ে কাঁপিছে কাতর কপোত ,
দাদুরি ডাকিছে সঘনে ।
গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে ।
নয়নে আমার সজল মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে , নয়নে
লেগেছে ।
নবতৃণদলে ঘনবনছায়ে
হরষ আমার দিয়েছি বিছায়ে ,
পুলকিত নীপনিকুঞ্জ আজি
বিকশিত প্রাণ জেগেছে ।
নয়নে সজল স্নিগ্ধ মেঘের
নীল অঞ্জন লেগেছে ।
ওগো , প্রাসাদের শিখরে আজিকে
কে দিয়েছে কেশ এলায়ে , কবরী
এলায়ে ?
ওগো , নবঘন নীলবাসখানি
বুকের উপরে কে লয়েছে টানি ?
তড়িৎ – শিখার চকিত আলোকে
ওগো , কে ফিরিছে খেলায়ে ?
ওগো , প্রাসাদের শিখরে আজিকে
কে দিয়েছে কেশ এলায়ে ?
ওগো , নদীকূলে তীরতৃণতলে
কে ব’সে অমল বসনে , শ্যামল
বসনে ?
সুদূর গগনে কাহারে সে চায় ?
ঘাট ছেড়ে ঘট কোথা ভেসে যায় ?
নবমালতীর কচি দলগুলি
আনমনে কাটে দশনে ।
ওগো , নদীকূলে তীরতৃণতলে
কে ব ‘ সে শ্যামল বসনে ?
ওগো , নির্জনে বকুল শাখায়
দোলায় কে আজি দুলিছে , দোদুল
দুলিছে ?
ঝরকে ঝরকে ঝরিছে বকুল ,
আঁচল আকাশে হতেছে আকুল ,
উড়িয়া অলক ঢাকিছে পলক—
কবরী খসিয়া খুলিছে ।
ওগো , নির্জনে বকুলশাখায়
দোলায় কে আজি দুলিছে ?
বিকচকেতকী তটভূমি -‘ পরে
কে বেঁধেছে তার তরণী , তরুণ
তরণী ?
রাশি রাশি তুলি শৈবালদল
ভরিয়া লয়েছে লোল অঞ্চল ,
বাদলরাগিণী সজলনয়নে
গাহিছে পরানহরণী ।
বিকচকেতকী তটভূমি -‘ পরে
বেঁধেছে তরুণ তরণী ।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে , হৃদয়
নাচে রে ।
ঝরে ঘনধারা নবপল্লবে ,
কাঁপিছে কানন ঝিল্লির রবে ,
তীর ছাপি নদী কলকল্লোলে
এল পল্লীর কাছে রে ।
হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে
ময়ূরের মতো নাচে রে ।
নষ্ট স্বপ্ন
কালকে রাতে মেঘের গরজনে
রিমিঝিমি – বাদল – বরিষনে
ভাবিতেছিলাম একা একা—
স্বপ্ন যদি যায় রে দেখা
আসে যেন তাহার মূর্তি ধ’রে
বাদলা রাতে আধেক ঘুমঘোরে ।
মাঠে মাঠে বাতাস ফিরে মাতি ,
বৃথা স্বপ্নে কাটল সারা রাতি ।
হায় রে , সত্য কঠিন ভারী ,
ইচ্ছামত গড়তে নারি—
স্বপ্ন সেও চলে আপন মতে ,
আমি চলি আমার শূন্য পথে ।
কালকে ছিল এমন ঘন রাত ,
আকুল ধারে এমন বারিপাত ,
মিথ্যা যদি মধুর রূপে
আসত কাছে চুপে চুপে
তাহা হলে কাহার হত ক্ষতি —
স্বপ্ন যদি ধরত সে মুরতি ?
পথে
গাঁয়ের পথে চলেছিলেম
অকারণে ,
বাতাস বহে বিকালবেলা
বেণুবনে ।
ছায়া তখন আলোর ফাঁকে
লতার মতন জড়িয়ে থাকে ,
একা একা কোকিল ডাকে
নিজমনে ।
আমি কোথায় চলেছিলেম
অকারণে ।
জলের ধারে কুটিরখানি
পাতা – ঢাকা ,
দ্বারের ‘পরে নুয়ে পড়ে
নিম্বশাখা ।
ওই যে শুনি মাঝে মাঝে
না জানি কোন্ নিত্যকাজে
কোথায় দুটি কাঁকন বাজে
গৃহকোণে ।
যেতে যেতে এলেম হেথা
অকারণে ।
দিঘির জলে ঝলক ঝলে
মানিক হীরা ,
সর্ষেখেতে উঠছে মেতে
মৌমাছিরা ।
এ পথ গেছে কত গাঁয়ে
কত গাছের ছায়ে ছায়ে
কত মাঠের গায়ে গায়ে
কত বনে ।
আমি শুধু হেথায় এলেম
অকারণে ।
আরেক দিন সে ফাগুন মাসে
বহু আগে
চলেছিলেম এই পথে সেই
মনে জাগে ।
আমের বোলের গন্ধে অবশ
বাতাস ছিল উদাস অলস ,
ঘাটের শানে বাজছে কলস
ক্ষণে ক্ষণে ।
সে – সব কথা ভাবছি বসে
অকারণে ।
দীর্ঘ হয়ে পড়ছে পথে
বাঁকা ছায়া ,
গোষ্ঠঘরে ফিরছে ধেনু
শ্রান্তকায়া ।
গোধূলিতে খেতের ‘পরে
ধূসর আলো ধূ ধূ করে ,
বসে আছে খেয়ার তরে
পান্থজনে ।
আবার ধীরে চলছি ফিরে
অকারণে ।
পরামর্শ
সূর্য গেল অস্তপারে—
লাগল গ্রামের ঘাটে
আমার জীর্ণ তরী ।
শেষ বসন্তের সন্ধ্যা – হাওয়া
শস্যশূন্য মাঠে
উঠল হাহা করি ।
আর কি হবে নূতন যাত্রা
নূতন রাণীর দেশে
নূতন সাজে সেজে ?
এবার যদি বাতাস উঠে
তুফান জাগে শেষে ,
ফিরে আসবি নে যে ।
অনেক বার তো হাল ভেঙেছে ,
পাল গিয়েছে ছিঁড়ে
ওরে দুঃসাহসী ।
সিন্ধুপানে গেছিস ভেসে
অকূল কালো নীরে
ছিন্ন – রশারশি ।
এখন কি আর আছে সে বল ?
বুকের তলা তোর
ভরে উঠছে জলে ।
অশ্রু সেঁচে চলবি কত—
আপন ভারে ভোর
তলিয়ে যাবি তলে ।
এবার তবে ক্ষান্ত হ রে
ওরে শ্রান্ত তরী ,
রাখ্ রে আনাগোনা ।
বর্ষশেষের বাঁশি বাজে
সন্ধ্যা – গগন ভরি ,
ওই যেতেছে শোনা ।
এবার ঘুমো কূলের কোলে
বটের ছায়াতলে
ঘাটের পাশে রহি ,
ঘটের ঘায়ে যেটুকু ঢেউ
উঠে তটের জলে
তারি আঘাত সহি ।
ইচ্ছা যদি করিস তবে
এ পার হতে পারে
যাস রে খেয়া বেয়ে ।
আনবে বহি গ্রামের বোঝা
ক্ষুদ্র ভারে ভারে
পাড়ার ছেলেমেয়ে ।
ও পারেতে ধানের খোলা
এই পারেতে হাট ,
মাঝে শীর্ণ নদী—
সন্ধ্যা সকাল করবি শুধু
এ – ঘাট ও – ঘাট
ইচ্ছা করিস যদি ।
হায় রে মিছে প্রবোধ দেওয়া ,
অবোধ তরী মম
আবার যাবে ভেসে ।
কর্ণ ধরে বসেছে তার
যমদূতের সম
স্বভাব সর্বনেশে ।
ঝড়ের নেশা ঢেউয়ের নেশা
ছাড়বে নাকো আর ,
হায় রে মরণলুভী !
ঘাটে সে কি রইবে বাঁধা ,
অদৃষ্টে যাহার
আছে নৌকাডুবি !
প্রতিজ্ঞা
আমি হব না তাপস , হব না , হব না ,
যেমনি বলুন যিনি ।
আমি হব না তাপস নিশ্চয় যদি
না মেলে তপস্বিনী ।
আমি করেছি কঠিন পণ
যদি না মিলে বকুলবন ,
যদি মনের মতন মন
না পাই জিনি ,
তবে হব না তাপস , হব না , যদি না
পাই সে তপস্বিনী ।
আমি ত্যজিব না ঘর , হব না বাহির
উদাসীন সন্ন্যাসী ,
যদি ঘরের বাহিরে না হাসে কেহই
ভুবন – ভুলানো হাসি ।
যদি না উড়ে নীলাঞ্চল
মধুর বাতাসে বিচঞ্চল ,
যদি না বাজে কাঁকন মল
রিনিক – ঝিনি—
আমি হব না তাপস , হব না , যদি না
পাই গো তপস্বিনী ।
আমি হব না তাপস , তোমার শপথ ,
যদি সে তপের বলে
কোনো নূতন ভুবন না পারি গড়িতে
নূতন হৃদয় – তলে ।
যদি জাগায়ে বীণার তার
কারো টুটিয়া মরম – দ্বার ,
কোনো নূতন আঁখির ঠার
না লই চিনি
আমি হব না তাপস , হব না , হব না ,
না পেলে তপস্বিনী ।
বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ
কোন্ বাণিজ্যে নিবাস তোমার
কহো আমায় ধনী ,
তাহা হলে সেই বাণিজ্যের
করব মহাজনি ।
দুয়ার জুড়ে কাঙাল বেশে
ছায়ার মতো চরণদেশে
কঠিন তব নূপুর ঘেঁষে
আর বসে না রইব—
এটা আমি স্থির বুঝেছি
ভিক্ষা নৈব নৈব ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কার তো পাবই ।
সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি
বসিয়ে হাজার দাঁড়ি
কোন্ নগর যাব , দিয়ে
কোন্ সাগরে পাড়ি ।
কোন্ তারকা লক্ষ্য করি ,
কূল – কিনারা পরিহরি ,
কোন্ দিকে যে বাইব তরী
অকূল কালো নীরে—
মরব না আর ব্যর্থ আশায়
বালুমরুর তীরে ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমার যদি না পাই , তবু
আর কার তো পাবই ।
সাগর উঠে তরঙ্গিয়া ,
বাতাস বহে বেগে ,
সূর্য যেথায় অস্তে নামে
ঝিলিক মারে মেঘে ।
দক্ষিণে চাই , উত্তরে চাই—
ফেনায় ফেনা , আর কিছু নাই—
যদি কোথাও কূল নাহি পাই
তল পাব তো তবু ।
ভিটার কোণে হতাশমনে
রইব না আর কভু ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কারে তো পাবই ।
নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ
প্রবাল দিয়ে ঘেরা ,
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে
সাগর – বিহঙ্গরা ।
নারিকেলের শাখে শাখে
ঝোড়ো বাতাস কেবল ডাকে ,
ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে
বইছে নগনদী—
সোনার রেণু আনব ভরি
সেথায় নামি যদি ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কারে তো পাবই ।
অকূল – মাঝে ভাসিয়ে তরী
যাচ্ছি অজানায়
আমি শুধু একলা নেয়ে
আমার শূন্য নায় ।
নব নব পবনভরে
যাব দ্বীপে দ্বীপান্তরে ,
নেব তরী পূর্ণ করে
অপূর্ব ধন যত ।
ভিখারি তোর ফিরবে যখন
ফিরবে রাজার মতো ।
যাবই আমি যাবই , ওগো ,
বাণিজ্যেতে যাবই ।
তোমায় যদি না পাই , তবু
আর কারে তো পাবই ।
বিদায়
তোমরা নিশি যাপন করো ,
এখনো রাত রয়েছে ভাই ,
আমায় কিন্তু বিদায় দেহো—
ঘুমোতে যাই , ঘুমোতে যাই ।
মাথার দিব্য , উঠো না কেউ
আগ বাড়িয়ে দিতে আমায়—
চলছে যেমন চলুক তেমন ,
হঠাৎ যেন গান না থামায় ।
আমার যন্ত্রে একটি তন্ত্রী
একটু যেন বিকল বাজে ,
মনের মধ্যে শুনছি যেটা
হাতে সেটা আসছে না যে ।
একেবারে থামার আগে
সময় রেখে থামতে যে চাই—
আজকে কিছু শ্রান্ত আছি ,
ঘুমোতে যাই , ঘুমোতে যাই ।
আঁধার – আলোয় সাদায় – কালোয়
দিনটা ভালোই গেছে কাটি ,
তাহার জন্যে কারো সঙ্গে
নাইকো কোনো ঝগড়াঝাঁটি ।
মাঝে মাঝে ভেবেছিলুম
একটু – আধটু এটা – ওটা
বদল যদি পারত হতে
থাকত নাকো কোনো খোঁটা ।
বদল হলে কখন মনটা
হয়ে পড়ত ব্যতিব্যস্ত ,
এখন যেমন আছে আমার
সেইটে আবার চেয়ে বসত ।
তাই ভেবেছি দিনটা আমার
ভালোই গেছে , কিছু না চাই—
আজকে শুধু শ্রান্ত আছি ,
ঘুমোতে যাই , ঘুমোতে যাই ।
বিদায়রীতি
হায় গো রানী , বিদায়বাণী
এমনি করে শোনে ?
ছি ছি , ওই – যে হাসিখানি
কাঁপছে আঁখিকোণে !
এতই বারে বারে কি রে
মিথ্যা বিদায় নিয়েছি রে ,
ভাবছ তুমি মনে মনে
এ লোকটি নয় যাবার—
দ্বারের কাছে ঘুরে ঘুরে
ফিরে আসবে আবার ।
আমায় যদি শুধাও তবে
সত্য করেই বলি—
আমারো সেই সন্দেহ হয়
ফিরে আসব চলি ।
বসন্তদিন আবার আসে ,
পূর্ণিমা – রাত আবার হাসে ,
বকুল ফোটে রিক্ত শাখায়—
এরাও তো নয় যাবার ।
সহস্র বার বিদায় নিয়ে
এরাও ফেরে আবার ।
একটুখানি মোহ তবু
মনের মধ্যে রাখো ,
মিথ্যেটারে একেবারেই
জবাব দিয়ো নাকো ।
ভ্রমক্রমে ক্ষণেক – তরে
এনো গো জল আঁখির ‘পরে
আকুল স্বরে যখন কব
‘ সময় হল যাবার’ ।
তখন নাহয় হেসো , যখন
ফিরে আসব আবার ।
বিরহ
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই – পহর—
সূর্য তখন মাঝ – গগনে ,
রৌদ্র খরতর ।
ঘরের কর্ম সাঙ্গ করে
ছিলেম তখন একলা ঘরে ,
আপন – মনে বসে ছিলেম
বাতায়নের ‘পর ।
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই – পহর ।
চৈত্র মাসের নানা খেতের
নানা গন্ধ নিয়ে
আসতেছিল তপ্ত হাওয়া
মুক্ত দুয়ার দিয়ে ।
দুটি ঘুঘু সারাটা দিন
ডাকতেছিল শ্রান্তিবিহীন ,
একটি ভ্রমর ফিরতেছিল
কেবল গুন্গুনিয়ে
চৈত্র মাসের নানা খেতের
নানা বার্তা নিয়ে ।
তখন পথে লোক ছিল না ,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম ।
ঝাউশাখাতে উঠতেছিল
শব্দ অবিশ্রাম ।
আমি শুধু একলা প্রাণে
অতি সুদূর বাঁশির তানে
গেঁথেছিলেম আকাশ ভ’রে
একটি কাহার নাম ।
তখন পথে লোক ছিল না ,
ক্লান্ত কাতর গ্রাম ।
ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া ,
আমি ছিলেম জেগে—
আবাঁধা চুল উড়তে ছিল
উদাস হাওয়া লেগে ।
তটতরুর ছায়ার তলে
ঢেউ ছিল না নদীর জলে ,
তপ্ত আকাশ এলিয়ে ছিল
শুভ্র অলস মেঘে ।
ঘরে ঘরে দুয়ার দেওয়া ,
আমি ছিলেম জেগে ।
তুমি যখন চলে গেলে
তখন দুই – পহর ,
শুষ্ক পথে দগ্ধ মাঠে
রৌদ্র খরতর ।
নিবিড় – ছায়া বটের শাখে
কপোত দুটি কেবল ডাকে
একলা আমি বাতায়নে—
শূন্য শয়ন – ঘর ।
তুমি যখন গেলে তখন
বেলা দুই – পহর ।
বিলম্বিত
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
তখন ছিল দখিন হাওয়া
আধ – ঘুমো আধ – জাগা ,
তখন ছিল সর্ষে – খেতে
ফুলের আগুন লাগা ,
তখন আমি মালা গেঁথে
পদ্মপাতায় ঢেকে
পথে বাহির হয়েছিলেম
রুদ্ধ কুটির থেকে ।
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
বসন্তের সে মালা
আজ কি তেমন গন্ধ দেবে
নবীন – সুধা – ঢালা ?
আজকে বহে পুবে বাতাস ,
মেঘে আকাশ জুড়ে—
ধানের খেতে ঢেউ উঠেছে
নব – নবাঙ্কুরে ।
হাওয়ায় হাওয়ায় নাইকো রে হায়
হালকা সে হিল্লোল ,
নাই বাগানে হাস্যে গানে
পাগল গণ্ডগোল ।
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
হল কালের ভুল ,
পুবে হাওয়ায় ধরে দিলেম
দখিন হাওয়ার ফুল ।
এখন এল অন্য সুরে
অন্য গানের পালা ,
এখন গাঁথো অন্য ফুলে
অন্য ছাঁদের মালা ।
বাজছে মেঘের গুরু গুরু ,
বাদল ঝরো ঝরো—
সজল বায়ে কদম্ববন
কাঁপছে থরোথরো ।
অনেক হল দেরি ,
আজো তবু দীর্ঘ পথের
অন্ত নাহি হেরি ।
বোঝাপড়া
মনেরে আজ কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
কেউ বা তোমায় ভালোবাসে
কেউ বা বাসতে পারে না যে ,
কেউ বিকিয়ে আছে , কেউ বা
সিকি পয়সা ধারে না যে ,
কতকটা যে স্বভাব তাদের
কতকটা বা তোমারো ভাই ,
কতকটা এ ভবের গতিক—
সবার তরে নহে সবাই ।
তোমায় কতক ফাঁকি দেবে
তুমিও কতক দেবে ফাঁকি ,
তোমার ভোগে কতক পড়বে
পরের ভোগে থাকবে বাকি ,
মান্ধাতারই আমল থেকে
চলে আসছে এমনি রকম—
তোমারি কি এমন ভাগ্য
বাঁচিয়ে যাবে সকল জখম !
মনেরে আজ কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
অনেক ঝঞ্ঝা কাটিয়ে বুঝি
এলে সুখের বন্দরেতে ,
জলের তলে পাহাড় ছিল
লাগল বুকের অন্দরেতে ,
মুহূর্তেকে পাঁজরগুলো
উঠল কেঁপে আর্তরবে—
তাই নিয়ে কি সবার সঙ্গ
ঝগড়া করে মরতে হবে ?
ভেসে থাকতে পার যদি
সেইটে সবার চেয়ে শ্রেয় ,
না পার তো বিনা বাক্যে
টুপ করিয়া ডুবে যেয়ো ।
এটা কিছু অপূর্ব নয় ,
ঘটনা সামান্য খুবই—
শঙ্কা যেথায় করে না কেউ
সেইখানে হয় জাহাজ – ডুবি ।
মনেরে তাই কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
তোমার মাপে হয় নি সবাই
তুমিও হও নি সবার মাপে ,
তুমি মর কারো ঠেলায়
কেউ বা মরে তোমার চাপে—
তবু ভেবে দেখতে গেলে
এমনি কিসের টানাটানি ?
তেমন করে হাত বাড়ালে
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি ।
আকাশ তবু সুনীল থাকে ,
মধুর ঠেকে ভোরের আলো ,
মরণ এলে হঠাৎ দেখি
মরার চেয়ে বাঁচাই ভালো ।
যাহার লাগি চক্ষু বুজে
বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি
বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর ।
মনেরে তাই কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
নিজের ছায়া মস্ত করে
অস্তাচলে বসে বসে
আঁধার করে তোল যদি
জীবনখানা নিজের দোষে ,
বিধির সঙ্গ বিবাদ করে
নিজের পায়েই কুড়ুল মার ,
দোহাই তবে এ কার্যটা
যত শীঘ্র পার সারো ।
খুব খানিকটে কেঁদে কেটে
অশ্রু ঢেলে ঘড়া ঘড়া
মনের সঙ্গ এক রকমে
করে নে ভাই , বোঝাপড়া ।
তাহার পরে আঁধার ঘরে
প্রদীপখানি জ্বালিয়ে তোলো—
ভুলে যা ভাই , কাহার সঙ্গে
কতটুকুন তফাত হল ।
মনেরে তাই কহ যে ,
ভালো মন্দ যাহাই আসুক
সত্যেরে লও সহজে ।
ভর্ৎসনা
মিথ্যা আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
আমি তোমার পাড়ার প্রান্ত দিয়ে
চলেছিলেম আপন গৃহদ্বারে —
যেথা আমার বাঁধা ঘাটের কাছে
দুটি চাঁপায় ছায়া করে আছে ,
জামের শাখা ফলে – আঁধার – করা
স্বচ্ছগভীর পদ্মদিঘির ধারে ।
তুমি আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
আজ তো আমি মাটির পানে চেয়ে
দীনবেশে যাই নি তোমার ঘরে ।
অতিথ হয়ে দিই নি দ্বারে সাড়া ,
ভিক্ষাপাত্র নিই নি কাতর – করে ।
আমি আমার পথে যেতে যেতে
তোমার ঘরের দ্বারের বাহিরেতে
ঘনশ্যামল তমাল – তরুমূলে
দাঁড়িয়েছি এই দণ্ড – দুয়ের তরে ।
নতশিরে দুখানি হাত জুড়ি
দীনবেশে যাই নি তোমার ঘরে ।
আমি তোমার ফুল্ল পুষ্পবনে
তুলি নাই তো যূথীর একটি দল ।
আমি তোমার ফলের শাখা হতে
ক্ষুধাভরে ছিঁড়ি নাই তো ফল ।
আছি শুধু পথের প্রান্তদেশে
দাঁড়ায় যেথা সকল পান্থ এসে ,
নিয়েছি এই শুধু গাছের ছায়া—
পেয়েছি এই তরুণ তৃণতল ।
আমি তোমার ফুল্ল পুষ্পবনে
তুলি নাই তো যূথীর একটি দল ।
শ্রান্ত বটে আছে চরণ মম ,
পথের পঙ্ক লেগেছে দুই পায় ।
আষাঢ় – মেঘে হঠাৎ এল ধারা
আকাশ – ভাঙা বিপুল বরষায় ।
ঝোড়ো হাওয়ার এলোমেলো তালে
উঠল নৃত্য বাঁশের ডালে ডালে ,
ছুটল বেগে ঘন মেঘের শ্রেণী
ভগ্নরণে ছিন্নকেতুর প্রায় ।
শ্রান্ত বটে আছে চরণ মম ,
পথের পঙ্ক লেগেছে দুই পায় ।
কেমন করে জানব মনে আমি
কী যে আমায় ভাবলে মনে মনে ।
কাহার লাগি একলা ছিলে বসে
মুক্তকেশে আপন বাতায়নে ।
তড়িৎশিখা ক্ষণিক দীপ্তালোকে
হানতেছিল চমক তোমার চোখে ,
জানত কে বা দেখতে পাবে তুমি
আছি আমি কোথায় যে কোন্ কোণে ।
কেমন করে জানব মনে আমি
আমায় কী যে ভাবলে মনে মনে ।
বুঝি গো দিন ফুরিয়ে গেল আজি ,
এখনো মেঘ আছে আকাশ ভরে ।
থেমে এল বাতাস বেণুবনে ,
মাঠের ‘পরে বৃষ্টি এল ধরে ।
তোমার ছায়া দিলেম তবে ছাড়ি ,
লও গো তোমার ভূমি – আসন কাড়ি ,
সন্ধ্যা হল— দুয়ার করো রোধ ,
যাব আমি আপন পথ -‘ পরে ।
বুঝি গো দিন ফুরিয়ে গেল আজি ,
এখনো মেঘ আছে আকাশ ভরে ।
মিথ্যা আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
আছে আমার নতুন – ছাওয়া ঘর
পাড়ার পরে পদ্মদিঘির ধারে ।
কুটিরতলে দিবস হলে গত
জ্বলে প্রদীপ ধ্রুবতারার মতো ,
আমি কারো চাই নে কোনো দান
কাঙালবেশে কোনো ঘরের দ্বারে ।
মিথ্যা আমায় কেন শরম দিলে
চোখের চাওয়া নীরব তিরস্কারে !
ভীরুতা
গভীর সুরে গভীর কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই ।
মনে মনে হাসবি কিনা
বুঝব কেমন করে ?
আপনি হেসে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই—
ঠাট্টা করে ওড়াই সখী ,
নিজের কথাটাই ।
হাল্কা তুমি কর পাছে
হাল্কা করি ভাই ,
আপন ব্যথাটাই ।
সত্য কথা সরলভাবে
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই ।
অবিশ্বাসে হাসবি কিনা
বুঝব কেমন করে ?
মিথ্যা ছলে তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই ,
উল্টা করে বলি আমি
সহজ কথাটাই ।
ব্যর্থ তুমি কর পাছে
ব্যর্থ করি ভাই ,
আপন ব্যথাটাই ।
সোহাগ – ভরা প্রাণের কথা
শুনিয়ে দিতে তোরে
সাহস নাহি পাই ।
সোহাগ ফিরে পাব কিনা
বুঝব কেমন করে ?
কঠিন কথা তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই ,
গর্বছলে দীর্ঘ করি
নিজের কথাটাই ।
ব্যথা পাছে না পাও তুমি
লুকিয়ে রাখি তাই
নিজের ব্যথাটাই ।
ইচ্ছা করে নীরব হয়ে
রহিব তোর কাছে ,
সাহস নাহি পাই ।
মুখের ‘পরে বুকের কথা
উথ্লে ওঠে পাছে
অনেক কথা তাই
শুনিয়ে দিয়ে যাই ,
কথার আড়ে আড়াল থাকে
মনের কথাটাই ।
তোমায় ব্যথা লাগিয়ে শুধু
জাগিয়ে তুলি ভাই
আপন ব্যথাটাই ।
ইচ্ছা করি সুদূরে যাই ,
না আসি তোর কাছে ।
সাহস নাহি পাই ।
তোমার কাছে ভীরুতা মোর
প্রকাশ হয় রে পাছে
কেবল এসে তাই
দেখা দিয়েই যাই ,
স্পর্ধাতলে গোপন করি
মনের কথাটাই ।
নিত্য তব নেত্রপাতে
জ্বালিয়ে রাখি ভাই ,
আপন ব্যথাটাই ।
মাতাল
ওরে মাতাল , দুয়ার ভেঙেদিয়ে
পথেই যদি করিস মাতামাতি ,
থলিঝুলি উজাড় করে ফেলে
যা আছে তোর ফুরাস রাতারাতি ,
অশ্লেষাতে যাত্রা করে শুরু
পাঁজিপুঁথি করিস পরিহাস ,
অকারণে অকাজ লয়ে ঘাড়ে
অসময়ে অপথ দিয়ে যাস ,
হালের দড়ি নিজের হাতে কেটে
পালের ‘পরে লাগাস ঝোড়ো হাওয়া ,
আমিও ভাই , তোদের ব্রত লব
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।
পাড়ার যত জ্ঞানীগুণীর সাথে
নষ্ট হল দিনের পর দিন—
অনেক শিখে পক্ব হল মাথা
অনেক দেখে দৃষ্টি হল ক্ষীণ ,
কত কালের কত মন্দ ভালো
বসে বসে কেবল জমা করি ,
ফেলাছড়া – ভাঙাছেঁড়ার বোঝা
বুকের মাঝে উঠছে ভরি ভরি ,
গুঁড়িয়ে সে – সব উড়িয়ে ফেলে দিক
দিক্ – বিদিকে তোদের ঝোড়ো হাওয়া ।
বুঝেছি ভাই , সুখের মধ্যে সুখ
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।
হোক রে সিধা কুটিল দ্বিধা যত ,
নেশায় মোরে করুক দিশাহারা ,
দানোয় এসে হঠাৎ কেশে ধরে
এক দমকে করুক লক্ষ্মীছাড়া ।
সংসারেতে সংসারী তো ঢের
কাজের হাটে অনেক আছে কেজো ,
মেলাই আছে মস্ত বড়ো লোক—
সঙ্গ তাঁদের অনেক সেজো মেজো ।
থাকুন তাঁরা ভবের কাজে লেগে ,
লাগুক মোরে সৃষ্টিছাড়া হাওয়া—
বুঝেছি ভাই , কাজের মধ্যে কাজ
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।
শপথ করে দিলাম ছেড়ে আজই
যা আছে মোর বুদ্ধি বিবেচনা ,
বিদ্যা যত ফেলব ঝেড়ে ঝুড়ে
ছেড়ে ছুড়ে তত্ত্ব – আলোচনা ।
স্মৃতির ঝারি উপুড় করে ফেলে
নয়নবারি শূন্য করি দিব ,
উচ্ছ্বসিত মদের ফেনা দিয়ে
অট্টহাসি শোধন করি নিব ।
ভদ্রলোকের তকমা – তাবিজ ছিঁড়ে
উড়িয়ে দেবে মদোন্মত্ত হাওয়া ,
শপথ করে বিপথ – ব্রত নেব—
মাতাল হয়ে পাতাল – পানে ধাওয়া ।
মেঘমুক্ত
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে ,
আয় গো আয়—
কাঁচা রোদখানি পড়েছে বনের
ভিজে পাতায় ।
ঝিকিঝিকি করি কাঁপিতেছে বট ,
ওগো ঘাটে আয় , নিয়ে আয় ঘট—
পথের দু ধারে শাখে শাখে আজি
পাখিরা গায় ।
ভোর থেকে আজ বাদল ছুটেছে ,
আয় গো আয় ।
তোমাদের সেই ছায়া – ঘেরা দিঘি ,
না আছে তল—
কূলে কূলে তার ছেপে ছেপে আজি
উঠেছে জল ।
এ ঘাট হইতে ও ঘাটে তাহার
কথা – বলাবলি নাহি চলে আর
একাকার হল তীরে আর নীরে
তাল – তলায় ।
আজ ভোর হতে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
ঘাটে পঁইঠায় বসিবি বিরলে
ডুবায়ে গলা ,
হবে পুরাতন প্রাণের কথাটি
নূতন বলা ।
সে কথার সাথে রেখে রেখে মিল
থেকে থেকে ডেকে উঠিবে কোকিল ,
কানাকানি করে ভেসে যাবে মেঘ
আকাশ – গায় ।
আজ ভোর থেকে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
তপন – আতপে আতপ্ত হয়ে
উঠেছে বেলা ;
খঞ্জন দুটি আলস্যভরে
ছেড়েছে খেলা ।
কলস পাকড়ি আঁকড়িয়া বুকে
ভরা জলে তোরা ভেসে যাবি সুখে ,
তিমিরনিবিড় ঘনঘোর ঘুমে
স্বপনপ্রায় ।
আজ ভোর থেকে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
মেঘ ছুটে গেল নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
আজিকে সকালে শিথিল কোমল
বহিছে বায় ।
পতঙ্গ যেন ছবিসম আঁকা
শৈবাল -‘ পরে মেলে আছে পাখা ,
জলের কিনারে বসে আছে বক
গাছের ছায় ।
আজ ভোর হতে নাই গো বাদল ,
আয় গো আয় ।
যথাসময়
ভাগ্য যখন কৃপণ হয়ে আসে ,
বিশ্ব যবে নিঃস্ব তিলে তিলে ,
মিষ্ট মুখে ভুবন – ভরা হাসি
ওষ্ঠে শেষে ওজন – দরে মিলে ,
বন্ধুজনে বন্ধ করে প্রাণ ,
দীর্ঘদিন সঙ্গীহীন একা ,
হঠাৎ পড়ে ঋণশোধেরই পালা ,
ঋণীজনের না যায় পাওয়া দেখা ,
তখন ঘরে বন্ধ হ রে কবি ,
খিলের পরে খিল লাগাও খিল ।
কথার সাথে গাঁথো কথার মালা ,
মিলের সাথে মিল মিলাও মিল ।
কপাল যদি আবার ফিরে যায় ,
প্রভাত – কালে হঠাৎ জাগরণে ,
শূন্য নদী আবার যদি ভরে
শরৎ – মেঘে ত্বরিত বরিষনে ,
বন্ধু ফিরে বন্দী করে বুকে ,
সন্ধি করে অন্ধ অরিদল ,
অরুণ ঠোঁটে তরুণ ফোটে হাসি ,
কাজল চোখে করুণ আঁখিজল ,
তখন খাতা পোড়াও খ্যাপা কবি ,
দিলের সাথে দিল লাগাও দিল ।
বাহুর সাথে বাঁধো মৃণাল – বাহু ,
চোখের সাথে চোখে মিলাও মিল ।
যথাস্থান
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোন্খানে তোর স্থান ?
পন্ডিতেরা থাকেন যেথায়
বিদ্যেরত্ন – পাড়ায়—
নস্য উড়ে আকাশ জুড়ে
কাহার সাধ্য দাঁড়ায় ,
চলছে সেথায় সূক্ষ্ম তর্ক
সদাই দিবারাত্র
‘ পাত্রাধার কি তৈল কিম্বা
তৈলাধার কি পাত্র’ ।
পুঁথিপত্র মেলাই আছে
মোহধ্বান্তনাশন ,
তারি মধ্যে একটি প্রান্তে
পেতে চাস কি আসন ?
গান তা শুনি গুঞ্জরিয়া
গুঞ্জরিয়া কহে—
নহে নহে নহে ।
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোন্ দিকে তোর টান ?
পাষাণ – গাঁথা প্রাসাদ -‘ পরে
আছেন ভাগ্যবন্ত ,
মেহাগিনির মঞ্চ জুড়ি
পঞ্চ হাজার গ্রন্থ—
সোনার জলে দাগ পড়ে না ,
খোলে না কেউ পাতা ,
অ – স্বাদিতমধু যেমন
যূথী অনাঘ্রাতা ।
ভৃত্য নিত্য ধুলা ঝাড়ে
যত্ন পুরা মাত্রা ,
ওরে আমার ছন্দোময়ী ,
সেথায় করবি যাত্রা ?
গান তা শুনি কর্ণমূলে
মর্মরিয়া কহে—
নহে নহে নহে ।
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোথায় পাবি মান ?
নবীন ছাত্র ঝুঁকে আছে
এক্জামিনের পড়ায় ,
মনটা কিন্তু কোথা থেকে
কোন্ দিকে যে গড়ায় ,
অপাঠ্য সব পাঠ্য কেতাব
সামনে আছে খোলা ,
কর্তৃজনের ভয়ে কাব্য
কুলুঙ্গিতে তোলা—
সেইখানেতে ছেঁড়াছড়া
এলোমোলোর মেলা ,
তারি মধ্যে ওরে চপল ,
করবি কি তুই খেলা ?
গান তা শুনে মৌনমুখে
রহে দ্বিধার ভরে—
যাব – যাব করে ।
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোথায় পাবি ত্রাণ ?
ভান্ডারেতে লক্ষ্মী বধূ
যেথায় আছে কাজে ,
ঘরে ধায় সে ছুটি পায় সে
যখন মাঝে মাঝে ,
বালিশ – তলে বইটি চাপা
টানিয়া লয় তারে ,
পাতাগুলিন ছেঁড়াখোঁড়া
শিশুর অত্যাচারে—
কাজল – আঁকা সিঁদুরমাখা
চুলের – গন্ধে – ভরা
শয্যাপ্রান্তে ছিন্ন বেশে
চাস কি যেতে ত্বরা ?
বুকের ‘পরে নিশ্বসিয়া
স্তব্ধ রহে গান—
লোভে কম্পমান ।
কোন্ হাটে তুই বিকোতে চাস
ওরে আমার গান ,
কোথায় পাবি প্রাণ ?
যেথায় সুখে তরুণ যুগল
পাগল হয়ে বেড়ায় ,
আড়াল বুঝে আঁধার খুঁজে
সবার আঁখি এড়ায় ,
পাখি তোদের শোনায় গীতি ,
নদী শোনায় গাথা ,
কত রকম ছন্দ শোনায়
পুষ্প লতা পাতা—
সেইখানেতে সরল হাসি
সজল চোখের কাছে
বিশ্ববাঁশির ধ্বনির মাঝে
যেতে কি সাধ আছে ?
হঠাৎ উঠে উচ্ছ্বসিয়া
কহে আমার গান—
সেইখানে মোর স্থান ।
যাত্রী
আছে , আছে স্থান !
একা তুমি , তোমার শুধু
একটি আঁটি ধান ।
নাহয় হবে , ঘেঁষাঘঁষি ,
এমন কিছু নয় সে বেশি ,
নাহয় কিছু ভারী হবে
আমার তরীখান—
তাই বলে কি ফিরবে তুমি
আছে , আছে স্থান !
এসো , এসো নায়ে !
ধুলা যদি থাকে কিছু
থাক্ – না ধূলা পায়ে ।
তনু তোমার তনুলতা ,
চোখের কোণে চঞ্চলতা ,
সজলনীল – জলদ – বরন
বসনখানি গায়ে—
তোমার তরে হবে গো ঠাঁই—
এসো এসো নায়ে ।
যাত্রী আছে নানা ,
নানা ঘাটে যাবে তারা
কেউ কারো নয় জানা ।
তুমিও গো ক্ষণেক – তরে
বসবে আমার তরী -‘ পরে ,
যাত্রা যখন ফুরিয়ে যাবে ,
মান্বে না মোর মানা—
এলে যদি তুমিও এসো ,
যাত্রী আছে নানা ।
কোথা তোমার স্থান ?
কোন্ গোলাতে রাখতে যাবে
একটি আঁটি ধান ?
বলতে যদি না চাও তবে
শুনে আমার কী ফল হবে ,
ভাবব ব’সে খেয়া যখন
করব অবসান—
কোন্ পাড়াতে যাবে তুমি ,
কোথা তোমার স্থান ?
যুগল
ঠাকুর , তব পায়ে নমোনমঃ ,
পাপিষ্ঠ এই অক্ষমেরে ক্ষম ,
আজ বসন্তে বিনয় রাখো মম—
বন্ধ করো শ্রীমদ্ভাগবত ।
শাস্ত্র যদি নেহাত পড়তে হবে
গীত – গোবিন্দ খোলা হোক – না তবে ।
শপথ মম , বোলো না এই ভবে
জীবনখানা শুধুই স্বপ্নবৎ ।
একটা দিনের সন্ধি করিয়াছি ,
বন্ধ আছে যমরাজের সমর—
আজকে শুধু এক বেলারই তরে
আমরা দোঁহে অমর দোঁহে অমর ।
স্বয়ং যদি আসেন আজি দ্বারে
মান্ব নাকো রাজার দারোগারে—
কেল্লা হতে ফৌজ সারে সারে
দাঁড়ায় যদি , ওঁচায় ছোরা – ছুরি ,
বলব , ‘ রে ভাই , বেজার কোরো নাকো ,
গোল হতেছে , একটু থেমে থাকো ,
কৃপাণ – খোলা শিশুর খেলা রাখো
খ্যাপার মতো কামান – ছোঁড়াছুঁড়ি ।
একটুখানি সরে গিয়ে করো
সঙের মতো সঙিন ঝম – ঝমর ।
আজকে শুধু এক বেলারই তরে
আমরা দোঁহে অমর দোঁহে অমর । ‘
বন্ধুজনে যদি পুণ্যফলে
করেন দয়া , আসেন দলে দলে ,
গলায় বস্ত্র কব নয়নজলে ,
‘ ভাগ্য নামে অতিবর্ষা – সম !
এক দিনেতে অধিক মেশামেশি
শ্রান্তি বড়োই আনে শেষাশেষি ,
জান তো ভাই , দুটি প্রাণীর বেশি
এ কুলায়ে কুলায় নাকো মম ।
ফাগুন – মাসে ঘরের টানাটানি—
অনেক চাঁপা , অনেকগুলি ভ্রমর ।
ক্ষুদ্র আমার এই অমরাবতী—
আমরা দুটি অমর , দুটি অমর ।
যৌবনবিদায়
ওগো যৌবনতরী ,
এবার বোঝাই সাঙ্গ করে দিলেম বিদায় করি ।
কতই খেয়া , কতই খেয়াল ,
কতই – না দাঁড় – বাওয়া—
তোমার পালে লেগেছিল
কত দখিন হাওয়া !
কত ঢেউয়ের টল্মলানি
কত স্রোতের টান—
পূর্ণিমাতে সাগর হতে
কত পাগল বান !
এ পার হতে ও পার ছেয়ে
ঘন মেঘের সারি ,
শ্রাবণ – দিনে ভরা গাঙে
দু – কূল – হারা পাড়ি ।
অনেক খেলা , অনেক মেলা
সকলি শেষ ক’রে
চল্লিশেরই ঘাটের থেকে
বিদায় দিনু তোরে ।
ওগো তরুণ তরী ,
যৌবনেরই শেষ কটি গান দিনু বোঝাই করি ।
সে – সব দিনের কান্না হাসি ,
সত্য মিথ্যা ফাঁকি ,
নিঃশেষিয়ে যাস রে নিয়ে
রাখিস নে আর বাকি ।
নোঙর দিয়ে বাঁধিস নে আর
চাহিস নে আর পাছে—
ফিরে ফিরে ঘুরিস নে আর
ঘাটের কাছে কাছে ।
এখন হতে ভাঁটার স্রোতে
ছিন্ন পালটি তুলে
ভেসে যা রে স্বপ্ন – সমান
অস্তাচলের কূলে ।
সেথায় সোনা – মেঘের ঘাটে
নামিয়ে দিয়ো শেষে
বহুদিনের বোঝা তোমার
চিরনিদ্রার দেশে ।
ওরে আমার তরী ,
পারে যাবার উঠল হাওয়া , ছোট্ রে ত্বরা করি ।
যেদিন খেয়া ধরেছিলেম
ছায়াবটের ধারে ,
ভোরের সুরে ডেকেছিলেম
‘ কে যাবি আয় পারে’ ।
ভেবেছিলেম ঘাটে ঘাটে
করতে আনাগোনা
এমন চরণ পড়বে নায়ে
নৌকো হবে সোনা ।
এতবারের পারাপারে ,
এত লোকের ভিড়ে ,
সোনা – করা দুটি চরণ
দেয় নি পরশ কি রে ?
যদি চরণ পড়ে থাকে
কোনো একটি বারে
যা রে সোনার জন্ম নিয়ে
সোনার মৃত্যু – পারে ।
শাস্ত্র
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।
বনে এত বকুল ফোটে ,
গেয়ে মরে কোকিল পাখি ,
লতাপাতার অন্তরালে
বড়ো সরস ঢাকাঢাকি ।
চাঁপার শাখে চাঁদের আলো ,
সে সৃষ্টি কি কেবল মিছে ?
এ – সব যারা বোঝে তারা
পঞ্চাশতের অনেক নীচে ।
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।
ঘরের মধ্যে বকাবকি ,
নানান মুখে নানা কথা ।
হাজার লোকে নজর পাড়ে ,
একটুকু নাই বিরলতা ।
সময় অল্প , ফুরায় তাও
অরসিকের আনাগোনায়—
ঘণ্টা ধরে থাকেন তিনি
সৎপ্রসঙ্গ – আলোচনায় ।
হতভাগ্য নবীন যুবা
কাছেই থাকে বনের খোঁজে ,
ঘরের মধ্যে মুক্তি যে নেই
এ কথা সে বিশেষ বোঝে ।
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।
আমরা সবাই নব্যকালের
সভ্য যুবা অনাচারী ,
মনুর শাস্ত্র শুধরে দিয়ে
নতুন বিধি করব জারি—
বুড়ো থাকুন ঘরের কোণে ,
পয়সাকড়ি করুন জমা ,
দেখুন বসে বিষয় – পত্র ,
চালান মামলা – মকদ্দমা ,
ফাগুন – মাসে লগ্ন দেখে
যুবারা যাক বনের পথে ,
রাত্রি জেগে সাধ্যসাধন
থাকুক রত কঠিন ব্রতে ।
পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যাবে
এমন কথা শাস্ত্রে বলে ,
আমরা বলি বানপ্রস্থ
যৌবনেতেই ভালো চলে ।
শেষ
থাকব না ভাই , থাকব না কেউ—
থাকবে না ভাই কিছু ।
সেই আনন্দে যাও রে চলে
কালের পিছু পিছু ।
অধিক দিন তো বইতে হয় না
শুধু একটি প্রাণ ।
অনন্ত কাল একই কবি
গায় না একই গান ।
মালা বটে শুকিয়ে মরে—
যে জন মালা পরে
সেও তো নয় অমর , তবে
দুঃখ কিসের তরে ?
থাকব না ভাই , থাকব না কেউ—
থাকবে না ভাই কিছু ।
সেই আনন্দে যাও রে চলে
কালের পিছু পিছু ।
সবই হেথায় একটা কোথাও
করতে হয় রে শেষ ,
গান থামিলে তাই তো কানে
থাকে গানের রেশ ।
কাটলে বেলা সাধের খেলা
সমাপ্ত হয় ব’লে
ভাব্নাটি তার মধুর থাকে
আকুল অশ্রুজলে ।
জীবন অস্তে যায় চলি , তাই
রঙটি থাকে লেগে ,
প্রিয়জনের মনের কোণে
শরৎ – সন্ধ্যা – মেঘে ।
থাকব না ভাই , থাকব না কেউ—
থাকবে না ভাই কিছু ।
সেই আনন্দে যাও রে ধেয়ে
কালের পিছু পিছু ।
ফুল তুলি তাই তাড়াতাড়ি
পাছে ঝ’রেই পড়ে ।
সুখ নিয়ে তাই কাড়াকাড়ি ,
পাছে যায় সে স’রে ।
রক্ত নাচে দ্রুতচ্ছন্দে ,
চক্ষে তড়িৎ ভায় ,
চুম্বনেরে কেড়ে নিতে
অধর ধেয়ে যায় ।
সমস্ত প্রাণ জাগে রে তাই ,
বক্ষ – দোলায় দোলে —
বাসনাতে ঢেউ উঠে যায়
মত্ত আকুল রোলে ।
থাকব না ভাই , থাকব না কেউ —
থাকবে না ভাই কিছু ।
সেই আনন্দে চল্ রে ছুটে
কালের পিছু পিছু ।
কোনো জিনিস চিনব যে রে ,
প্রথম থেকে শেষ ,
নেব যে সব বুঝে প’ড়ে—
নাই সে সময় লেশ ।
জগৎটা যে জীর্ণ মায়া
সেটা জানার আগে
সকল স্বপ্ন কুড়িয়ে নিয়ে
জীবন – রাত্রি ভাগে ।
ছুটি আছে শুধু দু দিন
ভালোবাসবার মতো—
কাজের জন্য জীবন হলে
দীর্ঘজীবন হত ।
থাকব না ভাই , থাকব না কেউ—
থাকবে না ভাই কিছু ।
সেই আনন্দে চল্ রে ছুটে
কালের পিছু পিছু ।
আজ তোমাদের যেমন জানছি
তেমনি জানতে জানতে
ফুরায় যেন সকল জানা—
যাই জীবনের প্রান্তে ।
এই যে নেশা লাগল চোখে
এইটুকু যেই ছোটে
অমনি যেন সময় আমার
বাকি না রয় মোটে ।
জ্ঞানের চক্ষু স্বর্গে গিয়ে
যায় যদি যাক খুলি ,
মর্তে যেন না ভেঙে যায়
মিথ্যে মায়াগুলি ।
থাকব না ভাই , থাকব না কেউ
থাকবে না ভাই কিছু ।
সেই আনন্দে চল্ রে ধেয়ে
কালের পিছু পিছু ।
শেষ হিসাব
সন্ধ্যা হয়ে এল , এবার
সময় হল হিসাব নেবার ।
যে দেব্তারে গড়েছিলেম ,
দ্বারে যাঁদের পড়েছিলেম ,
আয়োজনটা করেছিলেম
জীবন দিয়ে চরণ সেবার—
তাঁদের মধ্যে র আজ সায়াহ্নে
কে বা আছেন এবং কে নেই ,
কেই বা বাকি কেই বা ফাঁকি ,
ছুটি নেব সেইটে জেনেই ।
নাই বা জানলি হায় রে মূর্খ !
কী হবে তোর হিসাব সূক্ষ্ম !
সন্ধ্যা এল , দোকান তোলো ,
পারের নৌকা তৈরি হল—
যত পার ততই ভোলো
বিফল সুখের বিরাট দুঃখ ।
জীবনখানা খুললে তোমার
শূন্য দেখি শেষের পাতা—
কী হবে ভাই , হিসেব নিয়ে ,
তোমার নয়কো লাভের খাতা ।
আপনি আঁধার ডাকছে তোরে ,
ঢাকছে তোমায় দয়া ক’রে ।
তুমি তবে কেনই জ্বাল
মিট্মিটে ওই দীপের আলো !
চক্ষু মুদে থাকাই ভালো
শ্রান্ত , পথের প্রান্তে প’ড়ে ।
জানাজানির সময় গেছে ,
বোঝাপড়া কর্ রে বন্ধ ।
অন্ধকারের স্নিগ্ধ কোলে
থাক্ রে হয়ে বধির অন্ধ ।
যদি তোমায় কেউ না রাখে ,
সবাই যদি ছেড়েই থাকে—
জনশূন্য বিশাল ভবে
একলা এসে দাঁড়াই তবে ,
তোমার বিশ্ব উদার রবে
হাজার সুরে তোমায় ডাকে ।
আঁধার রাতে নির্নিমেষে
দেখতে দেখতে যাবে দেখা ,
তুমি একা জগৎ মাঝে ,
প্রাণের মাঝে আরেক একা ।
ফুলের দিনে যে মঞ্জরী
ফলের দিন যাক সে ঝরি ।
মরিস নে আর মিথ্যে ভেবে ,
বসন্তেরই অন্তে এবে
যারা যারা বিদায় নেবে
একে একে যাক রে সরি ।
হোক রে তিক্ত মধুর কণ্ঠ ,
হোক রে রিক্ত কল্পলতা—
তোমার থাকুক পরিপূর্ণ
একলা থাকার সার্থকতা ।
সমাপ্তি
পথে যতদিন ছিনু ততদিন অনেকের সনে দেখা ।
সব শেষ হল যেখানে সেথায় তুমি আর আমি একা ।
নানা বসন্তে নানা বরষায়
অনেক দিবসে অনেক নিশায়
দেখেছি অনেক , সহেছি অনেক , লিখেছি অনেক লেখা—
পথে যতদিন ছিনু ততদিন অনেকের সনে দেখা ।
কখন যে পথ আপনি ফুরালো , সন্ধ্যা হল যে কবে !
পিছনে চাহিয়া দেখিনু কখন চলিয়া গিয়াছে সবে ।
তোমার নীরব নিভৃত ভবনে
জানি না কখন পশিনু কেমনে ।
অবাক রহিনু আপন প্রাণের নূতন গানের রবে ।
কখন যে পথ আপনি ফুরালো , সন্ধ্যা হল যে কবে !
চিহ্ন কি আছে শ্রান্ত নয়নে অশ্রুজলের রেখা ?
বিপুল পথের বিবিধ কাহিনী আছে কি ললাটে লেখা ?
রুধিয়া দিয়েছ তব বাতায়ন ,
বিছানো রয়েছে শীতল শয়ন ,
তোমার সন্ধ্যাপ্রদীপ – আলোকে তুমি আর আমি একা ।
নয়নে আমার অশ্রুজলের চিহ্ন কি যায় দেখা !
সম্বরণ
আজকে আমার বেড়া – দেওয়া বাগানে
বাতাসটি বয় মনের – কথা – জাগানে ।
আজকে কেবল বউ – কথা – কও ডাকে
কৃষ্ণচূড়ার পুষ্প – পাগল শাখে—
আমি আছি তরুর তলায় পা মেলি ,
সামনে অশোক টগর চাঁপা চামেলি ।
আজকে আমার বেড়া – দেওয়া বাগানে
বাতাসটি বয় মনের – কথা – জাগানে ।
এমনিতরো বাতাস – বওয়া সকালে
নিজেরে মন aহাজারো বার ঠকালে ।
আপনারে হায় চিত – উদাস গানে
উড়িয়ে দিলে অজানিতের পানে ,
চিরদিন যা ছিল নিজের দখলে
দিয়ে দিলে পথের পান্থ সকলে ।
আজকে আমার বেড়া – দেওয়া বাগানে
বাতাসটি বয় মনের – কথা – জাগানে ।
ভেবেছি তাই আজকে কিছুই গাব না
গানের সঙ্গ ে গলিয়ে প্রাণের ভাবনা ।
আপনা ভুলে ওরে ভাবোন্মাদ ,
দিস নে ভেঙে তোর বেদনা – বাঁধ—
মনের সঙ্গ মনের কথা গাঁথা সে ।
গাব না গান আজকে দখিন বাতাসে ।
আজকে আমার বেড়া – দেওয়া বাগানে
বাতাসটি বয় মনের – কথা – জাগানে ।
সুখদুঃখ
বসেছে আজ রথের তলায়
স্নানযাত্রার মেলা—
সকাল থেকে বাদল হল ,
ফুরিয়ে এল বেলা ।
আজকে দিনের মেলামেশা
যত খুশি যতই নেশা
সবার চেয়ে আনন্দময়
ওই মেয়েটির হাসি—
এক পয়সায় কিনিছে ও
তালপাতার এক বাঁশি ।
বাজে বাঁশি , পাতার বাঁশি
আনন্দস্বরে ।
হাজার লোকের হর্ষধ্বনি
সবার উপরে ।
ঠাকুরবাড়ি ঠেলাঠেলি
লোকের নাহি শেষ ,
অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারায়
ভেসে যায় রে দেশ ।
আজকে দিনের দুঃখ যত
নাই রে দুঃখ উহার মতো ,
ওই – যে ছেলে কাতর চোখে
দোকান – পানে চাহি
একটা রাঙা লাঠি কিনবে
একটি পয়সা নাহি ।
চেয়ে আছে নিমেষহারা ,
নয়ন অরুণ—
হাজার লোকের মেলাটিরে
করেছে করুণ ।
সেকাল
আমি যদি জন্ম নিতেম
কালিদাসের কালে ,
দৈবে হতেম দশম রত্ন
নবরত্নের মালে ,
একটি শ্লোকে স্তুতি গেয়ে
রাজার কাছে নিতাম চেয়ে
উজ্জয়িনীর বিজন প্রান্তে
কানন – ঘেরা বাড়ি ।
রেবার তটে চাঁপার তলে
সভা বসত সন্ধ্যা হলে ,
ক্রীড়াশৈলে আপন – মনে
দিতাম কণ্ঠ ছাড়ি ।
জীবনতরী বহে যেত
মন্দাক্রান্তা তালে ,
আমি যদি জন্ম নিতাম
কালিদাসের কালে ।
২
চিন্তা দিতেম জলাঞ্জলি ,
থাকত নাকো ত্বরা—
মৃদুপদে যেতেম , যেন
নাইকো মৃত্যু জরা ।
ছটা ঋতু পূর্ণ করে
ঘটত মিলন স্তরে স্তরে ,
ছটা সর্গে বার্তা তাহার
রইত কাব্যে গাঁথা ।
বিচ্ছেদও সুদীর্ঘ হত ,
অশ্রুজলের নদীর মতো
মন্দগতি চলত রচি
দীর্ঘ করুণ গাথা ।
আষাঢ় মাসে মেঘের মতন
মন্থরতায় ভরা
জীবনটাতে থাকত নাকো
কিছুমাত্র ত্বরা ।
৩
অশোক – কুঞ্জ উঠত ফুটে
প্রিয়ার পদাঘাতে ,
বকুল হত ফুল্ল প্রিয়ার
মুখের মদিরাতে ।
প্রিয়সখীর নামগুলি সব
ছন্দ ভরি করিত রব ,
রেবার কুলে কলহংসের
কলধ্বনির মতো ।
কোনো নামটি মন্দালিকা ,
কোনো নামটি চিত্রলিখা ,
মঞ্জুলিকা মঞ্জরিণী
ঝংকারিত কত !
আসত তারা কুঞ্জবনে
চৈত্র – জ্যোৎস্না – রাতে ,
অশোক – শাখা উঠত ফুটে
প্রিয়ার পদাঘাতে ।
৪
কুরবকের পরত চূড়া
কালো কেশের মাঝে ,
লীলাকমল রইত হাতে
কী জানি কোন্ কাজে !
অলক সাজত কুন্দফুলে ,
শিরীষ পরত কর্ণমূলে ,
মেখলাতে দুলিয়ে দিত
নবনীপের মালা ।
ধারাযন্ত্রে স্নানের শেষে
ধূপের ধোঁয়া দিত কেশে ,
লোধ্রফুলের শুভ্র রেণু
মাখত মুখে বালা ।
কালাগুরুর গুরু গন্ধ
লেগে থাকত সাজে ,
কুরবকের পরত মালা
কালো কেশের মাঝে ।
৫
কুঙ্কুমেরই পত্রলেখায়
বক্ষ রইত ঢাকা ,
আঁচলখানির প্রান্তটিতে
হংসমিথুন আঁকা ।
বিরহেতে আষাঢ় মাসে
চেয়ে রইত বঁধুর আশে ,
একটি করে পূজার পুষ্পে
দিন গনিত ব’সে ।
বক্ষে তুলে বীণাখানি
গান গাহিতে ভুলত বাণী ,
রুক্ষ অলক অশ্রুচোখে
পড়ত খসে খসে ।
মিলন – রাতে বাজত পায়ে
নূপুর – দুটি বাঁকা ,
কুঙ্কুমেরই পত্রলেখায়
বক্ষ রইত ঢাকা ।
৬
প্রিয় নামটি শিখিয়ে দিত
সাধের শারিকারে ,
নাচিয়ে দিত ময়ূরটিরে
কঙ্কণঝংকারে ।
কপোতটিরে লয়ে বুকে
সোহাগ করত মুখে মুখে ,
সারসীরে খাইয়ে দিত
পদ্মকোরক বহি ।
অলক নেড়ে দুলিয়ে বেণী
কথা কইত শৌরসেনী ,
বলত সখীর গলা ধরে—
‘ হলা পিয় সহি’ ।
জল সেচিত আলবালে
তরুণ সহকারে ,
প্রিয় নামটি শিখিয়ে দিত
সাধের শারিকারে ।
৭
নবরত্নের সভার মাঝে
রইতাম একটি টেরে ,
দূর হইতে গড় করিতাম
দিঙ্নাগাচার্যেরে ।
আশা করি নামটা হত
ওরই মধ্যে ভদ্রমত—
বিশ্বসেন কি দেবদত্ত
কিম্বা বসুভূতি ।
স্রগ্ধরা কি মালিনীতে
বিম্বাধরের স্তুতিগীতে
দিতাম রচি দুটি – চারটি
ছোটোখাটো পুঁথি ।
ঘরে যেতাম তাড়াতাড়ি
শ্লোক – রচনা সেরে ,
নবরত্নের সভার মাঝে
রইতাম একটি টেরে ।
৮
আমি যদি জন্ম নিতেম
কালিদাসের কালে
বন্দী হতেম না জানি কোন্
মালবিকার জালে ।
কোন্ বসন্ত – মহোৎসবে
বেণুবীণার কলরবে
মঞ্জরিত কুঞ্জবনের
গোপন অন্তরালে
কোন্ ফাগুনের শুক্লনিশায়
যৌবনেরই নবীন নেশায়
চকিতে কার দেখা পেতেম
রাজার চিত্রশালে !
ছল করে তার বাধত আঁচল
সহকারের ডালে
আমি যদি জন্ম নিতেম
কালিদাসের কালে ।
৯
হায় রে কবে কেটে গেছে
কালিদাসের কাল !
পণ্ডিতেরা বিবাদ করে
লয়ে তারিখ – সাল ।
হারিয়ে গেছে সে – সব অব্দ ,
ইতিবৃত্ত আছে স্তব্ধ—
গেছে যদি আপদ গেছে ,
মিথ্যা কোলাহল ।
হায় রে গেল সঙ্গে তারি
সেদিনের সেই পৌরনারী
নিপুণিকা চতুরিকা
মালবিকার দল ।
কোন্ স্বর্গে নিয়ে গেল
বরমাল্যের থাল !
হায় রে কবে কেটে গেছে
কালিদাসের কাল !
১০
যাদের সঙ্গ হয় নি মিলন
সে – সব বরাঙ্গনা
বিচ্ছেদেরই দুঃখে আমায়
করছে অন্যমনা ।
তবু মনে প্রবোধ আছে—
তেমনি বকুল ফোটে গাছে
যদিও সে পায় না নারীর
মুখমদের ছিটা ,
ফাগুন – মাসে অশোক – ছায়ে
অলস প্রাণে শিথিল গায়ে
দখিন হতে বাতাসটুকু
তেমনি লাগে মিঠা ।
অনেক দিকেই যায় যে পাওয়া
অনেকটা সান্ত্বনা ,
যদিও রে নাইকো কোথাও
সে – সব বরাঙ্গনা ।
১১
এখন যাঁরা আছেন বর্তমানে
আছেন মর্তলোকে
মন্দ তারা লাগত না কেউ
কালিদাসের চোখে ।
পরেন বটে জুতা মোজা ,
চলেন বটে সোজা সোজা ,
বলেন বটে কথাবার্তা
অন্য – দেশীর চালে ,
তবু দেখো সেই কটাক্ষ
আঁখির কোণে দিচ্ছে সাক্ষ্য
যেমনটি ঠিক দেখা যেত
কালিদাসের কালে ।
মরব না ভাই , নিপুণিকা
চতুরিকার শোকে—
তাঁরা সবাই অন্য নামে
আছেন মর্তলোকে ।
১২
আপাতত এই আনন্দে
গর্বে বেড়াই নেচে—
কালিদাস তো নামেই আছেন ,
আমি আছি বেঁচে ।
তাঁহার কালের স্বাদগন্ধ
আমি তো পাই মৃদুমন্দ ,
আমার কালের কণামাত্র
পান নি মহাকবি ।
বিদুষী এই আছেন যিনি
আমার কালের বিনোদিনী
মহাকবির কল্পনাতে
ছিল না তাঁর ছবি ।
প্রিয়ে , তোমায় তরুণ আঁখির
প্রসাদ যেচে যেচে
কালিদাসকে হারিয়ে দিয়ে
গর্বে বেড়াই নেচে ।
সোজাসুজি
হৃদয় – পানে হৃদয় টানে ,
নয়ন – পানে নয়ন ছোটে ,
দুটি প্রাণীর কাহিনীটা
এইটুকু বৈ নয়কো মোটে ।
শুক্লসন্ধ্যা চৈত্র মাসে
হেনার গন্ধ হাওয়ায় ভাসে—
আমার বাঁশি লুটায় ভূমে ,
তোমার কোলে ফুলের পুঁজি ।
তোমার আমার এই – যে প্রণয়
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
বসন্তী – রঙ বসনখানি
নেশার মতো চক্ষে ধরে ,
তোমার গাঁথা যূথীর মালা
স্তুতির মতো বক্ষে পড়ে ।
একটু দেওয়া একটু রাখা ,
একটু প্রকাশ একটু ঢাকা ,
একটু হাসি একটু শরম—
দুজনের এই বোঝাবুঝি ।
তোমার আমার এই – যে প্রণয়
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
মধুমাসের মিলন – মাঝে
মহান কোনো রহস্য নেই ,
অসীম কোনো অবোধ কথা
যায় না বেধে মনে – মনেই ।
আমাদের এই সুখের পিছু
ছায়ার মতো নাইকো কিছু ,
দোঁহার মুখে দোঁহে চেয়ে
নাই হৃদয়ের খোঁজাখুঁজি ।
মধুমাসে মোদের মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
ভাষার মধ্যে তলিয়ে গিয়ে
খুঁজি নে ভাই ভাষাতীত ,
আকাশ – পানে বাহু তুলে
চাহি নে ভাই আশাতীত ।
যেটুকু দিই যেটুকু পাই
তাহার বেশি আর কিছু নাই—
সুখের বক্ষ চেপে ধরে
করি নে কেউ যোঝাযুঝি ।
মধুমাসে মোদের মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
শুনেছিনু প্রেমের পাথার
নাইকো তাহার কোনো দিশা ,
শুনেছিনু প্রেমের মধ্যে
অসীম ক্ষুধা অসীম তৃষা—
বীণার তন্ত্রী কঠিন টানে
ছিঁড়ে পড়ে প্রেমের তানে ,
শুনেছিনু প্রেমের কুঞ্জ
অনেক বাঁকা গলিঘুঁজি ।
আমাদের এই দোঁহার মিলন
নিতান্তই এ সোজাসুজি ।
স্থায়ী-অস্থায়ী
তুলেছিলেম কুসুম তোমার
হে সংসার , হে লতা !
পরতে মালা বিঁধল কাঁটা
বাজল বুকে ব্যথা ,
হে সংসার , হে লতা !
বেলা যখন পড়ে এল ,
আঁধার এল ছেয়ে ,
দেখি তখন চেয়ে—
তোমার গোলাপ গেছে , আছে
আমার বুকের ব্যথা ,
হে সংসার , হে লতা !
আরো তোমার অনেক কুসুম
ফুটবে যথা – তথা—
অনেক গন্ধ , অনেক মধু ,
অনেক কোমলতা ,
হে সংসার , হে লতা !
সে ফুল তোলার সময় তো আর
নাহি আমার হাতে ।
আজকে আঁধার রাতে
আমার গোলাপ গেছে , কেবল
আছে বুকের ব্যথা ,
হে সংসার , হে লতা !
স্বল্পশেষ
অধিক কিছু নেই গো কিছু নেই ,
কিছু নেই—
যা আছে তা এই গো শুধু এই ,
শুধু এই ।
যা ছিল তা শেষ করেছি
একটি বসন্তেই ।
আজ যা কিছু বাকি আছে
সামান্য এই দান—
তাই নিয়ে কি রচি দিব
একটি ছোটো গান ?
একটি ছোটো মালা তোমার
হাতের হবে বালা ।
একটি ছোটো ফুল তোমার
কানের হবে দুল ।
একটি তরুলতায় ব’সে
একটি ছোটো খেলায়
হারিয়ে দিয়ে যাবে মোরে
একটি সন্ধেবেলায় ।
অধিক কিছু নেই গো কিছু নেই ,
কিছু নেই ।
যা আছে তা এই গো শুধু এই ,
শুধু এই ।
ঘাটে আমি একলা বসে রই ,
ওগো আয় !
বর্ষানদী পার হবি কি ওই—
হায় গো হায় !
অকূল – মাঝে ভাসবি কে গো
ভেলার ভরসায় ।
আমার তরীখান
সইবে না তুফান ;
তবু যদি লীলাভরে
চরণ কর দান ,
শান্ত তীরে তীরে তোমায়
বাইব ধীরে ধীরে ।
একটি কুমুদ তুলে তোমার
পরিয়ে দেব চুলে ।
ভেসে ভেসে শুনবে বসে
কত কোকিল ডাকে
কূলে কূলে কুঞ্জবনে
নীপের শাখে শাখে ।
ক্ষুদ্র আমার তরীখানি—
সত্য করি কই ,
হায় গো পথিক , হায় ,
তোমায় নিয়ে একলা নায়ে
পার হব না ওই
আকুল যমুনায় ।
০১.উৎসর্গ (ক্ষণিকা)
ক্ষণিকারে দেখেছিলে
ক্ষণিক বেশে কাঁচা খাতায় ,
সাজিয়ে তারে এনে দিলেম
ছাপা বইয়ের বাঁধা পাতায় ।
আশা করি নিদেন – পক্ষে
ছ’টা মাস কি এক বছরই
হবে তোমার বিজন – বাসে
সিগারেটের সহচরী ।
কতকটা তার ধোঁয়ার সঙ্গ
স্বপ্নলোকে উড়ে যাবে—
কতকটা কি অগ্নিকণায়
ক্ষণে ক্ষণে দীপ্তি পাবে ?
কতকটা বা ছাইয়ের সঙ্গে
আপনি খসে পড়বে ধুলোয় ,
তার পরে সে ঝেঁটিয়ে নিয়ে
বিদায় কোরো ভাঙা কুলোয় ।
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর