- বইয়ের নামঃ ক্ষণিকা
- লেখকের নামঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
- প্রকাশনাঃ দি স্কাই পাবলিশার্স
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
অকালে
ভাঙা হাটে কে ছুটেছিস ,
পসরা লয়ে ?
সন্ধ্যা হল , ওই – যে বেলা
গেল রে বয়ে ।
যে যার বোঝা মাথার ‘ পরে
ফিরে এল আপন ঘরে ,
একাদশীর খণ্ড শশী
উঠল পল্লীশিরে ।
পারের গ্রামে যারা থাকে
উচ্চকণ্ঠে নৌকা ডাকে ,
হাহা করে প্রতিধ্বনি
নদীর তীরে তীরে ।
কিসের আশে ঊর্ধ্বশ্বাসে
এমন সময়ে
ভাঙা হাটে তুই ছুটেছিস
পসরা লয়ে ?
সুপ্তি দিল বনের শিরে
হস্ত বুলায়ে ,
কা কা ধ্বনি থেমে গেল
কাকের কুলায়ে ।
বেড়ার ধারে পুকুর – পাড়ে
ঝিল্লি ডাকে ঝোপে ঝাড়ে ,
বাতাস ধীরে পড়ে এল ,
স্তব্ধ বাঁশের শাখা—
হেরো ঘরের আঙিনাতে
শ্রান্তজনে শয়ন পাতে ,
সন্ধ্যাপ্রদীপ আলোক ঢালে
বিরাম – সুধা – মাখা ।
সকল চেষ্টা শান্ত যখন
এমন সময়ে
ভাঙা হাটে কে ছুটেছিস ,
পসরা লয়ে ?
অচেনা
কেউ যে কারে চিনি নাকো
সেটা মস্ত বাঁচন ।
তা না হলে নাচিয়ে দিত
বিষম তুর্কি – নাচন ।
বুকের মধ্যে মনটা থাকে ,
মনের মধ্যে চিন্তা—
সেইখানেতেই নিজের ডিমে
সদাই তিনি দিন তা ।
বাইরে যা পাই সম্জে নেব
তারি আইন – কানুন ,
অন্তরেতে যা আছে তা
অন্তর্যামীই জানুন ।
চাই নে রে , মন চাই নে ।
মুখের মধ্যে যেটুকু পাই
যে হাসি আর যে কথাটাই
যে কলা আর যে ছলনাই
তাই নে রে মন , তাই নে ।
বাইরে থাকুক মধুর মূর্তি ,
সুধামুখের হাস্য ,
তরল চোখে সরল দৃষ্টি—
করব না তার ভাষ্য ।
বাহু যদি তেমন করে
জড়ায় বাহুবন্ধ
আমি দুটি চক্ষু মুদে
রইব হয়ে অন্ধ—
কে যাবে ভাই , মনের মধ্যে
মনের কথা ধরতে ?
কীটের খোঁজে কে দেবে হাত
কেউটে সাপের গর্তে ?
চাই নে রে , মন চাই নে ।
মুখের মধ্যে যেটুকু পাই
যে হাসি আর যে কথাটাই
যে কলা আর যে ছলনাই
তাই নে রে মন , তাই নে ।
মন নিয়ে কেউ বাঁচে নাকো ,
মন বলে যা পায় রে
কোনো জন্মে মন সেটা নয়
জানে না কেউ হায় রে ।
ওটা কেবল কথার কথা ,
মন কি কেহ চিনিস ?
আছে কারও আপন হাতে
মন ব’লে এক জিনিস ?
চলেন তিনি গোপন চালে ,
স্বাধীন তাঁহার ইচ্ছে—
কেই বা তাঁরে দিচ্ছে এবং
কেই বা তাঁরে নিচ্ছে !
চাই নে রে , মন চাই নে ।
মুখের মধ্যে যেটুকু পাই
যে হাসি আর যে কথাটাই
যে কলা আর যে ছলনাই
তাই নে রে মন , তাই নে ।
অতিথি
ওই শোনো গো , অতিথ বুঝি আজ
এল আজ ।
ওগো বধূ , রাখো তোমার কাজ
রাখো কাজ ।
শুনছ না কি তোমার গৃহদ্বারে
রিনিঠিনি শিকলটি কে নাড়ে ,
এমন ভরা সাঁঝ !
পায়ে পায়ে বাজিয়ো নাকো মল ,
ছুটো নাকো চরণ চঞ্চল ,
হঠাৎ পাবে লাজ ।
ওই শোনো গো , অতিথ এল আজ
এল আজ ।
ওগো বধূ , রাখো তোমার কাজ
রাখো কাজ ।
নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয়
কভু নয় ।
ওগো বধূ , মিছে কিসের ভয়
মিছে ভয় !
আঁধার কিছু নাইকো আঙিনাতে ,
আজকে দেখো ফাগুন – পূর্ণিমাতে
আকাশ আলোময় ।
নাহয় তুমি মাথার ঘোমটা টানি
হাতে নিয়ো ঘরের প্রদীপখানি ,
যদি শঙ্কা হয় ।
নয় গো কভু বাতাস এ নয় নয়
কভু নয় ।
ওগো বধূ মিছে কিসের ভয়
মিছে ভয় !
নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে
পান্থ – সনে ।
দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে
দুয়ার – কোণে ।
প্রশ্ন যদি শুধায় কোনো – কিছু
নীরব থেকো মুখটি করে নীচু
নম্র দু – নয়নে ।
কাঁকন যেন ঝংকারে না হাতে ,
পথ দেখিয়ে আনবে যবে সাথে
অতিথিসজ্জনে ।
নাহয় কথা কোয়ো না তার সনে
পান্থ – সনে ।
দাঁড়িয়ে তুমি থেকো একটি কোণে
দুয়ার – কোণে ।
ওগো বধূ , হয় নি তোমার কাজ
গৃহ – কাজ ?
ওই শোনো কে অতিথ এল আজ
এল আজ ।
সাজাও নি কি পূজারতির ডালা ?
এখনো কি হয় নি প্রদীপ জ্বালা
গোষ্ঠগৃহের মাঝ ?
অতি যত্নে সীমান্তটি চিরে
সিঁদুর – বিন্দু আঁক নাই কি শিরে ?
হয় নি সন্ধ্যাসাজ ?
ওগো বধূ , হয় নি তোমার কাজ
গৃহ – কাজ ?
ওই শোনো কে অতিথ এল আজ
এল আজ ।
অতিবাদ
আজ বসন্তে বিশ্বখাতায়
হিসেব নেইকো পুষ্পে পাতায় ,
জগৎ যেন ঝোঁকের মাথায়
সকল কথাই বাড়িয়ে বলে ।
ভুলিয়ে দিয়ে সত্যি মিথ্যে ,
ঘুলিয়ে দিয়ে নিত্যানিত্যে ,
দু ধারে সব উদারচিত্তে
বিধিবিধান ছাড়িয়ে চলে ।
আমারো দ্বার মুক্ত পেয়ে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
প্রিয়ার পুণ্যে হলেম রে আজ
একটা রাতের রাজ্যাধিরাজ ,
ভাণ্ডারে আজ করছে বিরাজ
সকল প্রকার অজস্রত্ব ।
কেন রাখব কথার ওজন ?
কৃপণতায় কোন্ প্রয়োজন ?
ছুটুক বাণী যোজন যোজন
উড়িয়ে দিয়ে ষত্ব ণত্ব ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত ক’রে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
হে প্রেয়সী স্বর্গদূতী ,
আমার যত কাব্যপুঁথি
তোমার পায়ে পড়ে স্তুতি ,
তোমারি নাম বেড়ায় রটি ;
থাকো হৃদয় – পদ্মটিতে
এক দেবতা আমার চিতে—
চাই নে তোমায় খবর দিতে
আরো আছেন তিরিশ কোটি ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত ক’রে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।
ত্রিভুবনে সবার বাড়া
একলা তুমি সুধার ধারা ,
উষার ভালে একটি তারা ,
এ জীবনে একটি আলো—
সন্ধ্যাতারা ছিলেন কে কে
সে – সব কথা যাব ঢেকে ,
সময় বুঝে মানুষ দেখে
তুচ্ছ কথা ভোলাই ভালো ।
চিত্তদুয়ার মুক্ত রেখে
সাধুবুদ্ধি বহির্গতা ,
আজকে আমি কোনোমতেই
বলব নাকো সত্য কথা ।