পান্নাভাবী কথা বলেই যাচ্ছেন। বলেই যাচ্ছেন। আমি শুনছি। পান্নাভাবীর মুখ থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না। এই মহিলা যে এত রূপবতী তা আগে কখনো লক্ষ্য করিনি। এরকম একটা ব্যাপার ওদের চোখ এড়িয়ে গেল কি করে বুঝতে পারছি না।
.
০৬.
মামুনদের অফিসের মেয়েটি আমাকে চিনল। হাসি মুখে বলল, ও আপনি এসেছেন? আমি মাথা নাড়লাম। আজ মঙ্গলবার। দশটা এখনো বাজে নি। ছসাত মিনিট বাকি আছে। মামুন আমাকে সকাল দশটায় আসতে বলেছে। রীতিমত এপয়েন্টমেন্ট করে আসা।
মেয়েটি বলল, আপনি চলে যান। স্যার ঘরে একা আছেন।
দশটাতো এখনো বাজে নি।
না বাজুক ঢুকে যান।
মামুনের ঘর অন্ধকার। বড় সাহেবদের কামরায় আলো কম থাকার নিয়ম। আলো কম মানেই রহস্য। বড় সাহেবরা চারদিকে রহস্য রাখতে পছন্দ করেন। মামুন বলল, এসো এসো। আমি বললাম, ভাল আছ?
হ্যাঁ ভাল আছি। তিন পাউন্ড ওজন পর্যন্ত বেড়েছে। ঐ দিন তোমাকে দেখা করতে দেইনি– মেজাজ খুব খারাপ ছিল –তার চেয়ে বড় কথা অন্য একটা এপয়েন্টমেন্ট ছিল।
সাফাই দেবার দরকার নেই।
সাফাই গাইছি না। যেটা সত্যি সেটা বলছি। মালয়েশিয়ার সঙ্গে কোলাবোরেশনে আমার ইন্ডাসট্রি। ওদের একজন রিপ্রেজেনটেটিভ এসেছিলেন। এসেই নানান ফ্যাকড়া। প্রথম দিনেই বললেন –তার লোনলি লাগছে একজন কোম্পেনিয়ন পেলে ভাল হয়। কোম্পেনিয়ন কি আশাকরি বুঝতে পারছ।
পারছি।
সোহারওয়ার্দি উদ্যানের কুড়ি টাকা রোটের কোন মেয়েকে নিয়ে দিলেতো হবে না –আমার এমন মেয়ে দরকার হোটেল সোনারগায়ে থেকে যার অভ্যাস আছে। যে ইংরেজি বলতে পারে। ইন্টারেস্টিং কনভারসেসান চালাতে পারে। বিছানাতেও যার পারফরমেন্স চমৎকার …
আমাকে এসব কেন শুনাচ্ছ?
শুনতে ভাল লাগছে না?
না।
শোন এই গল্পের শেষটা খুব ইন্টারেস্টিং। গল্পের শুরু ভাল না লাগলেও –শেষটা ভাল লাগবে। যাই হোক ভদ্রলোকের জন্যে একজন কোম্পেনিয়ন জোগাড় করে দিলাম। আমি মেয়েটিকে খুব ভালমত চিনি। কোম্পেনিয়ান হিসেবে এরচে ভাল কিছু কল্পনাও করা যায় না। সমস্যা দেখা দিল তারপর।
কি সমস্যা?
মামুন হাসতে হাসতে বলল, এই দেখ তুমিও এখন আগ্রহ বোধ করছ গল্প শুনতে চাচ্ছ — যাই হোক শোন সেই মালয়েশিন তার কোম্পেনিয়ান পেয়ে এতই আনন্দিত আমাকে টেলিফোন করে বলল –এই মেয়েটিকে বিয়ে করে সে দেশে নিয়ে যেতে চায়। এই টেলিফোনটা পেলাম তোমার স্লীপ পাঠানোর দশ মিনিট আগে। ব্যাটা টেলিফোনেই কেঁদে ফেলে এমন অবস্থা– রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। তুমি ফুর্তি করতে চাও –ফুর্তি কর উটাস ঝামেলা কেন? আর তুমি চাইলেই ঐ মেয়ে তোমাকে বিয়ে করবে কেন? মেয়েটার স্বামী আছে, সংসার আছে।
স্বামী সংসার আছে?
অবশ্যই আসে। পারিবারিক জীবনে এইসব মেয়েরা সুখী ধরণের হয়। সুখ প্রধানত আছে অর্থনৈতিক মুক্তি থেকে। এইসব মেয়েদের অর্থনৈতিক মুক্তি থাকে। শরীরকে মন্দির মসজিদ ভাবলে চলে না। শরীর হচ্ছে শরীর। শরীরের আবার পবিত্রতা কি?
তুমি এসব আমাকে কেন শুনাচ্ছ?
কেন শুনাচ্ছি নিজেও জানি না। যাই হোক কেন এসেছ বল।
টুকুনের জন্যে এসেছি। ও এখন কোথায়?
আগে যেখানে ছিল সেখানেই আছে তবে শিগগীরই দেশে আসছে।
আমার সঙ্গে কিছুদিন ওকে থাকতে দেবে?
কিছুদিন না। ঘন্টা খানিক কিংবা ঘন্টা দুই ওর সঙ্গে কাটাতে চাইলে কাটাবে। মা-ছেলের কঠিণ ভালবাসাকে এড়াতে চাই –সেই জন্যেই এই ব্যবস্থা।
টুকুন কবে আসবে?
একজাক্ট ডেট জানি না। ও এলে অবস্থা বুঝে তোমাকে খবর দেব। রিসিপশনিষ্ট মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেব। ওর নাম –তপতী। সুন্দর নাম না?
হ্যাঁ।
মালয়েশীয়ান ব্যাটা যে মেয়ের জন্যে পাগলের মত হয়ে আছে –তপতী হচ্ছে সেই মেয়ে।
এই জাতীয় মেয়ে তাহলে তোমার হাতের কাছেই থাকে?
রাখতে হয়। রাত্রি তুমি কি আমার সঙ্গে লাঞ্চ করবে? না।
অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভাল লাগছে –এই জন্যে বলছি। বন্ধু হতেতো বাধা নেই।
বাধা আছে। আমি উঠব।
বোস আরেকটু বোস। দুটা কথা বলি মন দিয়ে শোন –স্ত্রী হিসেবে তুমি চমৎকার। ইচ্ছে করলে তুমি আবারো আমার কাছে ফেরত আসতে পার। একটাই শর্ত — আমাকে আমার মত থাকতে দিতে হবে।
তোমার কাছে ফিরে যাবার আমার কোন ইচ্ছা নেই।
একদিন ইচ্ছা হবে তখন আর সময় থাকবে না। আমি বিয়ের কথা ভাবছি। তোমার সন্ধানে কোন ভাল মেয়ে আছে?
কি রকম মেয়ে চাও? এমন কেউ যাকে কখনো কোন পুরুষ স্পর্শ করে নি?
মামুন শব্দ করে হাসতে লাগল। আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, আমার সন্ধানে তেমন কেউ নেই –আর থাকলেও জেনেশুনে তোমার কাছে পাঠাতাম না।
মামুন বলল, টুকুনের কিছু রিসেন্ট ছবি এসেছে –তুমি দেখতে চাও?
না। ছবি দেখব না। আমি ওকেই দেখব।
মামুনের ঘর থেকে বের হতেই তপতী বলল –স্যারের সঙ্গে কথা শেষ হয়েছে?
আমি মাথা নাড়লাম।
তপতী মিষ্টি করে হাসল। মেয়েটার হাসি এত সুন্দর। এত পবিত্র।
.
০৭.
ভোরবেলা সত্যি সত্যি বীনু মেয়েটি এসে উপস্থিত। পান্নাভাবী মেয়েটিকে আমার কাছে এনে বললেন –এ হল বীনু, আমার দূরসম্পর্কের আত্মীয় –আমার এখানে বেড়াতে এসেছে। আমি আবার আজ সারাদিন একটা কাজে ব্যস্ত থাকব। বাইরে যেতে হবে। রাত্রি, তোমার সঙ্গে ও খানিকক্ষণ থাকুক, তারপর চলে যাবে।
আমি মুগ্ধ হয়ে পান্নাভাবীর বানানো কথা শুনছি। মেয়েটিকে কি জন্যে এখানে আনা হয়েছে তা সে যেমন জানে আমিও জানি। মাঝখানের এই মিথ্যা কথাগুলির প্রয়োজন কি ছিল? মেয়েটি খুব অস্বস্তি বোধ করছে। সংকোচে এতটুকু হয়ে গেছে। চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না। সে নিচু হয়ে আমার পা ছুঁয়ে সালাম করতে গেল। আমি কপ করে তার হাত ধরে ফেললাম।