রাণী গালাগালি গায়ে মাখছে না। সে ইস্ত্রি করে যাচ্ছে। পান্নাভাবীর গলার স্বর উঁচু থেকে উঁচুতে উঠছে। আমি তাদের এই অবস্থায় রেখে চলে এলাম।
আমার নিজেরই অনেক সমস্যা, অন্যের সমস্যায় জড়িয়ে পড়ার কোন কারণ নেই। চলে আসার সময় নাজমুল ভাইকে দেখে খুব মায়া লাগল। কেমন জবুথবু হয়ে বসে আছেন। তাঁকে জড় পদার্থের মত লাগছে। আমি বললাম, নাজমুল ভাই, যাচ্ছি। তিনি চোখ তুললেন না। মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
.
সেই রাতে এক কাণ্ড হল। রাত দশটার মত বাজে। আমি ছাদে হাঁটতে গেছি। ছাদে হাঁটা আমার নিত্যদিনের অভ্যাস না। মাঝে মাঝে যাই। আমাদের ছাদটা তেমন সুন্দর না –ছাদে ওঠার সিঁড়িটাও সরু এবং অন্ধকার। তার চেয়েও বড় কথা –ছাদের না-কি কি একটা দোষ আছে। অনেকেই ছাদে লম্বা লম্বা মানুষ হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছে। মা বেঁচে থাকা অবস্থায় কখনোই একা আমাকে ছাদে আসতে দিতেন না। এখন মাঝে মাঝে আসি। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা সিঁড়িঘরের কাছে এসে ব্যস্ত হয়ে আমাকে ডাকতে থাকেন, রাত্রি, নেমে আয় তো মা। নেমে আয়।
আজও তাই হল। ছাদে কিছুক্ষণ হাঁটার পরই বাবা এসে ডাকলেন, নেমে আয় তো মা। আমি বললাম, আমি নামব না বাবা, তুমি উঠে এসো।
বাবা বললেন, নাজমুল সাহেব তোকে খোঁজ করছেন। উনার স্ত্রী সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছেন, এখনো ফেরেননি। ভদ্রলোক খুব অস্থির হয়েছেন।
অস্থির হলে আমি কি করব? আমি তো জানি না ইনি কোথায়?
তোর সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছেন, নেমে আয় না।
নাজমুল ভাই আমাদের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। সকালের সেই জবুথবু ভাব আরো বেড়েছে পান্নাভাবী না ফেরায় তিনি যে খুব চিন্তিত সেটা বোঝা যাচ্ছে। কথাও ঠিকমত বলতে পারছেন না, জড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে বললেন, ও বাইরে গেলে কখনো একঘণ্টা-আধঘণ্টার বেশি থাকতে পারে না। আজ কি ব্যাপার কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি জান কোথায় গিয়েছে?
কোথায় গিয়েছেন আমি জানি –রাণীর প্রেগনেন্সি টেস্টের রিপোর্ট আনতে। কিন্তু সেই কথা নাজমুল ভাইকে বলা যায় না। আমি চুপ করে রইলাম।
নাজমুল ভাই প্রায় অস্পষ্ট স্বরে বললেন, আমাকে নিয়ে ওর নানা সন্দেহ। অকারণ সব সন্দেহ। আমি জানি তোমাকে সে সব বলেছে –এই জন্যেই প্রসঙ্গটা বললাম। তুমি কি না কি ভাবছ ….
আমি কিছুই ভাবছি না।
ও এরকম ছিল না। বিয়ের পর পর ওর জরায়ুতে টিউমার ধরা পড়ল। ডাক্তাররা জরায়ু কেটে বাদ দিল। তারপর থেকে ওর ধারণা হয়েছে, যেহেতু তার কোনদিন বাচ্চা-কাচ্চা হবে না সেহেতু আমার কাছে তার কোন দাম নেই। তখন থেকেই সন্দেহ-রোগ। তুমি কিছু মনে করো না।
আমি কিছু মনে করছি না। আপনি আমাকে নিয়ে কোন চিন্তা করবেন না।
ওর সন্দেহটা তুমি ক্ষমার চোখে দেখো। সাইকোলজিক্যাল সমস্যা। ভাল কোন সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখাতে চাই –ওকে সেই কথাটা বলারও সাহস নেই –হুঁট করে রেগে উঠবে। রাত্রি, তোমার কাছে আমি খুব লজ্জিত।
আমার কাছে লজ্জিত কেন?
উনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন –ওর সবচে বড় সন্দেহ তোমাকে নিয়ে। ওর ধারণা, তুমি স্বামী-সংসার ছেড়ে এ বাড়িতে চলে এসেছ শুধুই আমার কারণে।
সে কি?
তোমাদের বাড়ি ছেড়ে আমি অন্য কোথাও বাসা ভাড়া নিতে চেয়েছিলাম, সে তাও করতে দেবে না। আমি কি যে বিপদে পড়েছি সেটা শুধু আমি জানি। কাল রাতে তোমার সঙ্গে কথা হয়েছে– সে শুনে ফেলেছে, তারপর থেকে মাথা খারাপের মত হয়ে গেছে।
আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। অবাক হয়ে দেখছি ভদ্রলোকের চোখে পানি এসে গেছে। তিনি চোখের পানি গোপন করার চেষ্টা করলেন না। চোখ মুছলেন। শান্ত গলায় বললেন, ও যদি জানতো তাকে আমি কতটা ভালবাসি তাহলে এইসব পাগলামী সে করতো না। সেটা জানানোর বুদ্ধি কি তাও আমি জানি না। ওর বাচ্চা-কাচ্চা হবে না তাতে কি হয়েছে? ওকে আমি ওর জন্যেই ভালবাসি।
দোতলার দক্ষিণের বারান্দা থেকে রাণী উৎফুল্ল গলায় বলল, আম্মা আসছেন। এই অক্ষণ বেবীটেক্সী থাইক্যা নামছেন।
নাজমুল ভাই তাঁর ঘরে যাচ্ছেন। আমি যাচ্ছি তাঁর পেছনে পেছনে। কি ব্যাপার জেনে আসা যাক।
পান্নাভাবী আমাকে দেখে আনন্দিত গলায় বললেন, বাবলুর জন্যে এত দেরি হল। ওর জন্যে মেয়ে দেখতে নানান জায়গায় গেলাম। একটির সঙ্গে কথাবার্তা মোটামুটি বলে এসেছি। কাল এ বাড়িতে নিয়ে আসব। তুমি দেখ পছন্দ হয় কিনা। মেয়ের একটাই শুধু ডিফেক্ট– গায়ের রঙ শ্যামলা।
আমি বললাম, যে রিপোর্টের জন্যে গিয়েছিলেন সেই রিপোর্ট কি?
পান্নাভাবী গম্ভীর গলায় বললেন, রিপোর্ট কিছু পাওয়া যায়নি। তোমার ভাই তো আর বোকা না। এত কাঁচা কাজ করবে না। প্রপার প্রিকশান নিয়ে মাঠে নামবে। করেছেও তাই। ভাল কথা –মেয়েটার নাম বীনু। ওরা পাঁচ বোন, সে হচ্ছে সবচে বড়। কোন ফ্যামিলিতে অনেকগুলি মেয়ে যদি থাকে তাহলে বড় মেয়েটা হয় সবচে ভাল। তাকে সংসার দেখতে হয়, বোনদের মানুষ করতে হয়– এইসব করতে করতে ওরা খুব কাজের মেয়ে হয়। বীনু এবার লালমাটিয়া কলেজে বি. এ. পড়ছে। তার বাপ-মা এখনি বিয়ে দিতে চায়। অনেকগুলি মেয়ে তো এখন থেকে পার করা না ধরলে সমস্যা। ওদের সংসারের অবস্থাও নড়বড়ে। দিনে আনি দিনে খাইয়ের চেয়েও খারাপ।