তা তো রাখতেই হবে। আপা, তুই কি আমার পার্টনার হবি?
না।
তোর কি সত্যি দশ লাখ টাকা আছে?
আছে, এক কথা কবার বলব।
টাকাটা রেখেছিস কোথায়? ব্যাঙ্কে?
ব্যাঙ্ক ছাড়া কোথায় রাখব? তোষকের নিচে তো রাখতে পারি না। ফিক্সড ডিপোজিটে রাখা আছে।
ভাল। ফিক্সড ডিপোজিটে রাখাই ভাল।
বাবলু আরাম করে সিগারেটে টান দিচ্ছে। ওর দিকে তাকিয়ে আমার মায়াই লাগছে। ওর এত কম বুদ্ধি! বিশ্বাস করে ফেলেছে যে আমার দশলাখ টাকা আছে। কি করে বিশ্বাস করতে পারল? একবারও ভাবল না, এতগুলি টাকা কোত্থেকে আসবে?
বাবলু নাশতা শেষ করে আমার সঙ্গে উঠে এল। আমি তাকে দু হাজার টাকা দিলাম। সে হতভম্ব গলায় বলল, মাত্র দু হাজার?
দু হাজারের বেশি টাকার এখন তো তোর দরকার নেই। এই টাকাটা তো তুই রিকশা ভাড়াতেই খরচ করবি –এই টাকাটা দিয়ে তো তুই আর ভিডিও ইউনিট কিনতে যাবি না।
তা ঠিক।
হিসাবপত্র তুই কিন্তু লিখে রাখবি।
অবশ্যই লিখে রাখব।
আর শোন, এগারোটার সময় তোর কি সব দালাল-ফালালের বাবার সঙ্গে দেখা করার কথা –ওরা যেন না আসে।
আচ্ছা, ওদের বলে দেব।
আরেকটা কথা শোন বাবলু, বাড়ি আমরা বিক্রি করব কেন? দরকার হলে বাড়ি ভেঙে নিজেরাই মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং করব। মাটির নিচে থাকবে পার্কিং স্পেস। একতলায় তোর ভিডিও ইউনিট। দোতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত ফ্ল্যাট।
বাবলু চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছে না, আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। সে ইতস্তত করে বলল, পুরো একতলাটা ভিডিও ইউনিট হবে?
তোর প্রয়োজন হলে হবে। প্রয়োজন না হলে দোকানপাট হতে পারে।
আমার পুরোটাই লাগবে। ভিডিও ইউনিটের সঙ্গে আমার একটা ফটোগ্রাফির দোকানও থাকবে। স্টিল ফটোগ্রাফি।
স্টিল ফটোগ্রাফির ব্যবসা কি আর ভাল হবে? স্টুডিওতে আজকাল কেউ ছবি তুলতে যায়? ছবি যা তোলার ঘরেই তুলে।
বাবলু উৎসাহের সঙ্গে বলল ফটোগ্রাফি ব্যবসার তুই কিছুই জানিস না। ঢাকা শহরে পাসপোর্ট সাইজ ছবি কতগুলি তোলা হয় তুই জানিস? ইউনিভার্সিটি এডমিশন টেস্টে লাগে, কলেজে লাগে, স্কুলে লাগে, যে কোন এপ্লিকেশনে লাগে। এমনকি মরার পরে কবর দেয়ার জন্যে লাগে—পাসপোর্ট সাইজ ছবি তো তুই আর ঘরে বসে তুলতে পারবি না –স্টুডিওতে গিয়ে তুলতে হবে।
মরা মানুষ স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলবে কি ভাবে?
পুরানো পাসপোর্ট সাইজ ছবি দিয়ে ওদের কাজ সারতে হবে।
ও আচ্ছা।
স্টুডিওর ব্যবসা হল –এই যুগের সবচে রমরমা ব্যবসা।
বেশ তো। তুই তাহলে একটা স্টুডিওর ব্যবস্থাও রাখ।
রাখতেই হবে, উপায় নেই। সারভাইভেলের জন্যে রাখতে হয়।
বাবলু আনন্দিত মুখে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। বাবার সঙ্গে সে সহজভাবে কথাবার্তা বলবে। দুহাজার টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার মেজাজ কিছু দিনের। জন্যে ঠাণ্ডা থাকবে।
বাবলু ঠিকই নিচে বাবার সঙ্গে কথা বলছে। বাবলুর গলাই শুধু শুনছি। বাবা হা হুঁ করে যাচ্ছেন। বাবলু বলছে –বাবা, ঠিক করেছি বাড়ি অন্যের কাছে বিক্রি করব না। যা করার নিজেরাই করব। এগারোটার সময় দালাল পার্টি চলে আসবে। আমি তো আর থাকব না –আমার অন্য কাজ আছে। আপনি ওদের বলে দেবেন –পথ দেখ।
আচ্ছা।
বলবেন– কথাবার্তা যা বলার আমার ছেলের সঙ্গে বল– সংসার এখন আমার ছেলেই দেখছে। আমি এখন ওল্ডম্যান, রিটায়ার্ড করেছি –আল্লা-বিল্লা নিয়ে থাকি ….।
আচ্ছা যা, বলব।
কিছু কিছু মানুষের সুখী হবার ক্ষমতা দেখলে ঈর্ষায় গা জ্বলে। বাবলু তাদের একজন। প্রতিদিন অন্তত কয়েকবার সে নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ ভাবে। এরচে আনন্দময় ব্যাপার আর কি হতে পারে!
.
বাবুল চলে যেতেই বাবা বললেন, রাত্রি মা, তোর কথাটা নিয়ে আমি খুব ভাবছি। কাল অনেক রাত পর্যন্ত ভাবলাম।
কোন কথাটা বাবা?
ঐ যে বাবলুকে বিয়ে দেবার কথা বললি –নতুন একজন মানুষ এলে সংসারের সৌন্দর্য বাড়ে। তোরও একজন সঙ্গি হয়।
আমার সঙ্গির চেয়ে বড় কথা তোমার সঙ্গি হয়। তোমারই কথা বলার লোক দরকার।
বাবা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, কথা হচ্ছে –বাবলুকে কে মেয়ে দেবে? কার এতো দায় পড়েছে? তাছাড়া লুকোছাপা করে তো বিয়ে দেয়া যাবে না। ছেলে যে কি চিজ সেটা আগেভাগেই বলে নিতে হবে। তার তো গুণের অভাব নেই।
পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দেব –পরপর তিনবার আই এ, ফেল পাত্রের জন্য সুন্দরী, শিক্ষিতা, গৃহকর্মে নিপুণা সদ্বংশজাত পাত্রী প্রয়োজন। পাত্রের নেশাভাং করার সামান্য অভ্যাস আছে। মেজাজ খারাপ হলে সে করে না এমন জিনিস নেই। হৈ-চৈ, ভাংচুর, মারামারি তার মধ্যে অন্যতম। পাত্রের ভাল দিকের মধ্যে একটি হল –পাত্রের বাবা এই পৃথিবীর সেরা মানুষদের একজন।
বাবা হেসে ফেললেন। অনেকদিন পর তাকে হাসতে দেখলাম। হাসি ভয়ংকর ছোঁয়াচে, আমি নিজেও হাসছি। দুজনই হাসছি বেশ শব্দ করে। আমাদের হাসির শব্দ শুনেই বোধহয় দক্ষিণের বারান্দায় পান্নাভাবী এসে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বারান্দায় কাপড় শুকাতে দিচ্ছেন। কাপড় শুকাতে দেয়ার ব্যাপারটা তাঁর অজুহাত। তিনি আমাদের হাসি শুনে বারান্দায় এসেছেন দেখার জন্যে যে কি হচ্ছে। আমরা যতক্ষণ হাসাহাসি করব ততক্ষণ তিনি বারান্দাতেই থাকবেন। নড়বেন না।
বাবা!
কি রে মা?