বোঝার চেষ্টা করছি। আমার বুদ্ধি কম। সহজে কিছু বুঝি না।
আমার ধারণা আপনাদের শেখ মুজিবের মাথায়ও গান্ধী-টাইপ চিন্তা-ভাবনা আছে। অসহযোগ আন্দোলন করে জেল টেল খেটে দেশ স্বাধীন করে ফেলা। পুরোপুরি স্বাধীন করা যদি সম্ভব নাও হয়, তাতেও আপাতত চলবে। কনফেডারেশন, ইউনাইটেড স্টেটস। পাকিস্তানের যে এই অবস্থা হবে, সেটা কিন্তু তখনকার নেতারা ঠিকই বুঝেছিলেন। মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ তো দুই পাকিস্তান হচ্ছে জেনে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন–পোকায় কাটা পাকিস্তান দিয়ে আমি কী করব?
মোবারক হোসেন বললেন, মানুষ তো বদলায়।
জোহর সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অবশ্যই বদলায়। পরিস্থিতি মানুষকে বদলায়। ভয়াবহ ডাকাত হয়ে যায় নিজাম আউলিয়া। বিরাট সাধু সন্ত হয়ে যায় ভয়াবহ খুনি। সমস্যাটা এইখানেই। আপনার চা খাওয়া দেখে মনে হয়েছে আপনি খুবই আরাম করে চা খেয়েছেন। আরেক কাপ খাবেন?
জি খাব ।
বক্তৃতা শুনতে যাবেন না?
কী বক্তৃতা?
পল্টনে আজ মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা আছে। আমার ধারণা এটা হবে
খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা। শোনা দরকার।
মোবারক হোসেন বললেন, আমি বক্তৃতা শুনি না। বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার ডিউটি শেখ সাহেবের বাড়িতে। ডিউটির জায়গা ছেড়ে যেতে পারব না।
জোহর দ্বিতীয় সিগারেট ফেলে দিয়ে তৃতীয়টি ধরাতে ধরাতে বলল, আপনি আসলে কার ডিউটি করছেন বলুন তো?
মোবারক হোসেন জবাব দিতে পারলেন না।
জোহর হালকা গলায় বলল, আপনি এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন না। কারণ জবাব আপনার নিজেরই জানা নেই। আমার জানা আছে। পুরো বাঙালি জাতি এখন একজনের ডিউটি করছে। সেই একজনের নাম শেখ মুজিব। আমি বিহারি না হয়ে বাঙালি হলে বিষয়টা এনজয় করতাম।
মোবারক হোসেন বত্ৰিশ নম্বর বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ এই বাড়িতে অন্যদিনের চেয়েও অনেক ভিড়। লোক আসছেই। বাড়ির সামনের রাস্তােটা যেন নদী হয়ে গেছে। নদীতে মানুষের স্রোত। নদীতে যেমন ঢেউ উঠে এখানেও উঠছে। কখনো মানুষ বাড়ছে কখনো কমছে। মোবারক হোসেনের মানুষের এই প্রবল বেগবান স্রোত দেখতে ভালো লাগছে। হঠাৎ তাঁর মনে হলো তার তিন মেয়েকে নিয়ে এলে ভালো হতো। এরা হয়তোবা মজা পেত। এরা কখনো ঘর থেকে বের হয় না। এ ধরনের দৃশ্য কখনো দেখে না। এত কাছে বাড়ি। একবার নিয়ে এলে হয়।
এই তুই কী করছিস? আছিস কেমন?
মোবারক হোসেন চমকে উঠলেন। শেখ মুজিব দল বল নিয়ে বের হচ্ছেন।
মোবারক হোসেনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ হাসি হাসি।
স্যার, ভালো আছি।
তোর মেয়ে তিনটা ভালো আছে? কী যেন তাদের নাম–মরিয়ম, মাসুমা, মাফরুহা? নাম ঠিক হয়েছে?
জি স্যার, ঠিক হয়েছে।
আজ মাওলানা ভাসানী পল্টনে বক্তৃতা করবেন। শুনতে যাবি না? শুধু আমার কথা শুনলে হবে? অন্যদের কথাও শুনতে হবে।
শেখ মুজিব এগিয়ে গেলেন। মোবারক হোসেন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। তাঁর তিন মেয়ের নাম এই মানুষটা একবার মাত্র শুনেছেন। এখনো নাম মনে আছে। এই ক্ষমতাকে শুধু বিস্ময়কর বললেও কম বলা হয়।
মাওলানা ভাসানীর বক্তৃতা শোনার কোনো আগ্রহ মোবারক হোসেন বােধ করছেন না। তারপরেও তিনি বক্তৃতা শুনতে গেলেন। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, তিনি তাঁর দুই মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। তিনজনকেই নেবার শখ ছিল। বড়টিকে বাড়িতে পাওয়া গেল, না; সে কাউকে কিছু না বলে কোথায় না-কি গেছে। মোবারক হোসেন ঠিক করে রেখেছেন, এ ধরনের কর্মকাণ্ডের উচিত শাস্তি সে পাবে। যথাসময়ে পাবে। বড় ময়ের বিয়ে হয়ে গেছে, তাতে কী? মেয়ে তো এখনো তার সঙ্গে থাকে। যতদিন মেয়ে তার বাড়িতে থাকবে, ততদিন তাকে বাড়ির নিয়মকানুন মানতে হবে।
মাসুমা এবং মাফরুহা দুজনেই ভয়ে অস্থির। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ায় কোনো আনন্দ নেই। আমরা কোথাও যাব না বলাও সম্ভব না। দুজনেই খুব মন খারাপ করে বাড়ি থেকে বের হলো। তারা খানিকটা ভয়ও পাচ্ছে। বাবা বলেন নি তাদের কোথায় নেয়া হচ্ছে। বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানবে সেই সাহসও তাদের নেই।
মোবারক হোসেন রিকশা নিলেন। ছোট মেয়েটিকে বসালেন নিজের কোলে। মাফরুহাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। কেন্দেই ফেলত, অনেক কষ্টে সে চোখের জল আটকে রাখছে।
মোবারক হোসেন বললেন, হাতে এখনো সময় আছে, তোরা আইসক্রিম খাবি?
দুজনই চাপা গলায় বলল, না।
খাবি না কেন? আয় আইসক্রিম কিনে দেই।
মোবারক হোসেন বেবি আইসক্রিমের দোকানে গিয়ে দুমেয়েকে আইসক্রিম কিনে দিলেন। দুজনই খুবই আগ্রহের সঙ্গে আইসক্রিম খাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগছে। মোবারক হোসেন সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, শেখ সাহেব তোদের তিন বোনেরই নাম জানেন। আজকেও তোদের কথা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। তোরা কেমন আছিস জানতে চাইলেন।
মাসুম ভয়ে ভয়ে বলল, আমাদেরকে উনি কীভাবে চেনেন?
মোবারক হোসেন বললেন, সে বিরাট ইতিহাস। জানার দরকার নাই। তাড়াতাড়ি আইসক্রিম শেষ কর। বক্তৃতা শুরু হয়ে গেছে।
মাসুমা অবাক হয়ে বলল, কিসের বক্তৃতা?
মোবারক হোসেন জবাব দিলেন না। মেয়েদের সঙ্গে এত কথা বলতে তার ভালো লাগে না।
পল্টনের মাঠের জনসমুদ্রে মাওলানা বললেন–
তের বছর আগে কাগমারী সম্মেলনে আমি আসসালামু আলাইকুম বলেছিলাম। মরহুম শহীদ সোহরাওয়ার্দী তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি হয়েও সেদিন আমার কথা অনুধাবন করতে পারেন নাই। কারণ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে দুই অংশ যদি একত্রে থাকে তাহলে কালব্যাধি যক্ষ্মার জীবাণু যেমন দেহের হৃৎপিণ্ডের দুই অংশকে নিঃশেষ করে দেয়, তেমনি পাকিস্তানের দুই অংশই বিনষ্ট হবে। তাই বলছিলাম যে তোমরা তোমাদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করো এবং আমরা আমাদের জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করি। লাকুম দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন। শেখ মুজিবর রহমান আজ ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এসেছে। আমি সাত কোটি বাঙালিকে আজ মোবারকবাদ জানাই এ জন্যে যে তারা এই বৃদ্ধের তের বছর আগের কথা এতদিন পর অনুধাবন করতে পেরেছে।