এই ভোরবেলাতে শেখ সাহেবের বাড়িতে অনেক লোকজন। টঙ্গি থেকে শ্রমিকদের একটা দল এসেছে মাথায় লাল ফেট্টি বেঁধে। তারা ফজরের ওয়াক্তের আগে এসে জয় বাংলা জয় বাংলা বলে প্ৰচণ্ড স্লোগান শুরু করেছিল। মনে হয় তারা তাদের গলার সমস্ত জোর সঞ্চয় করে রেখেছে শেখ সাহেবের বাড়িতে একটা হুলুস্কুল করার জন্যে। স্লোগান শুনে ভয় পেয়ে কাকের দল উড়াউড়ি শুরু করল। মোবারক হোসেন তাদের দলপতির কাছে গিয়ে বললেন, শেখ সাহেব নামাজ পড়ছেন। এখন কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
দলপতি (তার অত্যন্ত বলশালী চেহারা। মুখভর্তি পান। গলায় সোনার চেইন) রাগী গলায় বললেন, আপনি কে?
মোবারক হোসেন বললেন, আমি কেউ না।
আমি কেউ না বলাতে একটা রহস্য আছে। বলার ভঙ্গি সামান্য পরিবর্তন করে আমি কেউ না বলেও বুঝিয়ে দেয়া যায়–আমি অনেক কিছু। মোবারক হোসেন সেটা বুঝিয়ে দিলেন।
দলপতি পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন, আমি টঙ্গি শ্রমিক লীগের সভাপতি। আমার নাম ইসমাইল মিয়া। শেখ সাহেব আমারে চিনেন। আমার বাড়িতে একবার খানা খেয়েছেন।
মোবারক হোসেন বললেন, শুনে খুশি হলাম।
আছে? আমরা কেউ নাশতা করি নাই।
টিফিনের কোনো ব্যবস্থা নাই।
শেখ সাব নিচে নামবেন কখন?
সেটা তো ভাই উনি জানেন।
আপনি এখানকার কে? কোন দায়িত্বে আছেন?
আমি কোনো দায়িত্বে নাই। আমি তো আপনাকে আগেই বলেছি–আমি কেউ না।
জোহরকে দেখা যাচ্ছে এই দলটির আশেপাশে ঘুরঘুর করতে। সে দুবার তাকাল মোবারক হোসেনের দিকে। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে না। সে মোবারক হোসেনকে চিনতে পারছে। তাহলে এমন কি হতে পারে যে, এই লোক জোহর না? তার মতো চেহারার অন্য কেউ?
মোবারক হোসেন এগিয়ে গেলেন। যা সন্দেহ করা হয়েছিল। তাই। এই লোক জোহরা। মোবারক হোসেনকে দেখে হাসল। পরিচিতের হাসি এবং আনন্দের হাসি। যেন হঠাৎ দেখা হওয়ায় খুশি হয়েছে।
মোবারক হোসেন বললেন, কেমন আছেন?
জোহর বলল, ভালো।
এখানে কী জন্যে এসেছেন?
দেখতে আসছি। কোনো বিহারি শেখ সাহেবকে দেখতে আসতে পারবে না, এমন আইন কি শেখ সাহেব পাশ করেছেন?
এতক্ষণ হয়ে গেছে আপনাকে তো সিগারেট ধরাতে দেখলাম না।
শেখ সাহেবের বাড়িতে সিগারেট খাব! এত বড় বেয়াদবি তো করতে পারি না। আমি আর যাই হই বেয়াদব না।
গরমের সময় চাদর গায়ে দিয়ে এসেছেন কেন?
জোহর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, যখন বের হয়েছিলাম তখন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব ছিল। তবে আপনি যা ভাবছেন তা-না। চাদরের নিচে কিছু নাই। চাদর খুলে দেখাতে হবে?
দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে! কেউ চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। মোবারক হোসেন বললেন, গরম বেশি, চাদর খুলে ফেললে ভালো হয়।
জোহরের ঠোঁটের কোণে ক্ষীণ হাসির রেখা দেখা গেল। হাসি ফুটল না। তার আগেই নিভে গেল। তাকে দেখে মনে হলো, সে মোবারক হোসেনের কথায় খুব মজা পাচ্ছে।
যদি চাদর না খুলি তাহলে কি আমাকে চলে যেতে হবে?
জি।
তাহলে চলেই যাই। চা খেতে ইচ্ছা করছে। আশেপাশে চায়ের দোকান আছে?
আছে।
আমাকে নিয়ে চলেন, দুজনে মিলে চা খাই। কোনো নেশাই একা একা করা যায় না। চা তো একরকম নেশাই, তাই না?
চলেন যাই।
বত্ৰিশ নম্বর থেকে বের হয়ে দুজন মিরপুর রোড পার হলো। ওপাশেই একটা নাপিতের দোকান। দোকানটা সবার চোখে পড়ে, কারণ সেখানে মজার একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে–
মুজিবের বাড়ি যেই পথে
আমার দোকান সেই পথে।
নাপিতের দোকানটা এখনো খোলে নি। তবে চায়ের দোকান খুলেছে। দশবারো বছরের একটা ছেলে পরোটা বেলছে। দুখু মিয়া টাইপ চেহারা। বড় বড় চোখ।
জোহর চায়ের দোকানে ঢুকেই গায়ের চাদর খুলে ফেলল, ভাজ করে কাধে রেখে মোবারক হোসেনের দিকে তাকিয়ে হাসল। শান্ত গলায় বলল, চাদরের নিচে যে কিছু নাই কথাটা কি বিশ্বাস হয়েছে?
মোবারক হোসেন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
জোহর বলল, তার পরেও যদি বিশ্বাস না হয়। গায়ে হাত দিয়ে দেখতে °८।।
দেখতে হবে না।
আসুন চা নিয়ে রাস্তার পাশে বসে খাই। আপত্তি আছে?
না, আপত্তি নাই।
রাস্তার পাশে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। জোহর সিগারেট ধরিয়েছে। সিগারেট ধরানোর কারণেই হয়তো তার চেহারায় উৎফুল্ল ভাব।
ইন্সপেক্টর সাহেব।
জি।
আপনাকে আগে একবার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছিলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান কখনো স্বাধীন হবে না। মনে আছে?
মনে আছে।
আমার যুক্তি কি আপনার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছিল?
জি, মনে হয়েছে।
এখন আমি বুঝতে পারছি আমার যুক্তি ঠিক না। শেখ মুজিব। যদি চান দেশ স্বাধীন হবে। কীভাবে বুঝলাম জানেন?
না,
আপনাকে দেখে বুঝলাম। কোনো বাঙালির পক্ষে শেখ মুজিবের কোনো অনিষ্ট করা সম্ভব না। অনিষ্ট অনেক দূরের ব্যাপার, তার কোনো ক্ষতির চিন্তা করার ক্ষমতাও বাঙালির নেই। এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে স্বাধীনতা ছাড়া উপায় কী? একজন মানুষ কত দ্রুত এই অবস্থায় চলে গেছেন ভাবতেই বিস্মিত হতে হয়।
মোবারক হোসেন কিছু বললেন না। তার চায়ের নেশা নেই, কিন্তু সকালের এই চা-টা তার খেতে ভালো লাগছে।
ইন্সপেক্টর সাহেব!
জি।
আমি এখনো পাকিস্তানি শাসকদের চিন্তিত হবার মতো কিছু ঘটেছে বলে। মনে করি না। শেখ মুজিব মধ্যবিত্তের নেতা, বুর্জেীয়া নেতা। এ ধরনের নেতারা সরাসরি যুদ্ধের কথা ভাবেন না। এরা ঝামেলামুক্ত সমাধান চান। যেমন ধরেন ভারতের জওহরলাল নেহরু কিংবা মহাত্মা গান্ধী। এরা দেশ স্বাধীন করেছেন জেল খেটে। অসহযোগ আন্দোলন করে। কারণ এই দুজনও বুর্জেীয়া নেতা! সরাসরি যুদ্ধ এরা সমর্থন করেন নি। আপনাদের শেখ মুজিবও করবেন না। বুঝতে পারছেন কী বলছি?