নাইমুল চলে যাবার পরপরই লোজজন মিলে ঠেলে তাঁর গাড়ি তুলে দিল। ধীরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ছাত্রের দেয়া ঠিকানায় রওনা হলেন। তাকে নাইমুল বলেছে ১৮নং সোবহানব গ। কিন্তু তিনি চলে গেলেন চামেলীবাগে। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি চামেলীবাগের আঠারো নম্বর দোতলা বাড়ি খুঁজতে লাগলেন। যে বাড়ির গেট হলুদ রঙের। বাড়ির সামনে দুটা কাঁঠাল গাছ আছে।
মরিয়ম কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না
মরিয়ম কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না–তার বিয়ে হয়ে গেছে। তার যেন কেমন লাগছে। গা হাত পা কাঁপছে। বুকে ধুকধুক শব্দ হচ্ছে। প্রচণ্ড পানির পিপাসা হচ্ছে কিন্তু এক চুমুক পানি খেলেই পিপাসা চলে যাচ্ছে। পানি খেতে আর ভালো লাগছে না। কিছুক্ষণ পর আবার পিপাসা হচ্ছে। সে নিজের কপালে হাত দিল। গায়ে কি জ্বর আছে? জ্বরের সময় এরকম উল্টাপাল্টা লাগে। না জ্বর তো নেই। কপাল ঠাণ্ডা।
কী আশ্চর্য! বসার ঘরে যে লম্বা রোগা ছেলেটি বসে আছে, সে তার স্বামী। যাকে সে আগে কোনোদিন দেখে নি, যার সঙ্গে কোনো কথা হয় নি। মাত্র পনেরো মিনিট আগে থেকে সে তার জীবনের সবচে ঘনিষ্ঠজন। বিয়ে নামক অদ্ভুত একটা ঘটনায় আজ রাত আটটা সাত মিনিট থেকে দুজন শুধু দুজনের।
মরিয়ম তার স্বামীকে এখনো ভালোমতো দেখে নি। দূর থেকে আবছাভাবে দেখেছে। তার খুবই ইচ্ছা করছে কাছ থেকে দেখতে। তার চোখ দুটা কেমন? বিড়াল-চোখা না তো? বিড়াল-চোখা মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায় না। কথা বললে মনে হয় বিড়ালের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। এই বুঝি মানুষটা মিউ করে উঠবে। তার কি জোড়া ভুরু? জোড়া ভুরুর মানুষ মরিয়মের খুব অপছন্দ। যার যা অপছন্দ তাই সে পায়। দেখা যাবে নাইমুল নামের মানুষটার জোড়া ভুরু। আচ্ছা থাকুক জোড়া ভুরু। কপালে যা থাকে তাই তো হবে। বিয়ে হলো কপালের ব্যাপার।
একটু আগে তার সবচে ছোটবোন মাফরুহা এসে বলল, বুকু, তোমার বর খুব সুন্দর। মরিয়মের ইচ্ছে করছিল। জিজ্ঞেস করে–তোর দুলাভাইয়ের জোড়া ভুরু না-কি? চট করে দেখে আয় তো। লজ্জায় প্রশ্নটা সে করতে পারে নি।
মাফরুহা বলল, দুলাভাই কিন্তু রাতে থাকবে না। এখনই চলে যাবে।
মরিয়মের বুক ধক করে উঠল। সে এখনো দেখলই না, তার আগেই চলে যাবে? এমন ঘটনা কি এর আগে কখনো ঘটেছে–বর এসে বিয়ে করেই উধাও হয়ে গেছে? মরিয়মের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে অবশ্যি অবহেলার ভঙ্গিতে বলল, চলে গেলে চলে যাবে। আমার কী? যাবে কখন?
দুলাভাইয়ের ছোট চাচা তো এক্ষুনি চলে যাবেন বলছেন। উনি নারায়ণগঞ্জ থাকেন। অনেক দূর যেতে হবে। তাঁর সঙ্গে দুলাভাইও চলে যাবেন কি-না বুঝতে পারছি না। দুলাভাই কিছু বলছেন না।
মরিয়ম বলল, দুলাভাই দুলাভাই করছিস কেন? শুনতে বিশ্ৰী লাগছে। চেনা নেই, জানা নেই একটা মানুষ।
কথাটা মরিয়মের মনের কথা না। ছোট বোনের মুখে দুলাভাই ডাকটা শুনতে তার খুবই ভালো লাগছে। কী সুন্দল টেনে টেনে বলছে— দু—লা ভাই।
মাফু, দেখ তো আমাকে কি বিয়ের শাড়িতে মানিয়েছে? (ছোট বোনকে মরিয়ম আদর করে মাফু ডাকে)
মাফরুহা বলল, তোমাকে খুবই সুন্দর লাগছে।
খোঁজ নিয়ে আয় তো ওরা সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছে কি-না। ওরা চলে গেলে মা যে এত রান্নাবান্না করেছেন সেগুলি কে খাবে? মাসুমা সন্ধ্যা থেকে চুলার পাড়ে বসে আছে। তার কষ্ট হচ্ছে না?
মাফরুহ খোঁজ নিতে গেল। মরিয়াম দাড়ালো আয়নার সামনে। সে আগেও কয়েকবার দাঁড়িয়েছে। প্ৰতিবারই নিজেকে সুন্দর লেগেছে। এখন মনে হয়। একটু বেশি সুন্দর লাগছে। অথচ খুবই সাধারণ শাড়ি। ওরা নিয়ে এসেছে। সবুজ রঙের শাড়ি। ভাগ্যিস কাঢ়া সবুজ না। গ্রামের মেয়েরাই শুধু কটকট কড়া রঙের সবুজ শাড়ি পরে। শাড়ি যত সাধারণই হোক মরিয়ম ঠিক করে রেখেছে, এই শাড়ি সে খুব যত্ন করে রাখবে। প্রতি বছর ৭ মার্চ বিয়ের দিনে এই শাড়ি সে পরবে। তার মেয়েরা বড় হলে মায়ের বিয়ের শাড়ি দেখতে চাইবে। মেয়েদের কেউ একজন হয়তো বলবে, তোমার বিয়ের শাড়ি এত সস্তা কেন মা? এ তো সত্যি ক্ষেত শাড়ি। পরলে মনে হবে ধানক্ষেত।
তখন মরিয়ম বলবে, আমাদের খুব তাড়াহুড়াল বিয়ে হয়েছিল। দেশজুড়ে তখন অশান্তি। তোর বাবার হাতে বোনো টাকা-পয়সা নেই। সে তার দূরসম্পর্কের এক চাচা এবং এক ফুফাকে নিয়ে এসেছিল। সন্ধ্যাবেল বাসায় এসেছে, তখনো আমি জানি না যে আমার বিয়ে।
মা, তোমার বিয়েতে কোনো উৎসব হয় নি?
না।
গায়েহলুদ-টলুদ কিছুই হয় নি?
না, সে-রকম করে হয় নি। তবে শাড়ি পরার আগে গোসল করলাম, তখন তোর ছোট খালা আমার গালে এক গাদা হলুদ মেখে দিল। মসলা পেষার পাটায় হলুদ পেষা হয়েছিল। শুকনা মরিচের ঝাল চোখে লেগে গেল। কী জুলুনি! চোখ দিয়ে সমানে পানি পড়ছে, আর সবাই ভাবছে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে এই জন্যে কাদছি।
তোমার কান্না পাচ্ছিল না?
না।
বিয়ের দিন সবারই কান্না পায়। তোমার পাচ্ছিল না কেন মা?
জানি না। তখন সময়টা তো অন্যরকম ছিল। প্ৰতিদিন মিটিং মিছিল, পুলিশের গোলাগুলি, কাফু–এই জন্যেই বোধহয়।
বাবাকে প্রথম দেখে কি তোমার ভালো লেগেছিল মা?
না দেখেই ভালো লেগেছিল।
সেটা কেমন কথা! না দেখে ভালো লাগে কীভাবে?
তুই যা তো। তোকে এত কিছু ব্যাখ্যা করতে পারব না।
মরিয়মের ধারণা তার মেয়ে ধমক খেয়েও যেতে চাইবে না। সে চোখ বড় বড় করে তার বাবা-মার বিয়ের গল্প শুনতে চাইবে। সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা মায়ের বিয়ের গল্প খুব আগ্রহ করে শোনে।