শেখ সাব একটা বাঘের বাচ্চা। কী কন্ন স্যার?
অবশ্যই বাঘের বাচ্চা।
খাঁটি মায়ের খাঁটি দুধ খাইয়া বড় হইছে। কী কন স্যার?
অবশ্যই।
জীবনে একটা শখ ছিল শেখ সাবরে একদিন আমার রিকশায় তুলব। বিষুদবার হাইকোর্টের মাজারে গিয়া দোয়াও করছি। জানি না দোয়া কবুল হইব কি না।
শাহেদ বলল, সৎ দোয়া সৎ ইচ্ছা সব সময় কবুল হয়।
আগামসি লেনে নেমে শাহেদ ভাড়া দিতে গেল। রিকশাওয়ালা ভাড়া নিবে না। শাহেদ বলল, ভাড়া নিবে না কেন? রিকশাওয়ালা বলল, স্বাধীন হইলে তো সবই ফিরি হইব। ধরেন দেশ স্বাধীন হইছে।
শাহেদ রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে আছে। এর চেহারা মনে রাখা দরকার। দেশ যদি সত্যি সত্যি স্বাধীন হয়, তখন একে খুঁজে বের করতে হবে।
ভোঁতা। পাথরের মতো মুখ। মাথার চুল খাবালা-খাব লাভাবে উঠে গেছে। কোনো একজন বিখ্যাত লোকের চেহারার সঙ্গে রিকশাওয়ালার চেহারার মিল আছে। সেই লোকটাকে মনে পড়ছে না। রিকশাওয়ালা হাসিমুখে বলল, এমন নজর কইরা কী দেখোন?
তার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে শাহেদের বিখ্যাত লোকের নামটা মনে পড়ল। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন।
নাইমুলের ঘরের দরজা বন্ধ। কড়ায় ঝাকুনি দিতেই নাইমুল বলল, দরজা খোলা আছে। জোরে ধাক্কা দিলেই খুলবে। ভেতরে চলে আয়।
ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শাহেদ বলল, আমি কড়া নাড়ছি বুঝলি কী করে? তুই তুই করছিলি। অন্য কেউ তো হতে পারত।
নাইমুল বলল, অনুমানে বলেছি। সাত-আট দিন পর পর তোর দেখা পাওয়া যায়। আজ নাইনথ ডে।
নাইমুল খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বিছানায় শুয়ে আছে। তার মুখের উপর মোটা একটা বই ধরা। সতীনাথ ভাদুড়ির জাগরী। ঘর খুবই ছোট। কোনোমতে একটা খাট এবং একটা চেয়ার-টেবিল এটেছে। ঘরে একটা আলনা আছে, সেই আলনা বসানো আছে খাটের মাথায়। সেই কারণে খাট ছোট হয়ে গেছে। নাইমুলের মতো লম্বা মানুষ পা মেলে ঘুমুতে পারে না, তাকে পা খানিকটা গুটিয়ে রাখতে হয়। তবে ঘরের সিলিং অনেক উচুতে। সেই উচু সিলিং থেকে লম্বা রডের মাথায় ফ্যান ঘুরছে। নাইমুল বই থেকে চোখ না। সরিয়ে বললকোনো কথা না। স্ট্রেইট বাথরুমে চলে যা। বালতিতে পানি তোলা আছে। সাবান আছে, গামছা আছে, একটা লুঙ্গিও আছে। আরাম করে গোসল কর। তারপর কথা হবে।
শাহেদ বলল, বাসায় গিয়ে গোসল করব।
যা বলছি শোন। তোর ঘামে ভেজা শরীর দেখে আমারই অস্বস্তি লাগছে।
শাহেদ বাথরুমে ঢুকে পড়ল। গায়ে পানি ঢালার পর তার মনে হলো, দীর্ঘ একত্ৰিশ বছর জীবনে সে এত আরামের গোসল কোনো দিনও করে নি।
নাইমুল বলল, এই গাধা, গোসল করে আরাম পাচ্ছিস?
শাহেদ বলল, পাচ্ছি।
নাইমুল বলল, দুই বালতি পানি আছে। প্রথম বালতি পানি গায়ে ঢেলে শরীর ঠাণ্ডা কর। শরীর পুরোপুরি ঠাণ্ডা হবার পর গায়ে সাবান মাখবি। তাড়াহুড়ার কিছু নেই, ধীরে সুস্থে সাবান মাখ। তারপর সেকেন্ড বালতি। দুপুরে কি আমার এখানে খাবি?
খেতে পারি।
তাহলে তোকে আজ ইলিশ মাছের ডিম খাওয়াব। এই ডিম খাওয়ার পর পৃথিবীর কোনো খাবার তোর মুখে রুচিবে না।
ডিম কে রাধছে?
গনি মিয়া বাবুর্চি। হোটেলে বলা আছে। খাওয়া যথাসময়ে চলে আসবে। হড়বড় করে পানি ঢালছিস কেন? আস্তে আস্তে ঢাল। শরীর আরাম পাক।
শাহেদ গায়ে পানি ঢালছে। আরামে ঘুম পেয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা করছে বাথরুমের ঠাণ্ডা মেঝেতে শুয়ে খানিকক্ষণ ঘুমায়। সে ঘুমাবে কেউ একজন গায়ে পানি ঢালবে। নাইমুলের গলা শোনা গোল— শাহেদ, তোকে বলা হয় নি। আমি বিয়ে করছি।
শাহেদ বলল, সে কী!
নাইমুল বলল, চমকে উঠলি কেন? আমি চিরকুমার থাকিব–এরকম তো কখনো বলি নি।
মেয়ে দেখা হয়েছে?
হঁ। চাকমা টাইপ চেহারা।
বলিস কী! মেয়েও ঠিক হয়ে গেছে? আমরা কিছুই জানলাম না।
বিয়ে করব আমি, তোদের জানার দরকার কী?
বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে?
হ্যাঁ।।
কবে?
আজ।
ঠাট্টা করছিস?
আমি জীবনে কখনো কারো সঙ্গে ঠাট্টা করেছি–এরকম উদাহরণ আছে?
বিয়ে কখন?
রাতে। কাজি ডাকিয়ে বিয়ে। কবুল কবুল কবুল— ঝামেলা শেষ।
শাহেদ গায়ে পানি ঢালা বন্ধ করল। তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাইমুল। আজ রাতে তার বিয়ে–এই খবরটা জানানোর প্রয়োজনও সে বোধ করে নি। নাইমুল সবসময় এরকম। সে কি আসলেই এরকম, না-কি এটা তার এক ধরনের শো? সবাইকে জানানো— তোমরা আমাকে দেখ, আমি নাইমুল, আমি জীবনে কখনো কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হই নি। আমি তোমাদের মতো না। আমি আলাদা।
শাহেদ!
বল।
মেয়ের নাম মরিয়ম। আমি ঠিক করেছি। শর্ট করে তাকে ডাকব মরি।
ভালো তো।
আমার শ্বশুরসাহেব পুলিশের লোক। তার নাম মোবারক হোসেন।
তুই কি সত্যিই আজ বিয়ে করছিস?
হ্যাঁ। আজ বিয়ে করাটাই আমার জন্যে সুবিধা। আজ বিশেষ দিন। ৭ই মার্চ। শেখ সাহেব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। এক সময় এই দিনটি আমাদের জাতীয় দিবস হয়ে যাবে। সরকারি ছুটি থাকবে। আমি আমার ম্যারেজ ডে কখনো ভুলব না। ভালো কথা, তুই কি শেখ সাহেবের ভাষণ শুনতে যাবি?
হ্যাঁ।
কী দরকার? রেডিওতে প্রচার হবে, রেডিও শোন। ক্রিকেট খেলা এবং ভাষণ–এইসব রেডিওতে শোনা ভালো।
শাহেদ বাথরুম থেকে বের হলো। নাইমুলের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, গোসল করে আরাম পেয়েছি।
নাইমুল মুখের উপর ধরে রাখা বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, আরাম পাবি জানতাম।
শাহেদ বলল, আমি এখন যাচ্ছি।
নাইমুল বিস্মিত গলায় বলল, যাচ্ছি মানে কী?
যাচ্ছি মানে যাচ্ছি।