যদিও জানি স্বপ্ন মানবমনের দুশ্চিন্তার ফসল ছাড়া আর কিছুই না। তারপরেও চিন্তায় অস্থির হইয়াছি। এমন নজির আছে যে মহান আল্লাহপাক স্বপ্নের মাধ্যমে আমাদের সাবধান করিতেছেন।
ঘটনা যাহাই হউক, পত্রপ্রাপ্তির তিনদিনের মাথায় তুমি অতি অবশ্যই সবাইকে নিয়া চলিয়া আসিবা। ইহা তোমার প্ৰতি আমার আদেশ।
আল্লাহপাক তোমাদের সর্ব বিপদ হইতে মুক্ত রাখুন। আমিন।
ইতি ইরতাজউদ্দিন
বড় ভাইয়ের কাছে লেখা শাহেদের চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত। সে শুধু লিখেছে–
ভাইজান, আমরা আসছি। এক সপ্তাহের মধ্যেই আসছি।
আসমানী বলল, এই, কোথায় যাচ্ছ?
শাহেদ জবাব দিল না। এরকম ভাব করল যেন সে আসমানীর কথা শুনতে পায় নি। আসমানী আবারো বলল, ভরদুপুরে তুমি যােচ্ছ কোথায়?
শাহেদ এবারো জবাব দিল না। গত দুদিন ধরে সে আসমানীর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। শাহেদ নিঃশব্দে ঝগড়া করার চেষ্টা করছে। সমস্যা হচ্ছে, সে কথা না বলে দীর্ঘ সময় থাকতে পারে না। আসমানী পারে। একনাগাড়ে আঠারো দিন কথা না-বলার রেকর্ড আসমানীর আছে। গিনিজ বুক অফ রেকর্ড স্বামী-স্ত্রীর কথা বলা না-বলা জাতীয় বাঙালি ব্যাপার নিমো মাথা ঘামায় না। মাথা ঘামালে স্বামী-স্ত্রীর একনাগাড়ে দীর্ঘ সময় কথা না-বলার রেকর্ড ধরে রাখার ব্যবস্থা করত। এবং শাহেদের ধারণা সেখানে অবশ্যই আসমানী নাম থাকত।
কথা না-বলে দিনের পর দিন পাশাপাশি বাস করা আসমানীর কাছে কিছুই না। কথা বলতে না পারলেই সে যেন ভালো থাকে। সমস্যা হয় শুধু শাহেদের। আসমানীর সঙ্গে কথা বলতে না পারলে তার পেট ফুলতে থাকে। সাত-আট ঘণ্টা পার হওয়ার পর দমবন্ধ দমবন্ধ ভাব হয়, তারপর এক সময় খুব অসহায় লাগতে থাকে। মনে হয় তাঁর ভয়ঙ্কর কোনো অসুখ করেছে। নিঃশ্বাসের কষ্ট হওয়ার অসুখ।
আটচল্লিশ ঘণ্টা হলো শাহেদ কথা না বলে আছে। দমবন্ধ ষ্টেজ পার করে সে এখন আছে অসহায় স্টেজে। তারপরেও ঠিক করেছে, আসমানী ক্ষমা প্রার্থনা না করা পর্যন্ত সে কথা শুরু করবে না। আসমানীর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয়, সে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য মানসিকভাবে প্ৰস্তৃত। চক্ষুলজ্জার জন্য পারছে না। আসমানী এখন নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে অনেক অপ্রয়োজনীয় কথা বলছে। আশেপাশে ঘুরঘুর করছে।
দুদিন আগের ঝগড়ার দায়দায়িত্ব বেশিরভাগই আসমানীর। শাহেদ রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বলেছে, আসমানী, তুমি এক কাজ করো। নীলগঞ্জে ভাইজানের কাছে চলে যাও।
আসমানী বলল, কেন?
ঢাকার অবস্থা ভালো না। লক্ষণ খুব খারাপ। কখন কী হয়! কী দরকার রিস্ক নিয়ে?
তুমি ঢাকায় থাকবে?
হ্যাঁ।
তুমি ঢাকায় থাকবে। আর আমি চলে যাব? ঢাকার অবস্থা আমার জন্য খারাপ আর তোমার জন্য রসগোল্লা?
এরকম করে কথা বলছি কেন?
কী রকম করে কথা বলছি?
খুবই অশালীন ভঙ্গিত কথা বলছি। যে মেয়ে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেছে, তার কথাবার্তা কি আরো শালীন হবে না?
অশালীন, কথা কোনটা বললাম? রসগোল্লা শব্দটা অশালীন? তাহলে শালীন শব্দ কোনটা? পাস্তুয়া? নাকি রসমালাই?
প্লিজ, চুপ করো।
না, আমি চুপ করব না। তুমি আমাকে ব্যাখ্যা করবে। কেন ঢাকা আমার জন্যে খারাপ আর তোমার জন্যে পান্তুয়া।
শাহেদ বিরক্ত হয়ে বলেছে, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি থাকে। তোমাকে কোথাও যেতে হবে না।
আসমানী গম্ভীর গলায় বলেছে, ঠিক করে বলো তো, কোনো কারণে কি আমাকে তোমার অসহ্য বোধ হচ্ছে? কথায় কথায় নীলগঞ্জ চলে যাও। যেন আমি নীলগঞ্জ চলে গেলে তুমি হাঁপ ছেড়ে বাচ। আমি একা নীলগঞ্জ গিয়ে কী করব? তোমার মাওলানা ভাইয়ের সঙ্গে হাদিস-কোরান নিয়ে গল্প করব?
বললাম তো যেতে হবে না।
আর আমাকে যদি যেতেই হয় আমি নীলগঞ্জ যাব কেন? আমার কি যাওয়ার জায়গার অভাব আছে?
সামান্য ব্যাপার নিয়ে তুমি বাড়াবাড়ি করছি আসমানী।
শুধু আমি সামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করি? তুমি করো না? তুমি কি সবসময় অসামান্য ব্যাপার নিয়ে বাড়াবাড়ি করো? ঐ দিন চায়ে চিনি বেশি হয়েছিল বলে তুমি কি কাপসুদ্ধ চা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দাও নি?
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হতে পারত। শেষ হলো না। আসমানী বালিশ নিয়ে উঠে গেল। শাহেদ বলল, কোথায় যােচ্ছ?
আসমানী বলল, তা দিয়ে তোমার দরকার কী? তুমি তোমার ঘুম ঘুমাও। আমি পাশে নেই, কাজেই রাতে ভালো ঘুম হওয়ার কথা। কে জানে হয়তো সুন্দর সুন্দর স্বপ্নও দেখবে।
আসমানী ঘুমুতে গেল বসার ঘরের সোফায়। শাহেদ এই সোফার নাম দিযেছে। রাগ-সোফা। স্বামী-স্ত্রীর ভেতর ঝগড়া হলে একজন কেউ সেই সোফায় গিয়ে শোয়। সেই একজনটা বেশিরভাগ সময়ই আসমানী।
আসমানী সোফায় ঘুমুতে গেছে। শাহেদ আছে বিছানায়। রুনি তার সঙ্গে। আসমানী রাগারগি যাই করুক রুনিকে সঙ্গে নিয়ে মশার কামড় খাওয়ায় না। শাহেদ মশারির ভেতর বসে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে, এমন কিছু ঘটে নি যে রাতে আলাদা ঘুমুতে হবে। ব্যাপারটা বাড়াবাড়ি তো বটেই। আসমানী বেশ কিছুদিন থেকে বাড়াবাড়ি করছে। দেশের অনিশ্চিত অবস্থা মনের উপর চাপ ফেলে, সবাই কিছুটা হলেও অস্বাভাবিক আচরণ করে। সেই যুক্তিতে আসমানীকে ক্ষমা করা যায়। পরীক্ষণেই মনে হলো, প্রতিবার আগ বাড়িয়ে এত ক্ষমার দরকার কী? সে হবে ক্ষমার সাগর আর আসমানী হবে চৌবাচ্চা। কেন? দেখি না কথা না-বলে কত দিন থাকা যায়।
শাহেদ প্যান্ট পরতে পরতে ভাবল, কথা বলা শুরু করা যাক। এমনিতেও নিজের কোমর সরু হয়ে গেছে কিংবা প্যান্টের কোমর কোনো এক অস্বাভাবিক কারণে বড় হয়ে গেছে। বেল্ট ছাড়া পরা যাবে না। বেল্ট খুঁজে বের করা যাবে না। আসমানীকে বললে সে নিমেষে বের করে দেবে। জিনিস খুঁজে বের করার অলৌকিক ক্ষমতা আসমানীর আছে।