থ্যাংকয়্যু স্যার।
তোমার সঙ্গে যে পিস্তলটিা আছে, সেটা আমি রেখে দেব।
মোবারক হোসেন চিন্তিত গলায় বললেন, স্যার, আমাকে অফিসে হিসাব দিতে হবে। আপনার কাছে পিস্তল দিয়ে দিলে আমি বিপদে পড়ব।
তোমাকে বিপদে ফেলতে চাই না। তুমি বরং আগামীকাল তোমার অফিসে পিস্তল জমা দিয়ে দিবে।
জি আচ্ছা, স্যার।
তোমাদের এই পিস্তলগুলি পুরনো। ট্রিগার টিপলে দেখা গেল গুলি হলো না। আমি তোমাকে ভালো একটা পিস্তল দিব।
মোবারক হোসেনের পেটে কেমন যেন শব্দ হচ্ছে। মাথা বিমঝিম করছে। পায়ের নিচটা অবশ হয়ে যাচ্ছে এরকম অনুভূতি। মনে হচ্ছে তিনি চোরাবালিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ধীরে ধীরে তার শরীর ডেবে যাচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই যে তাকে টেনে তুলবে। জোহর সাহেব অবশ্যি আছেন। তিনি আগের মতো মাথা নিচু করে সিগারেট টেনে যাচ্ছেন। কটা সিগারেট খাওয়া হয়েছে সেই হিসাব রাখা হয় নি। কর্নেল সাহেব হঠাৎ যদি জিজ্ঞেস করেন, তিনি জবাব দিতে পারবেন না। কর্নেল সাহেব নিশ্চয়ই খুব বিরক্ত হবেন।
ইন্সপেক্টর।
ইয়েস স্যার।
তুমি হঠাৎ খুবই চিন্তিত হয়ে পড়েছ। কী জন্যে?
স্যার, আমি চিন্তিত না।
অবশ্যই তুমি চিন্তিত। তোমার কপাল ঘামছে। তুমি মনে মনে কী ধারণা করছি সেটা বলব? তোমার ধারণা আমি নতুন পিস্তল দিয়ে তোমাকে নির্দেশ দিব–যাও, শেখ মুজিবকে খুব কাছ থেকে গুলি করো। তোমার প্রতি এটাই হাই কমান্ডের নির্দেশ। তাই ভাবিছ না?
মোবারক হোসেন তাকালেন জোহর সাহেবের দিকে। তার ঠোঁটে চাপা হাসি। এই ভদ্রলোক কটা সিগারেট খেয়েছেন? কর্নেল সাহেব যদি সিগারেটের সংখ্যা জিজ্ঞেস কলেন, তাহলে বিপদে পড়ে যেতে হবে। হে আল্লাহপাক, কর্নেল সাহেব আজ যেন সিগারেটের সংখ্যা না জিজ্ঞেস করেন।
ইন্সপেক্টর।
ইয়েস স্যার।
আমরা এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা করলেও করতে পারি। আততায়ীর হাতে শেখ মুজিবের মৃত্যু। দলপতি শেষ মানেই দল শেষ। তবে এ ধরনের পরিকল্পনা করা হলে তার দায়িত্ব আমরা তোমাকে দিব না। তুমি বাঙালি। কোনো বাঙালিকে আমরা বিশ্বাস করি না। তোমার হাতের টিপ কেমন তাও জানি না। ভালো হবার কথা না। আমাদের দরকার সার্প শুটার। বুঝতে পারছি?
জি স্যার।
কর্নেল সাহেব মাথা ঝাকালেন। পকেটে হাত দিয়ে সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিলেন। সিগারেট ধরলেন না। তবে তিনি সিগারেটে টান দিচ্ছেন এবং ধোয়া ছাড়ার ভঙ্গি করছেন। এটা যেন এক ধরনের খেলা।
ইন্সপেক্টর।
ইয়েস স্যার।
একটা শক্তিশালী বাঘ চুপচাপ বসে আছে। তোমরা বাঘটাকে খোচাচ্ছি। কাঠি দিয়ে খোচোচ্ছ, গায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছ। বাঘটার কানের কাছে ক্ৰমাগত চিৎকার করছ–জয় বাংলা, জয় বাংলা। এই বাঘ তো অবশ্যই ঝাপ দিয়ে পড়বে। আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি যাও। জোহর, তুমি তাকে পিস্তল আর ছয় রাউন্ড গুলি দিয়ে দাও। মিষ্টির জন্যে ধন্যবাদ।
মোবারক হোসেন রাতে বাসায় ফিরলেন জ্বর নিয়ে। জ্বর এবং তীব্র মাথার যন্ত্রণা। মুসলেম উদ্দিন ছেলেটিকে নিয়ে এসেছেন। তার নাম নাইমুল। দেখে মনে হচ্ছে ছায়ার কচুগাছ। প্রাণহীন বিবর্ণ। লম্বাতেও বেশি। স্কুলে এই ছেলেকে নিশ্চয়ই তালগাছ ডাকা হতো। মরিয়ম বেঁটে। এই তালগাছের সঙ্গে মরিয়মকে একেবারেই মানাবে না। ছেলের চোখে-মুখে উদ্ধত ভঙ্গি আছে। চোখে চোখ পড়ার পরেও চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না। তাকিয়ে থাকছে।
মোবারক হোসেন তাদের সঙ্গে খেতে বসলেন, কিন্তু কিছু খেতে পারলেন না। তার জ্বর বেড়েছে। পেটে মোচড় দিচ্ছে। তিনি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লেন।
মুসলেম উদ্দিন যখন তার ভাগ্নেকে জিজ্ঞেস করলেন, কি-রে ছেলেটাকে পছন্দ হয়েছে? তখন মোবারক হোসেন বললেন, ছেলে পছন্দ হয় নি। কিন্তু বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন। ছেলের আত্মীয়স্বজনকে খবর দিন। ওদের সঙ্গে কথা বলেন। তবে আমাকে এইসবের মধ্যে জড়াবেন না। বিয়ের তারিখ ঠিক করে জানাবেন। আমি খরচ দিব। ছেলে ক্যাশ টাকা যেন কত চায়?
এগারো হাজার।
মোবারক হোসেন বললেন, এগারো হাজার টাকা দিয়ে দিব। কোনো সমস্যা নাই।
কবিতা একবার পড়লে
কবিতা একবার পড়লে অনেকক্ষণ মাথায় থাকে। কবিতার শব্দগুলি না থাকলেও ছন্দটা থাকে। ট্রেন চলে যাবার পরেও যেমন ট্রেনের ঝিক ঝিক শব্দ মাথায় বাজতে থাকে সে-রকম। এ ধরনের একটা ব্যাপার শাহেদের হয় তার বড় ভাইয়ের চিঠি পাওয়ার পর। চিঠিটা অনেকক্ষণ মাথায় থাকে।
ইরতাজউদ্দিন চিঠি লেখেন রুলটানা কাগজে। সাদা কাগজে তার লাইন ঠিক থাকে না বলে তিনি সাদা কাগজে লিখতে পারেন না। অক্ষরগুলি বড় বড় এবং স্পষ্ট। অক্ষর যেমন স্পষ্ট চিঠির বক্তব্যও স্পষ্ট। এই মানুষটার ভেতর কোনো অস্পষ্টতা নেই।
শাহেদ তার বড় ভাইয়ের চিঠি গতকাল দুপুরে একবার পড়েছে। রাতে ঘুমুতে যাবার সময় একবার পড়েছে। এখন আরেক দুপুর। শাহেদ ঠিক করেছে, আজ সারাদিনের জন্যেই সে বের হয়ে যাবে। ফিরবে সন্ধ্যার পর। এর মধ্যে একটা ফাক বের করে বড় ভাইজানকে লেখা চিঠিটা পোস্ট করে দেবে।
বড় ভাইজান লিখেছেন–
প্রিয় শাহেদ, আসমানী ও রুনি, (তিনজনের নামে এক চিঠি। এই অদ্ভুত মানুষ শাহেদের বিয়ের পর কখনো শাহেদকে আলাদা চিঠি লিখেন নি। রুনির জন্মের পর সব চিঠিতেই তারা দুইজন ছাড়াও রুনির নাম আছে।)
তোমাদের জন্যে অতীব দুশ্চিন্তায় আছি। সুদূর পল্লীগ্রামে আছি। শহরের অবস্থা বুঝিতে পারিতেছি না। লোকমুখে নানান খবরাদি পাই। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা তা আলাদা করিতে পারি না। দুশ্চিন্তায় কালক্ষেপণ করি। প্রতি রাতেই আলাদা করিয়া তোমাদের তিনজনের জন্যে আল্লাহপাকের নিকট দেয়া করি। তাহাতেও মন শান্ত হয় না। মন যে শাস্ত হয় না। তাহার প্রমাণ প্ৰায় প্রতি রাতেই তোমাদের নিয়া আজেবাজে স্বপ্ন দেখি। একটি স্বপ্নে দেখিলাম তুমি মা রুনিকে কোলে নিয়া দৌড়াইতেছ। তোমার পাশে রুনির স্নেহময়ী মা আসমানী। তোমাদের পিছনে ভীষণ-দর্শন একজন বলশালী পুরুষ বল্লম হাতে তোমাদের তাড়া করিতেছে। যে-কোনো মুহুর্তে সে বল্লম নিক্ষেপ করিবে এমন অবস্থা।