রেঁধেছে। কে? তুই?
জে।
ইরতাজউদ্দিন আবারো বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। মধু হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে থাকে। রান্নাবান্না করে। তার রান্নার হাত খুবই ভালো। মাছের কাটাকুটা, সামান্য লাউপাতা কুমড়াপাতা দিয়ে সে এমন জিনিস তৈরি করে যে মোহিত হয়ে খেতে হয়। তার রান্না মিষ্টি কুমড়ার ভর্তা যে খায় নি, সে জানেই না ভতাঁর স্বাদ কী।
মধু!
জি স্যার।
দেশের অবস্থা তো ভালো না রে মধু। কী হয় কে জানে!
মধু দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলল, হউক গা। কপালের লিখন না হবে খণ্ডন।।
মধুকে অতিরিক্ত আনন্দিত মনে হচ্ছে। কারণে অকারণে দাঁত বের করে নিঃশব্দে হাসছে। ইরতাজউদ্দিন ভুরু কুঁচকে বললেন, গাজা খেয়েছিস না-কি?
মধু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, খাইতেও পারি, আবার নাও খাইতে পারি।
এই জিনিসটা না খেলে হয় না?
হয়। খাইলেও হয়, না খাইলেও হয়।
ইরতাজউদ্দিন ডাল পানিতে ভিজিয়ে ফেলেছেন। পানি থেকে তুলে কুলায় মেলে দিলেন। শুকিয়ে গেলে আবার ব্যবহার করা যাবে। কোনো কিছুই নষ্ট করা উচিত না। আল্লাহপাক অপচয়কারী পছন্দ করেন না।
স্যার গো, দিনের অবস্থা কিন্তু ভালো না। ঝড় তুফান হইতে পারে।
ইরতাজউদ্দিন সামান্য চিন্তিতঃ বোধ করলেন। তিনি যে চালাঘরে বাস করেন তার অবস্থা শোচনীয়; প্রধান খুঁটির সব কটাতে উইপোকা ধরেছে। ঝড়ের বড় ঝাপ্টা এই ঘর নিতে পারবে না। ঘর নতুন করে বাঁধতে হবে। ঠিক করে রেখেছিলেন, বর্ষার আগে আগে ঘরের কাজটা ধরবেন। মনে হয় না। এইবারও পারবেন। সব নির্ভর করছে আল্লাহপাকের ইচ্ছার উপর। উনি ইচ্ছা! করলে হবে। উনি ইচ্ছা না করলে হবে না। তাঁর অনুমতি ছাড়া কিছুই হবে না। তাহলে মানুষের চেষ্টার মূল্যাটা কী?
মধু খিকখিক করে হাসছে। ইরতাজউদ্দিন বললেন, কী হয়েছে?
মধু বলল, কিছু হয় নাই। একটা শিলুক মনে আসছে। বলব?
বল শুনি।
গাই এ ভাঙ্গে নল খাখরী, বাছুর ভাঙ্গে আইল
ছয় মাস হইল গাই বিয়াইছে বাছুর আইছে কাইল।
কন দেহি জিনিসটা কী?
জানি না।
খুবই সোজা। একটু চিন্তা নিলেই হবে।
চিন্তা নিতে পারছি না।
জিনিসটা হইল গিয়া কচ্ছপের আন্ডা।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, কচ্ছপের আন্ডা হলে তো ভালোই।
আরেকটা বলি?
শিলুক শুনব নারে মধু। চল রওনা দেই।
মধু উসখুসি করছে। শিলুক তার খুব পছন্দের একটা বিষয়। এই অঞ্চলে শিলুক-ভাঙ্গানি হিসাবে তার নাম-ডাক আছে; বিয়ে-শাদি হলেই তার ডাক পড়ে। বরযাত্রীদের কঠিন কঠিন শিলুক দিয়ে সে নাকানি-চুবানি খাওয়ায়।
দিনের অবস্থা আসলেই ভালো না; আকাশে ঘন মেঘ। মাঝে-মাঝে বিজলি চমকাচ্ছে। বিজলির চমকে দেখা যাচ্ছে পশ্চিম দিক থেকে মেঘ উড়ে উড়ে আসছে। পশ্চিমি মেঘ ভালো জিনিস না। ঝড়-ঝাপ্টা হবে।
ইরতাজউদ্দিন দ্রুত পা চালাচ্ছেন। বৃষ্টি নামার আগেই হেডমাস্টার সাহেবের বাড়ি পৌছানো দরকার। থানার সামনে দিয়ে গেলে সময় বেশি লাগবে। তবে রাস্তা ভালো। ডিসট্রিক্ট বাের্ডের সড়ক। জেলেপাড়ার ভেতর দিয়ে গেলে অতি দ্রুত পৌছানো যাবে। সমস্যা একটাই–জঙ্গলের ভেতর দিয়ে রাস্তা। মাঝেমধ্যে খুব সাপের উপদ্রব হয়। ইরতাজউদ্দিন সাপ ভয় পান।
বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসও ছেড়েছে। শরীর জুড়িয়ে যাওয়া ঠাণ্ডা। চারদিকে ঘুরাঘুট্টি অন্ধকার। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক এই অন্ধকারেও চিকচিক করছে। ইরতাজউদিনের মনে হচ্ছে তিনি সড়ক না, নদীর উপর দিয়ে হাঁটছেন। থানার সামনে দিয়ে যাবার সময় তার মুখে পাঁচ ব্যাটারি টর্চের আলো পড়ল। মুখে টর্চের আলো ফেলা বিরাট অভদ্রতা। এই অভদ্রতাটা থানাওয়ালারা সবসময় করে। তাদের দোষও দেয়া যায় না। তাদের মানুষ চিনতে হবে। কে চোর কে সাধু জানতে হবে।
মাওলানা সাহেব, স্নামালিকুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
আমাকে চিনেছেন? আমি ওসি ছদারুল আমিন।
গলা শুনে চিনতে পারি নাই। পরিচয়ে চিনেছি।
মুখের উপর টর্চের আলো ফেলেছি, বেয়াদবি মাফ করে দিবেন। আপনি যান কই?
হেডমাস্টার সাহেবের বাড়িতে যাচ্ছি। উনি খবর পাঠিয়েছেন।
উনাকে আমার সালাম দিবেন। বিশিষ্ট লোক।
অবশ্যই দিব।
দেশের খবর তো মাওলানা সাহেব শুনেছেন–ইয়াহিয়া অধিবেশন স্থগিত করেছে। এখন লাগবে ক্যাচাল। ঢাকায় পোস্টিং থাকলে অবস্থা কেরোসিন হয়ে যেত। পাবলিকের সঙ্গে কাটাকাটি মারামারি। পুলিশ দেখলেই পাবলিক ক্ষেপে যায়। ক্ষেপিস কেন রে বাবা? পুলিশ কি তোরই বাপ-ভাই না? তুই ভাত-মাছ খাস, পুলিশও খায়। তোর ণ্ড-এ যেমন দুৰ্গন্ধ, পুলিশের গু-তেও সেইরকম দুৰ্গন্ধ। আচ্ছা ঠিক আছে, মাওলানা সাহেব। আপনি যান। আপনাকে দেরি করায়ে দিয়েছি। গায়ে একটা দুটা বৃষ্টির ফোটাও পড়তেছে। আসসালামু আলায়কুম।
ওয়ালাইকুম সালাম।
ইরতাজউদ্দিন হাঁটতে শুরু করলেন। থানার ওসিকে রাস্তায় দেখে মধু একটু পিছিয়ে পড়েছিল, এখন সে এগিয়ে এলো। গলা নিচু করে বলল, স্যার, আমরার ওসি সাহেবের বেজায় সাহস এইটা জানেন?
না।
আরে ব্যাপারে—সাহস কী! তার সাহসের একটা গাফ করব?
দরকার নাই।
তাইলে একটা শিলুক ভাঙ্গানি দেন! কন দেখি স্যার–চামড়ার বন্দুক বাতাসের গুল্লি এইটা কী?
জানি না। কী?
এইটা হইল গিয়া আপনের–পাদ। পাদে যে শব্দ হয়। সেই শব্দটা হইল গুল্লি। চামড়ার বন্দুক হইল–পুটকি।
ইরতাজউদ্দিন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এত বড় বেয়াদব–এ ধরনের অশ্লীল কথাবার্তা তার সঙ্গে বলছে? কানে ধরে একশবার উঠবোস করানো দরকার। যাতে ভবিষ্যতে কোনোদিন এই ধরনেম কথাবার্তা না বলে।