মাওলানা ভাসানী কী বলেছেন?
তিনি বলেছেন–নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
কী বলেন এসব?
পতাকা বদল হয়ে যাবে। চানতারা পতাকা থাকবে না। মাওলানা সাহেব সুফি মানুষ। উনার জীন সাধনা আছে। জীনদের মারফতে তিনি আগে আগে খবর পান। চানতারা পতাকা থাকবে না।
ইরতাজউদ্দিন চিন্তিত মুখে বললেন, যদি হয়ও সেটা ভালো হবে না।
ভালো হবে না কেন?
হিন্দুর গোলামি করতে হবে। মুসলমান হিন্দুর গোলামি করবে সেটা কি হয়?
হেডমাস্টার সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, কপালে গোলামি লেখা থাকলে গোলামি করতে হবে, উপায় কী? তবে দেশ স্বাধীন হলেই হিন্দুর গোলামি করতে হবে–এ কী ধরনের চিন্তা? আপনি আধুনিক মানুষ। আপনি উন্নত চিন্তা করবেন, সেটা তো স্বাভাবিক। এখন তো আমরা গোলামিই করছি। অন্য কিছু তো করছি না। সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের সার্ভিসে বাঙালির সংখ্যা কত জানেন? শতকরা দশেরও কম। সেনাবাহিনীতে বাঙালির সংখ্যা জানেন? না জানাই ভালো। পশ্চিমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যাবার আমাদের উপায় আছে? কোনো উপায় নেই। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব ইলেকশানে জিতে কি পেরেছেন এসেম্বলিতে বসতে? পারেন নি। কারণ তাকে বসতে দেওয়া হবে। না। কোনোদিনও না। এখন যা হচ্ছে তার নাম ধানাই। আর পানাই। কাজেই আমাদের সময় হয়ে আসছে। পতাকা খুলে ফেলে দেওয়ার।
পতাকা নামিয়ে ফেলব?
হ্যাঁ। আপাতত পুরনো পতাকাই উড়ুক। নতুনটা না।
জি আচ্ছা।
আর পতাকার দাম বাবদ বারো টাকা আপনাকে স্কুল ফান্ড থেকে দেওয়া হবে না। পারচেজ কমিটির অনুমোদন ছাড়া আপনি পতাকা কিনেছেন। এটা আপনি পারেন না। সবকিছু নিয়মের ভিতর দিয়ে হতে হবে। নিয়মের বাইরে যাওয়া যাবে না।
জি আচ্ছা।
আর শুনুন, আমার স্ত্রীর জন্য একটু দোয়া করবেন।
জি, অবশ্যই করব। জোহরের নামাজের পরেই দোয়া করব ইনশাআল্লাহ।
ইরতাজউদ্দিন মন খারাপ করে হেডমাস্টার সাহেবেব ঘর থেকে বের হলেন।
স্বাধীন পূর্ববাংলা এই জাতীয় কথাবার্তা ইদানীং খুব শোনা যাচ্ছে, কিন্তু এগুলি কোনো কাজের কথা না। আকাজের কথা। অখণ্ড হিন্দুস্তানে মুসলমানরা অনেক কষ্ট করেছে। জিন্নাহ সাহেব মহাপুরুষ মানুষ ছিলেন, তিনি অভাগা মুসলমানদের মুক্তি দিয়েছিলেন। অকৃতজ্ঞেব মতো সেইসব কথা ভুলে গেলে চলবে না। মুসলমানদের ভুলে গেলে চলবে না যে কোনো হিন্দুর বাড়িতে তারা ঢুকতে পারত না! হিন্দু বাড়িতে মুসলমান ঢুকলে সেই বাড়ি অপবিত্র হয়ে যেত। হিন্দু ময়রার মিষ্টির দোকানে বসে তারা মিষ্টি খেতে পারত না। মুসলমানরা নগদ পয়সা দিয়ে ভিখিরির মতো দুহাত বাড়িয়ে দিত। মিষ্টি ছুঁড়ে দেওয়া হতো সেই হাতে; এই অপমানের ভেতর দিয়ে তাকে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। আজ যারা স্বাধীন বাংলা স্বাধীন বাংলা করছে, তারা কি এই অপমানের ভেতর দিয়ে গিয়েছে? মাওলানা ভাসানী তো গিয়েছেন। তাহলে তিনি কেন এই কাণ্ডটা করছেন? তার মতো বুদ্ধিমান লোক হিন্দুদের চাল বুঝতে পারবেন না তা কী করে হয়?
ইন্ডিয়া যে একটা গভীর ষড়যন্ত্র করছে–এ তো বোঝাই যাচ্ছে। পুরো জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুব সূক্ষ্মভাবে করছে। এটা আর কিছুই না, জিন্নাহ সাহেবের সঙ্গে দাবাখেলায় হেরে যাবার শোধ তোলার চেষ্টা। এতদিন পর তাবা! একটা সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করবে না।
জোহরের নামাজের পর মাওলানা ইরতাজউদ্দিন পাকিস্তানের সংহতি ও মঙ্গলের জন্য দীর্ঘ প্রার্থনা করলেন। হেডমাস্টার সাহেবের স্ত্রীর বিষয়ে দোয়া করার কথা ছিল। করতে ভুলে গেলেন। তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি আবারো নফল নামাজে বসলেন।
সেদিনই দুপুর একটায় রেডিওতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করলেন। তারিখটা হলো
রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে ইয়াহিয়াকে উদ্ধৃত করে ঘোষণা প্রচার করা হলো–
যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্বশীল দুটি প্ৰধান দলের মধ্যকার অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বাধ্য হয়েছি ____ সালের ৩ মার্চের জাতীয় পরিষদের বৈঠক মুলতবি করতে। তবে আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, এ মুলতবি দুই/তিন সপ্তাহের বেশি অতিক্রান্ত হবে না এবং এই স্বল্প পরিসর সময়ে আমি আমাদের দেশের দুই অঞ্চলের নির্বাচিত প্ৰতিনিধিদের মধ্যে সৌহার্দ্য আনয়নে সব ধরনের প্ৰচেষ্টাই করব।
সন্ধ্যা পার হয়েছে। মাগরেবের নামাজ শেষ করে ইরতাজউদ্দিন রান্না বসিয়েছেন। আয়োজন সামান্য। ভাত, ডাল আর আলুভর্তা। বৈয়মে খাঁটি ঘি আছে। আলুভর্তার সঙ্গে দুচামচ ঘি দিয়ে দিবেন। ক্ষুধা পেটে অমৃতের মতো লাগবে। নবিজী দুটা খেজুর খেয়ে অনেক রাত পার করেছেন। সেই তুলনায় রাজ ভোগ।
আলুভর্তা করা গেল না। তিনটা আলু ছিল। তিনটাই পচা। তাছাড়া আলুভতাঁর প্রধান উপকরণ কাঁচামরিচ বা শুকনামরিচ কোনোটাই নেই।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। সবসময় সর্ব পরিস্থিতিতে শুকুরগুজার করতে হবে। আল্লাহপাক শুকুরগুজারি বান্দা পছন্দ করেন।
হাঁড়িতে পানি ফুটছে— ইরতাজউদ্দিন ফুটন্ত পানিতে ডাল ছাড়বেন, তার ঠিক আগে আগে মধু এসে বলল, হেড স্যার ডাকে। রাতে তার সাথে আপনেরে খাইতে বলছেন।
ইরতাজউদ্দিন বললেন, রান্না কী?
মধু বলল, মৈরিলা মাছের ঝোল, টাকি ভর্তা, মাষকলাই-এর ডাইল।