কোনো দরকার নেই। তুমি বরং একটা পেন্সিল দাও আর কবিতার খাতাটা দাও।
মাসুমা এতক্ষণে তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষটা যখন বলল, কিছুক্ষণ একা একা চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকি–তখন তার খুবই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার মনে হচ্ছিল মানুষটা তার সঙ্গ পছন্দ করছে না। এখন দেখা যাচ্ছে ঘটনা সে রকম না। মানুষটা মনে মনে কবিতা নিয়ে ভাবছিল বলেই এরকম বলেছে। এইসব ছোটখাটো কারণে কবি টাইপ মানুষদের স্ত্রীরা ভুল বুঝে।
মাসুমা কবিতার খাতা এবং দুটা পেন্সিল নিয়ে বিছানায় উঠে এলো। লোকটা রাগ করুক বা যাই করুক, সে চাদরের নিচে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকবে। লোকটার পিঠে নাক ঘষবে। লোকটার পিঠে নাক ঘষতে মাসুমার অসম্ভব ভালো লাগে। কেন লাগে কে জানে!
কলিমউল্লাহ কবিতার খাতা এবং পেন্সিল নিয়ে আধশোয়া হয়ে বসেছে। মাসুমা স্বামীর সঙ্গে লেপ্টে শুয়ে আছে। কলিমউল্লাহ কিছু বলছে না। মাসুমা আদুরে গলায় বলল, কবিতাটার নাম কী?
কলিমউল্লাহ বলল, চুপচাপ শুয়ে থাকে। কথা বলবে না।
মাসুমা বলল, সরি! আর কথা বলব না।
কলিমউল্লাহ স্বাধীনতা নিয়ে একটা দীর্ঘ কবিতা লেখার চেষ্টা করছে। প্ৰথম লাইনটা মাথায় চলে এসেছে। দ্বিতীয় লাইন এখনো আসে নি। এইসব ক্ষেত্রে প্রথম লাইন অনেকক্ষণ মাথায় খেলাতে হয়। তখন দ্বিতীয় লাইন আপনাআপনি আসে।
এসেছে রঙিন, জল পড়ে পাতা নড়ে দিন।
এই হচ্ছে প্রথম লাইন। এখানে রঙিন মানে স্বাধীনতা। জল পড়ে পাতা নড়ে হলো শাশ্বত বাংলা।
এসেছে রঙিন, জল পড়ে পাতা নড়ে দিন।
অনেকক্ষণ কথা বলতে না পেরে মাসুমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। দমবন্ধ ভাবটা কাটাবার জন্যে সে বলল, কবিতাঢ়া কী নিয়ে লিখছ?
কলিমউল্লাহ রাগ করল না, সহজ গলায় বলল, স্বাধীনতা নিয়ে। কলিমউল্লাহর গলার শান্ত স্বরে সাহস পেয়ে মাসুমা বলল, তুমি আমাকে নিয়ে অনেকদিন কবিতা লিখছ না। স্বাধীনতার কবিতা পরে লেখ, আগে আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখ।
কলিমউল্লাহ জবাব দিল না। দ্বিতীয় লাইন তার মাথায় এসে গেছে। পুরোটা না, অর্ধেকটা।
বাতাসে বারুদগন্ধ …
এই, আমাকে নিয়ে কবিতাটা কবে লিখবো?
আহা একটু চুপ করো না!
আগে বলে আমাকে নিয়ে কবিতাটা কবে লিখবে, তারপর চুপ করব। স্বাধীনতা এখনো আসে নি, তাকে নিয়ে কবিতা লিখতে বসেছি। আমি তো এসেছি। আমি এতক্ষণ তোমার পাশে শুয়ে আছি, তুমি একবার আমার দিকে তাকাও নি। স্বাধীনতা চোখে দেখা যায় না। আমাকে চোখে দেখা যায়।
কলিমউল্লাহ স্ত্রীর দিকে তাকাল। মাসুমার গায়ে গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। মাসুমাকে সুন্দর লাগছে। গাঢ় রঙ ফর্স মেয়েদের খুব মানায়।
মাসুমা বলল, তুমি আগে বলেছিলে দেশ স্বাধীন হবে না। এখন তো হচ্ছে। হচ্ছে না?
কলিমউল্লাহ জবাব দিল না। মাসুমা প্ৰায় ফিসফিস করে বলল, তুমি রাগ না করলে আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব।
জিজ্ঞেস করো।
না। আগে বলো, রাগ করবে না। আমার গায়ে হাত দিয়ে বলে রাগ করবে না।
কলিমউল্লাহ স্ত্রীর গায়ে হাত দিয়ে বলল, রাগ করব না।
তুমি তো পাকিস্তানিদের পক্ষে অনেক কাজটাজ করেছ। এখন তুমি বিপদে পড়বে না?
না। আমি হচ্ছি গিরগিটি।
তার মানে কী?
গিরগিটি গায়ের রঙ বদলাতে পারে। আমিও পারি। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে, গিরগিটি হতে হয়। তাহলে একটা গল্প শোন। ডারউইন সাহেবের গল্প। সারভাইবেল নিয়ে story.
মাসুমা মুগ্ধ চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। গল্প তার মাথায় ঢুকছে না। মানুষটার বক্তৃতার ভঙ্গিটা দেখতে ভালো লাগছে। মাসুমা মনে মনে জপ করতে লাগল। আমি তোমাকে ভালোবাসি।। আমি তোমাকে ভালোবাসি। সে ঠিক করেছে মানুষটা যতক্ষণ বক্তৃতা দেবে ততক্ষণ সে মনে মনে বলবে আমি তোমাকে ভালোবাসি। শুধু যে মনে মনে বলবে তা না। কতবার বলা হলো তার হিসাবও রাখবে।
কলিমউল্লাহ বক্তৃতা শেষ করে বলেন, আঙুলে কী শুনছিলে?
মাসুমা লজ্জিত গলায় বলল, কিছু না।
আমার যুক্তি তোমার পছন্দ হয়েছে? যে সমাজের জন্যে যে ফিট সেটিকে থাকবে। যে আনফিট সে করে যাবে। বিলো পছন্দ হয়েছে না?
তুমি যা বলো তাই আমার পছন্দ হয়।
তাহলে এখন একটা কাজ করো তো–কাঁচি নিয়ে এসো।
কাঁচি দিয়ে কী করবে?
তোমার সবুজ শাড়িটা কেটে বাংলাদেশের পতাকা বানাব। দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সেদিনই পতাকা উড়াব। লাল রঙের কাপড় আছে? তোমার লাল শাড়ি আছে না?
আছে।
স্বামী-স্ত্রী দরজা বন্ধ করে বাংলাদেশের পতাকা বানাচ্ছে। মাসুমা খুবই মজা পাচ্ছে।
১৬ ডিসেম্বর সকাল
১৬ ডিসেম্বর সকাল নটায় জেনারেল নিয়াজী একটা চিরকুট পেলেন। চিরকুটটি নিয়ে এসেছে ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরার এডিসি। দুই লাইনের চিরকুট পড়তে তার তিন মিনিটের মতো লাগল। তিনি কিছুক্ষণ বিড়বিড় করলেন। বা হাতে কপালের ঘাম মুছলেন। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি বললেন, কী লেখা? নিয়াজী তার হাতে চিরকুট দিলেন। রাও ফরমান আলি চিরকুটটি পড়লেন এবং বাড়িয়ে দিলেন মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে।
চিরকুটে লেখা–প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর সেতুর কাছে। পরামর্শ হচ্ছে, আপনি আমার কাছে আত্মসমর্পণ করুন। আপনার প্রতিনিধি পাঠান।
মেজর জেনারেল নাগরার সঙ্গে নিয়াজী পরিচিত। নাগরা ইসলামাবাদে অনেকদিন ছিলেন। ভারতীয় দূতাবাসে তিনি ছিলেন মিলিটারি এটাচি। সেখানেই পরিচয়, সেখানেই সখ্য।
মেজর জেনারেল ফরমান আলি নিয়াজীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আত্মসমর্পণের আলোচনা কি আমরা নাগরার সঙ্গে করব?