শরণার্থী শিবিরেব মানুষরা অস্থির হয়ে পড়েছেন দেশে ফেরার জন্যে; দুই পক্ষের ভয়াবহ গোলাগুলির মধ্যেই তারা দেশে ঢুকতে শুরু করেছেন। স্বাধীন হবার আনন্দ তারা নিজ দেশে বসে পেতে চান।
এমনই এক অস্থির সময়ে (সন্ধ্যার ঠিক পর পর) শাহেদকে বারাসতের গ্রামের একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখা গেল। তার হাতে নাইমুলের দেযা ঠিকানা। সে অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত এসেছে। কাগজে লেখা ঠিকানা শেষ পর্যন্ত খুঁজে বের করেছে। এখন আর তার সাহসে কুলাচ্ছে না; বাড়ির দরজায় ধাক্কা দিয়ে সে যে জানতে চাইবে–এখানে আসমানী নামের কেউ আছে, এই সহজ কাজটা কালতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে তাকে বলা হবে, না। এই নামে তো কেউ থাকে না,। কিংবা বলা হবে–হ্যাঁ এই নামে একটি মেয়ে ছিল, তারা এখন নেই। কোথায় আছে তাও বলতে পারছি না।
হঠাৎ শাহেদের মনে হলো, তার কৃষ্ণা পেয়েছে। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যাচ্ছে। আসমানীর খোঁজ না করে তার এখন উচিত ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি খেতে চাওয়া।
দরজার কড়া নাড়তে হলো না, দরজা খুলে গেল। এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ বিস্মিত ভঙ্গিতে এগিয়ে এলেন। শাহেদকে বললেন, কাকে চান?
শাহেদ আমতা আমতা করে বলল, পানি খাব, এক গ্রাস পানি খাব। আসুন ভেতরে এসে বসুন। জল এনে দিচ্ছি। শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, এই বাড়িতে কি আসমানী নামের কেউ থাকে? আর একটি ছোট্ট মেয়ে রুনি।
আপনি তাদেব কে হন?
রুনি আমার মেয়ে।
শাহেদের শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। বৃদ্ধ এগিয়ে এসে শাহেদের হাত ধরলেন। কোমল গলায় বললেন, আপনার স্ত্রী এবং কন্যা আমার এখানেই আছে। তারা ভালো আছে। আসমানী বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটে আছে। মেয়েটা বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকে। আপনি কি আগে তার কাছে যাবেন, না জল খাবেন?
শাহেদ বিড়বিড় করে বলল, পুকুরঘাট কোন দিকে?
বৃদ্ধ ঘাট দেখিয়ে দিলেন। শাহেদ এলোমেলো পা ফেলে এগুচ্ছে। সে নিশ্চিত ঘাট পর্যন্ত যেতে পারবে না। তার আগেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এখন সে নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।
তারো কিছুক্ষণ পরে রুনি মায়ের খোঁজে পুকুরঘাটে এসে একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখল। মা অচেনা অজানা দাড়ি গোফওয়ালা এক লোককে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো চুমু খাচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর লজ্জার ব্যাপার!
রুনি তীক্ষ্ণ গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে মা? কী হচ্ছে এসব?
আত্মসমৰ্পণ করুন
ভারতীয় সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল স্যাম মানেক শ’র আহ্বান ভারতীয় বেতারে ক্রমাগত প্রচারিত হচ্ছে–
আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।
আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমপণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।
আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।
আমার সৈন্যরা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে! আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার করা হবে।
আমার সৈনারা এখন ঢাকাকে ঘিরে ধরেছে এবং ঢাকার সেনানিবাস কামানের গোলার পাল্লার মধ্যে। আত্মসমৰ্পণ করুন। নিরাপত্তা ও ন্যায়সঙ্গ ত ব্যবহার করা হবে।
চৌদ্দই ডিসেম্বর ভোরবেলা
চৌদ্দই ডিসেম্বর ভোরবেলা মরিয়মের ঘুম ভাঙল একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। কে যেন দরজার কড়া নাড়ছে। কড়া নাড়ার শব্দে একধরনের অস্থিরতা। মরিয়ম বলল, কে? দরজার ওপাশ থেকে ভারী গম্ভীর গলা শোনা গেল, মরি, দরজা খোল। ঘুমের মধ্যেই মরিয়মের শরীর কঁািপতে লাগল। চলে এসেছে, মানুষটা চলে এসেছে! সে তার কথা রেখেছে। সে বলেছিল দেশ যেদিন স্বাধীন হবে সেদিন আসবে। দেশ তো স্বাধীন হবেই। মনে হয় আজই হবে। মরিয়ম সাবধানে বিছানা থেকে নামল। সবাই গভীর ঘুমে। সে শুধু জেগেছে। ভালো হয়েছে। খুব ভালো হয়েছে। মানুষটার সঙ্গে যখন তার দেখা হবে, তখন আশেপাশে কারো না থাকাই ভালো। স্বপ্ন হঠাৎ সামান্য পরিবর্তিত হলো। সে ফিরে গেল পুরনো বাড়িতে। শোবার ঘরের দরজা খুলেই সে দেখল তার বাবাকে। দীর্ঘদিন তার কোনো খোঁজ নেই, অথচ স্বপ্নে সে ব্যাপারটা মনে থাকল না।
মোবারক হোসেন মেয়েকে দেখে হাসিমুখে বললেন, নাইমুল এসে কখন থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে, তুই দরজা খুলছিস না কেন? কী রকম ঘুম ঘুমাস! মেয়েছেলের নিদ্রা হবে পাখির পালকের মতো। যা দরজা খোল। মরিয়ম সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল, তখন মোবারক হোসেন আরেকবার ধমক দিলেন, সেজোগুজে যা। শাড়িটা বদলা। এতদিন পরে জামাই এসে যদি দেখে একটা ফকিরনি বসে আছে, তার ভালো লাগবে? তোর গয়নাগুলি কই? গয়না পর। ভালো শাড়ি যদি না থাকে বিয়ের শাড়িটা পর।
মরিয়ম শাড়ি বদলাল। স্বপ্নে শাড়ি বদলানোটা অতি দ্রুত হলো। হালকা নীল রঙের শাড়ি চোখের নিমিষে হয়ে গেল বিয়ের শাড়ি। গা ভর্তি হয়ে গেল গয়নায়। দেরি হচ্ছে শুধু কাজল দিতে। ঘরে আলো কম বলে চোখ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না। দেরি দেখে মোবারক হোসেন মেয়ের বন্ধ দরজায় ধুম ধুম করে কিল দিচ্ছেন। মরিয়মের ঘুম ভাঙল ধুম ধুম শব্দে।