আসমানী বলল, এই কদিন কোথায় খেয়েছ? নিজে রান্না করেছ, না হোটেলে?
শাহেদ গম্ভীর গলায় বলল, হোটেলে।
ভাইজান কবে গেছেন?
চেপে রেখে বলল, যেদিন এসেছেন তার পরদিনই চলে গেছেন।
আমি উনাকে চিঠি লিখেছিলাম আমচুর নিয়ে আসতে। এনেছেন?
শাহেদ জবাব দিল না। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এইসব হচ্ছে আসমানীর খাতির জমানো কথা। খেজুড়ে আলাপ। এই আলাপে যাবার কোনো মানে হয় না।
আসমানী বলল, তোমাকে নাশতা দিয়ে দেই? চালের আটার রুটি আর কবুতরের মাংস।
কবুতর খাই না।
কবুতর খাও না কেন?
কেন খাই না। এত ব্যাখ্যা তো দিতে পারব না। খাই না মানে খাই না।
কবুতরের মাংস ছাড়া অন্য কোনো মাংস হলে খাবে?
শাহেদ বিরক্ত চোখে তাকাল। আসমানীর চোখে-মুখে চাপা হাসি। আসমানী বলল, তুমি কবুতরের মাংস খাও না, আমি জানি। মা কবুতরের মাংস রান্না করেছিল। আমি ফ্রিজের বাসি গরুর মাংস নিয়ে এসেছি। গরম করে দিচ্ছি, তুমি খাও।
শাহেদ কিছু বলল না। গভীর মনোযোগে পত্রিকা পড়তে লাগল। তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে রুনির দিকে। মেয়েটা বাবাকে চিনতে পারছে না–এই ঢং কোখেকে শিখেছে? নিশ্চয়ই মার কাছ থেকে। কাগজে কাকের ঠ্যাং, বকের ঠ্যাং আঁকাটা কি এখন এতই জরুরি? তার উপর দেখা যাচ্ছে তার বা হাতের একটা আঙুলে ব্যান্ডেজ বাধা। কী করে ব্যথা পেয়েছে এটাও সে বলবে না?
আসমানী বলল, হ্যালো রাগ কুমার! তুমি যদি ভাবো। আমি তোমার কাছে সরি বলব, তাহলে ভুল করেছ। তোমার উপর রাগ করে আমি যে চারদিন মায়ের কাছে ছিলাম, আমি ঠিকই করেছি। তবে ভাইজানের সঙ্গে দেখা করতে আসি নি–এটা খুবই বড় ভুল হয়েছে। এই ভুলের জন্যে আমি বড় ভাইজানের কাছে ক্ষমা চাইব। তোমার কাছে ক্ষমা চাইব কেন?
শাহেদ বলল, আমি তো তোমাকে ক্ষমা চাইতে বলছি না। কেন এত কথা दब्लछ?
আসমানী বলল, তুমি যদি স্বাভাবিকভাবে আমার সঙ্গে কথা না বলো, তাহলে আমি কিন্তু আবার মার কাছে চলে যাব।
যেতে চাইলে যাবে। মাংস গরম করে এনেছি, খেতে এসো। আচ্ছা আমি ভুল করেছি। সরি। এখন পায়ে ধরতে পারব না। রাতে পায়ে ধরব। সত্যি পায়ে ধরব।
এই কথার পর শাহেদের উচিত ছিল স্বাভাবিকভাবে খেতে বাসা। ঝোল ঝোল মাংস, চালের আটার রুটি তার খুবই পছন্দের খাবার। আসমানী নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্যেই বোধহয় হঠাৎ শাহেদের রাগ বেড়ে গেল। সে খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলে গাঁটগট করে বের হয়ে গেল। তার রাগটা কমে গোল রিকশায় উঠার সঙ্গে সঙ্গে। তখন আর ফেরা যায় না। রিকশাওয়ালা রিকশা টানতে শুরু করেছে।
শাহেদ দাঁড়িয়ে আছে অফিসের সামনে। অফিস খুলেছে। সে ইচ্ছা করলেই তার চেয়ারে বসতে পারে। অফিসের পাশেই ছাপড়া রেস্টুরেন্টের মতো আছে। রেস্টুরেন্টের মালিক বিহারি, সে সকালে রুমালি রুটি এবং মুরগির লটপট নামে একটা খাদ্য তৈরি করে। অতি সুস্বাদু। অফিসের পিওন পাঠিয়ে সেখান থেকে নাশতা আনা যায়। ভালো ক্ষিধে লেগেছে। ক্ষিধের চোটে বুক জ্বালা করছে। কিন্তু শাহেদের অফিসে ঢুকতে ইচ্ছা করছে না। তার ইচ্ছা করছে বাসায় ফিরে যেতে।
কেমুন আছেন Young man?
শাহেদ চমকে তাকাল। বি হ্যাপি স্যার ঠিক তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। এই ভদ্রলোকের শরীর ভারী কিন্তু তিনি হাঁটেন নিঃশব্দে।
অফিসে এখন এমুন কী কঠিন কাজ যে Early আসতে হোবে?
স্যার, ভালো আছেন?
অফকোর্স ভালো আছি। আপনার ছোট বাচ্চাটা কেমুন আছে–Little baby?
স্যার, ভালো আছে।
Be happy young man, Be happy
বলেই আরাফী সাহেব শাহেদের কাধে হাত রাখলেন। শাহেদ জানে, ভদ্রলোক কাঁধ থেকে হাত সরাবেন না। এইভাবেই অফিসে ঢুকবেন। ভদ্রলোকের ব্যবহার কতটুকু আন্তরিক এবং কতটুকু ভান কে জানে! বেস জাতীয় মানুষদের কাছ থেকে ভালো ব্যবহার পাওয়া যায় না। যখন পাওয়া যায়। তখন মনে হয় কোথাও বোধহয় সমস্যা আছে।
শাহেদ সাব।
জি স্যার।
ব্যবসা তো সব বন্ধ। জয় বাংলা বলে চিৎকার করলে তো পেটে দানাপানি আসবে না। ঠিক বুলেছি?
বসদের সব কথাতেই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়তে হয়। শাহেদ তাই নাড়ল।
মইন আরাকী হাসিমুখে বললেন, বি হ্যাপি ইয়াং ম্যান। বি হ্যাপি।
শাহেদ মনে মনে ঠিক করল কোনো একদিন সুযোগ পেলে সে জিজ্ঞেস করবে–বি হ্যাপি বলা তিনি কবে থেকে শুরু করেছেন? প্রথম তিনি কাকে বলেছিলেন, বি হ্যাপি?
ঢিলাঢালাভাবে অফিস শুরু হয়েছে। অফিসের লোকজনও সব আসে নি। চারদিক ফাঁকা ফাকা। এই অফিস আগে গামগম করত। নানান ধরনের লোকজন নানান ধান্ধায় ঘুরত। একতলার গোডাউন সেকশনে হৈহল্লা হতো। মারামারি মাথা ফাটাফাটি হতো। এখন সব ফাঁকা। গোডাউনে কোনো মাল নেই। অফিসের লোকজনেরও কোনো কাজকর্ম নেই। আগে যেখানে হেড ক্যাশিয়ার আসগর আলি দেওয়ান এক হাজার ভাউচারে সই করতেন, সেখানে উনি এখন পনেরো-বিশটার বেশি ভাউচার সই করেন না। হাতের কাজ শেষ হয়ে যায় দুপুরের আগেই। তখন তিনি আরাম করে পান খান এবং এই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ করেন। এই বিষয়ে গল্প করতে তার ভালো লাগে। তার ধারণা এই দেশের কপালে আল্লাহপাক বোল্ড লেটারে লিখে দিয়েছেন–Closed, রেস্টুরেন্টে যেমন Closed সাইনবোর্ড কুলায় সে-রকম। তাঁর ধারণা এই দেশের অতীতে কিছু হয় নি, ভবিষ্যতেও কিছু হবে না। কেউ তাঁর কথার বিবোধিতা করলে তিনি ঠাণ্ডা গলায় বলেন, আপনার পুরা নামটা যেন কী? আব্দুল গনি না? এখন থেকে নামের শেষে শিশু টাইটেল লাগায়ে দেন। বর্তমানে আপনার নাম আব্দুল গনি শিশু। আপনার চিন্তাশক্তি শিশু লেভেলে। বুঝেছেন?