এ কী, তুমি এখনো বসে আছ মেয়েটাকে কোলে নাও। তার জ্বর।
ইরতাজউদ্দিন লজ্জিত গলায় বললেন, মেয়েটার নাম কী?
আসমা অত্যন্ত বিরক্ত হলো। এই ভয়ঙ্কর সময়ে তুমি তামশা করছি? নিজের মেয়ের নাম তুমি জানো না?
এই বলেই সে চুপ করে মেয়েটাকে ইরতাজউদিনের কোলে ফেলে দিল। তখন বাইরের হৈচৈ প্ৰবল হলো। লোকজন আগুন আগুন করছে। চারদিকে ছোটাছুটি করছে। মেশিনগানের একটানা গুলির শব্দও শোনা যাচ্ছে। ইরতাজউদ্দিন মেয়েটাকে কোলে নিয়ে ছুটে রাস্তায় নেমে এলেন। রাস্তায় শত শত মানুষ। সবাই একসঙ্গে দৌড়াচ্ছে। আসমা শক্ত করে ইরতাজউদ্দিনের বাঁ হাত ধরে আছে। একজন রূপবতী তরুণী তার হাত ধরে দৌড়াচ্ছে—এটা একটা লজ্জাজনক দৃশ্য। অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে একটা সুবিধা হয়েছে, কেউ তাদের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে না। রোজ-হাসরের মতো অবস্থা। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। সবাই ইয়া নফসি ইয়া নফসি করছে। মহাবিপদের আশঙ্কায় সবাই ভীত।
বিপদের উপর বিপদ, লোকজন যে দিকে যাচ্ছে ঠিক সেই দিক থেকেই আরো একদল মানুষ দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। তারা জয় বাংলা জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। তাদের চিৎকারে ইরতাজউদিনের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন–সত্যি সত্যি বিশাল মিছিল বের হয়েছে। রাস্তায় শত শত মানুষ। তাদের হাতে লাঠিসোটা, বর্শা। তারা আকাশ ফাটিয়ে চিৎকার করছে।–জয় বাংলা জয় বাংলা। মিছিলের সঙ্গে একটা ঠেলাগাড়িও যাচ্ছে। ঠেলাগাড়ির মাঝখানে একজন পা ছড়িয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা তলোয়ার।
ইরতাজউদ্দিন মিছিলের দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ভুরু কুঁচকে আছে। জয় বাংলা বাক্যটা তার ভালো লাগছে না। জয় বাংলা এসেছে জয় হিন্দ থেকে। এটা ঠিক না। তাছাড়া লাঠিসোটা, বল্লম দিয়ে কিছু হয় না। একশ বছর আগেও বাঁশের কেল্লা দিয়ে তিতুমীর কিছু করতে পারে নি। শুধু শুধুই পরিশ্রম। এটা একটা আফসোস যে বাঙালি জাতি কাজে পরিশ্রম করতে পারে না, অকাজে পারে।
শাহেদ রাত বারোটার দিকে শুকনো মুখে ফিরল। সঙ্গে কেউ নেই। সে একা ফিরেছে। ইরতাজউদ্দিন বললেন, কিরে এত দেরি? শাহেদ মাটির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, ওদের পেলাম না ভাইজান।
পেলি না মানে কী?
আমার শাশুড়ির এক দূরসম্পর্কের বোন থাকেন। ভূতেরগলিতে। ওরা দল বেঁধে ঐ বাড়িতে গিয়েছে। এতক্ষণ অপেক্ষা করলাম। যদি ফেরে। ফেরে নি। মনে হয় থেকে যাবে। মাঝে মাঝে ওরা সেখানে থেকে যায়। ঐ মহিলা রুনিকে খুব আদর করেন। ওদের কোনো বাচ্চাকাচ্চা নেই তো, রুনিকে নিজের মেয়ের মতো দেখেন। বলতে গেলে উনিই জোর করে রেখে দিয়েছেন।
ইরতাজউদিনের মন আবারো খারাপ হলো। শাহেদ মিথ্যা কথা বলছে। হড়বড় করে মিথ্যা বলছে। বউ আসতে রাজি হয় নি, এটা বললেই হয়। বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা বলার দরকার কী? মিথ্যা এমন জিনিস যে কয়েকবার বললেই অভ্যাস হয়ে যায়। তখন কারণ ছাড়াই মিথ্যা বলতে ইচ্ছা করে।
ভাইজান, আপনি কি শুয়ে পড়বেন? রাত অনেক হয়েছে। শুয়ে পড়াই ভালো। বিছানা করে দেই?
দে।
খালি পেটে ঘুমুবেন? ক্ষুধা হয় নি?
ক্ষুধা হয়েছে তারপরেও ইরতাজউদ্দিন বললেন, না। মিথ্যা বলা হলো। তিনি যদি বলতেন। ক্ষুধা হয়েছে, তাহলে ভাত রাধার ব্যাপার চলে আসবে। শাহেদ বিব্রত হবে। সে তার বড় ভাইকে ভাত রাঁধতে দেবে না। নিজেই রাধতে গিয়ে ছেড়াবেড়িা করবে। এরচেয়ে মিথ্যা বলাই ভালো। উপকারী মিথ্যা। তারপরেও মিথ্যা মিথ্যাই। অপকারী মিথ্যা যেমন দূষণীয়, উপকারী মিথ্যাও তেমনি দূষণীয়। ইরতাজউদ্দিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোকে ক্ষুধা হয় নি বলেছিলাম এটা ঠিক না, মিথ্যাচার করেছি; ক্ষুধা হয়েছে। তবে কিছু খাব না। শুয়ে পড়ব। বিছানা করে দে। মশারি খাটাবি না।
মশারি না খাটালে ঘুমুতে পারবেন না। খুব মশা।
থাকুক। মশা। মশারির ভেতর আমার ঘুম আসে না। দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে।
শাহেদ বসার ঘরে তার ভাইয়ের জন্য বিছানা করল। খুঁজে-পেতে একটা হাতপাখাও বের করল। ইব্রতাজউদ্দিন শোবার সময় অবধারিতভাবে সিলিং ফ্যান বন্ধ করে দেবেন। কারণ, ফ্যানের বাতাসেও তিনি ঘুমুতে পারেন না। ফ্যানের বাতাসে না-কি তার শরীর চিড়বিড় করে।
মশা আসলেই বেশি। চারদিকে পিনপিন করছে। বাতি নেভালে কী অবস্থা হবে কে জানে। হাতো এই গবমেও চাদর মুড়ি দিয়ে শুতে হবে। ইরতাজউদ্দিন যেসব কারণে ঢাকা আস৩ে চান না মশা তার একটি। তিনি ছোটভাইকে বললেন, তুই শুধু শুধু জেগে আছিস কেন? শুয়ে পড়।
শাহেদের কিছুক্ষণ গল্প করতে ইচা করছে। দেড়টা-দুটার আগে সে কখনো ঘুমায় না। এখন বাজছে মাত্র সাড়ে বারটা। তা ছাড়া শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তার মেজাজ খারাপ হয়েছে। তার বড়ভাই এসেছেন–এটা জানার পরেও আসমানী তার সঙ্গে আসবে না, এটা ভাবাই যায় না। শাহেদ খুবই করুণ গলায় বলেছে, ভাইজান এসেছে। আস, প্লিজ আস। তার উত্তরে আসমানী বলেছে, তোমার ভাইজান এসেছে, তুমি তাকে কোলে নিয়ে বসে থাক। আমি কী জন্যে যাব?
আসমানী এধরনের কথা বলতে পারে তা শাহেদের কল্পনার মধ্যেও ছিল না। তার খুবই মনখারাপ হয়েছে। ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে সে মনখারাপ-ভাবটা কাটাতে চাচ্ছে। কিন্তু ইরতাজউদ্দিনের মনে হয় গল্প করার মতো অবস্থা না।
শাহেদ বলল, ভাইজান, ঢাকায় কোনো কাজে এসেছেন? না-কি বেড়াতে এসেছেন?