তোমাদের অধঃপতনের মূলটা কোথায় জান! তোমাদের ঐ ভাষা। ঐ ভাষা তোমাদের যতদিন থাকবে ততদিন হিন্দুদের গোলামী থেকে তোমরা মুক্ত হতে পারবে না।
তাতে কোনো সন্দেহ নাই হুজুর।
সামনে তো সবি স্বীকার কর তোমরা। কিন্তু পেছনে গেলেই উলটো সুর ধরবে। তোমাদের বিশ্বাস আছে কিছু! তোমরা সব মোনাফেক আদমী আছ!
এটা হুজুর হক কথা বলেছেন। কিন্তু এই বান্দা আপনার সাথে কখনো মোনাফেকী করবে না।
করলেও বাঁচবে না। যতো গুনার কাম করেছ সবের তালিকা আমার। ফাইলে আছে। দরকার হলে সেগুলি বের করা হবে। কিন্তু আশা করি তার প্রয়োজন হবে না।
মালেক সাহেব কিছু বলার না পেয়ে মাথা নত করে চুপ করে রইলেন।
খান সাহেব বলে চললেন–
তোমার একাডেমির কাজ হবে মাশরেকী পাকিস্তানে উর্দু চালু করা,আর একদল বুদ্ধিজীবী তৈরী করা যারা আমার শাসনের গুণগান করবে।
মসজিদে আপনার নামে খুৎবা চালু করে দেব হুজুর।
আহ সেটা তো বড়ো হক কথাই বলেছ হে। কিন্তু কথা কি জান। আরবি ভাষায় কে কী বলবে তা তো লোকে বুঝবে না। লোকে যা বুঝবে না তা আর বলে লাভ কী!
না হুজুর, উর্দুতে খুত্বা চালু করে দেব। উর্দু তো শিখতেই হবে সকলকে।
শুধু শিখতে হবে মানে কী? অফিসে অন্দর মহলে সবখানে ঐ এক উর্দুই থাকবে। বাংলা বিলকুল হারাম হয়ে যাবে। কেননা বাংলা থাকা মানেই তো হিন্দুয়ানী থাকা। পাকিস্তানে আমি তো হিন্দুয়ানী চলতে দিতে পারি নে। বল,
তা বটে। তবে হুজুর, ওখানে উর্দু যে কারো মাতৃভাষা নয়।
বহু সাহস বুকে নিয়ে মালেক সাহেব এই একটিবার কিঞ্চিৎ প্রতিবাদের সুরে কথা বললেন। আর যায় কোথায়। গর্জে উঠলেন খান সাহেব—
হোয়াট ননসেস্। উর্দু এখানেই বা কার মাতৃভাষা? কারো না। তবু সকলে আমরা দেশের ঐক্য বজায় রাখার খাতিরে উর্দুকে মেনে নিয়েছি। তোমরা এমন কি নবাবের বাল এসেছ যে মানবে না।
এই পাঠানী যুক্তির কাছে মিঃ আব্দুল মালেক হার মানলেন। তাই তো তিনিও তো একদা জাতীয় সংহতির খাতিরে রবীন্দ্রনাথকে পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত ছিলেন। তাহলে? এখন তা হলে জাতীয় সংহতির জন্য বাংলা ভাষাকে বাদ দিতে আপত্তি থাকবে কেন? না তার আপত্তি নেই। আপত্তি হবে দেশের ওই বেকুব জনসাধারণের। ভাষার প্রশ্নে কোন যুক্তি ওরা মানতে রাজী নয়। একটু ভেবে মালেক সাহেব বললেন—
হুজুর, আমার মনে হয়, এ ব্যাপারে কিছু চালাকির আশ্রয় নিতে হবে। প্রথমেই উর্দুর কথা বললে দেশে হট্টগোল হৈ-চৈ শুরু হয়ে যাবে।
না-না, হৈ-হাঙ্গামা বাধাতে পারবে না। বাঙালি বড়ো হুজুগপ্রিয়। হৈ হাঙ্গামা পেলে আর কিছু চায় না। তখন তাকে শান্ত করাই মুশকিল হবে। শান্তিপূর্ণভাবে কাজ হাসিল করতে হবে।
হুজুর সে জন্যই বলছিলাম প্রথমেই ওদেরকে বাংলা ভাষা ভুলিয়ে দিতে হবে। তারপর একটু একটু করে দিতে হবে উর্দু।
বাহ, ভারি চমৎকার প্ল্যান তো! বাঙালিকে বাঙলা ভুলিয়ে দেওয়ার একটা প্ল্যান দিলেন মালেক সাহেব। খান সাহেব তাতে উল্লসিত হলেন। কোনো হৈ চৈ নেই। ন্যাশনাল ইন্টেগ্রিটি রক্ষার জন্য একাডেমি হয়ে গেল। মালেক সাহেব তার ডিরেক্টর হলেন। কিন্তু ঐ একাডেমির কী যে কাজ, কেউ তা জানল না। ঐ একাডেমির কথা লোকে ভুলেই গেল। তবে যথাক্রমে একদা বাংলা একাডেমি, এবং পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা হরফ সংস্কারের প্রস্তাব পাশ। করে বসল। মালেক সাহব কোথায় কি কলকাঠি নাড়লেন দেশবাসী তার। বিন্দু-বিসর্গ কিছু জানল না। জানলেন খান সাহেব। তাকে জানিয়ে দেওয়া। হল-কেল্লা ফতে। এমনভাবে হরফ সংস্কারের প্রস্তাব পাস করানো হয়েছে যে, ঐ ভাবে হরফের সংস্কার সাধন হলে প্রচলিত বাংলা হরফে ছাপানো বই এ দেশে ভবিষ্যতে একখানিও কেউ পড়তে পারবে না। তার মানেই কলকাতার বই পাকিস্তানে সম্পূর্ণ অচল হয়ে যাবে। তার বদলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। উর্দু বইয়ের সাপ্লাই দিতে হবে। অবশ্যই প্রথমে বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে। দরকার হলে এই অনুবাদ করা বইগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের পাঠ্য করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কেবলি বাংলা বই পড়তে হবে তার কি মানে আছে? বাংলা বইয়ের নামে পড়াচ্ছাে তো খালি হিন্দুয়ানীতে ভরা কলকাতার বই। কেন, লাহোরের উর্দু বই বাংলাতে তরজমা করে বাংলা শশালে পাঠ্য করতে পার না? এমন একটা বিতর্কও কে বা কারা বাজারে চালু করে দিল। মালেক সাহেব তাঁর হুজুর আয়ুব-মোনায়েমকে জানিয়ে দিলেন–কাজ চলছে ভালো। বাংলার সিলেবাসে এইভাবে উর্দু বই চাল হয়ে গেলে বাঙালির মস্তিশুদ্ধির কাজ কিছুটা এগোবে, কলকাতার বইয়ের মারফতে যে সকল হিন্দুয়ানী ভাবধারা এসে আমাদের পাক মস্তিষ্ককে অনবরত না-পাক করাছে তার এবার সমাপ্তি ঘটবে। এ সব হল নেপথ্য কথা। প্রকাশ্যে যেটা দেশবাসীকে জানানো হল তা হচ্ছে-বাংলা হরফ অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক। যেহেতু আমরা সমাজের সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে চাই সেই হেতু এই অবৈজ্ঞানিক বাংলা হরফকে কিঞ্চিৎ বিজ্ঞানসম্মত করতেই হচ্ছে। এর ফলে বাংলা ভাষার প্রসার দ্রুত হবে। ইত্যাদি….।
এইভাবে কীর্তিমান মালেক সাহেব আউয়ুব খানের আমলেও বহাল তবিয়তে উন্নতির মই বেয়ে উপরে উঠে যেতে লাগলেন। ইতিমধ্যে এল ১৯৬৯-এর গণ অভুথান। আউয়ুবখান বিদায় নিলেন। যে দিন সন্ধ্যায় আউয়ুব খানের বিদায়বার্তা রেডিওতে ঘোষিত হল সেদিন মালেক সাহেব, অন্য কেউ না জানলেও সে কথা তাঁর স্ত্রী জানেন, সারারাত কেঁদে বালীশ ভিজিয়েছিলেন। হায় হায়, এই তো কমাস আগেই আউয়ুব খানের বইয়ের, Frend not Master গ্রন্থের বঙ্গানুবাদ করে কয়েক হাজার টাকা কামাই করেছিলেন। এখন উপায়! সকলেই যে বলে, আব্দুল মালেক হচ্ছে আইয়ুব খানের নাম্বার ওয়ান দালাল। হায় খোদা, এখন কী হবে! মালেক সাহেবকে চান্স খোদা ঠিকই মিলিয়ে দিলেন। প্রায় দুবছর তিনি সময় পেলেন হাতে। ১৯৬৯-এর মার্চে ইয়াহিয়া খান শীঘ্রই ক্ষমতা হস্তান্তরের যে প্রতিশ্রুতি জাতিকে দিয়েছিলেন কোনোদিনই তা পালিত হয় নি আজ-কাল করে কেটে গেছে দুটি বছর। সেই দ বছরে অতি বুদ্ধিমান আব্দুল মালেক ধীরে ধীরে কাজ গুছিয়ে ফেলেছেন। রবীন্দ্র-জয়ন্তীতে গদ গদ কণ্ঠে বক্তৃতা করে প্রচার করেছেন— রবীন্দ্রনাথ আমাদের সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ছাত্রদের এক সাংস্কৃতিক সভায় বলেছেন, দেশের ভৌগোলিক পরিবেশ ও দেশের ভাষাই হচ্ছে জাতি-গঠনের মৌল উপাদান, জাতীয় সত্তার কোন অপরিহার্য অঙ্গরূপে ধর্মের কোনো স্থান থাকতেই পারে না। একদা প্রবন্ধ লিখে রবীন্দ্রনাথকে পাকিস্তান থেকে নির্বাসন দিতে চেয়েছিলেন। এবার তিনি বই লিখে তা জীবনানন্দের স্মৃতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন। নজরুল ইসলাম হাজার হলেও গান লিখে মুসলমানিত্ব জাহির করেছেন, অতএব কঠোর ভাষায় তাঁর সমালোচনা করে সাহিত্যে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর জোর দিয়ে প্রবন্ধ লিখলেন। যে গোঁফ খুর দিয়ে চাঁছা শুরু করেছিলেন এবার আবার তাকে কিছুটা বাড়তে দিলেন। কিন্তু এতো সব করেও হালে পানি পাচ্ছেন না দেখে আওয়ামী লীগ রিলিফ ফান্ডে এক হাজার টাকা চাঁদা দিলেন। দেখাই যাক, এবার ভাইসচ্যান্সেলর যদি হওয়া যায়!