মা, আব্বু।
উনি এখন মানুষের সাথে কথা বলছেন, দেখছ না।
হাঁ, সুদীপ্ত এখন গল্প করার লোক পেয়ে গেছেন। আব্বাকে ফেলে যেতে তার মন কেমন করছে। মায়ের মুখের পানে তাকিয়ে সে বলেছিল
আমি আব্বার কাছে থাকি আম্মু।
বেলার দিক থেকে কথাটা খুবই সিরিয়াস ছিল। তবু সকলে সেটা খুবই হালকাভাবে নিলেন। অন্য সময় হলে হাসতেন। কিন্তু এখন সহজে হাসি আসতে চায় না।
আমিনা তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখেন, ও মা এ কি এলাহী কাণ্ড! এতো মানুষ বাড়িতে! এতোগুলো মানুষের এত কাছাকাছি। তাঁরা এতোক্ষণ ছিলেন। অথচ এতো দূরে!
আপনি ভীষণ ডেন্জারাস্ মেয়ে দেখি, বহু মানুষের দেখা পেতেই আমিনার মধ্যে স্বাভাবিকতা ফিরে এল–এতো মানুষের বাড়িতে আমরা ছিলাম,অথচ এতো একাকী!
সামান্য একটু হাসলেন বুলা। বললেন—
কোয়ার্যানটীনে রেখেছিলাম, বুঝলেন না!
আমিনাকে তাঁর ফুফু-আম্মার ঘরে দিয়ে বুলা ফিরে গেলেন। দুতালার ঘর, কোনো খাট কিংবা তক্তপোষ কিছু নেই। সারা মেঝেতে বিছানা পাতা। ওইখানে মেয়েরা থাকবেন। নিচে দুখানা ঘরে থাকবেন পুরুষেরা। থাকবেন মাত্র এই এক রাত্রির জন্য।
বুলা নীচে এসে খবরটা দিলেন—
চারপাশে ঢাকা শহর জ্বলছে।
সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তকে নিয়ে জামাল সাহেব ছাদে চলে গেলেন। এ দুজনেই। কেবল গেলেন, অন্যদের খবরটা দেওয়া হয়নি। এতো আগুন না দেখাই ভালো। এখনো এতো আগুন? গত তিন রাত সমানে জ্বালিয়ে পুড়িয়েও কি ঢাকা শহর শেষ হয়নি! জামাল সাহেব বললেন–
ঐ আগুনটা শান্তিনগরের দিকে মনে হয়!
শান্তিনগরের বাজার হতে পারে।
ঠিক ধরেছেন। জামাল সাহেব বললেন, আজ ওই বাজারে লুট হয়ে গেছে খবর পেয়েছি। লুটপাট করে নিয়ে এখন ওখানে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।
তা হলে লুট হয়ে যাওয়ার খবর জামাল সাহেবও জানেন। সুদাত বললেন
লুটপাট না হয় করল। কিন্তু আগুন দিল কেন?
ওখানেই তো মজা। কালই দেখবেন, ওরা রেডিওতে প্রচার করবে, অমিরা। আওয়ামী লীগের লোকেরা ওই বাজারে আগুন ধরিয়ে দিয়েছি।
কিন্তু এই মিথ্যাচারে ওদের লাভ?
লাভ? বুঝতে পারলে না অধ্যাপক। এই জন্যই অধ্যাপক হয়েছ। শয়তানদের মতলব বুঝবে সেই সাধ্য যদি তোমাদের থাকত! জামাল সাহেব বুঝিয়ে দিলেন
প্রথম লাভ, বিনা পয়সায় অত গম, চিনি, কেরোসিন ইত্যাদি পেয়ে গেল ওরা। বঙ্গাল মুল্লুকে আপনাদের মারতে এসে পয়সা খরচ করে খেতে হবে। নাকি! দ্বিতীয় লাভ, জিনিসপত্র যে লুটপাট হয়ে গেছে সেটা বলতে হল না। তা হলে আর্মির অকর্মণ্যতা প্রমাণিত হয়। তৃতীয় লাভ,ভয় দেখানো হল আপনাদের। চতুর্থ লাভ, আওয়ামী লীগের লোকেরা যে গুণ্ডা-বদমায়েশ এটা। প্রচার করা গেল। পঞ্চম লাভ, খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করা হল।
শিক্ষকতা করলে মানুষের দৃষ্টিশক্তির একটা দিক অসাড় মেরে গিয়ে মানুষ। বোধ হয় কিছুটা বোকা হয়ে যায়। সুদীপ্ত সেই বোকামীর পরিচয় দিলেন। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন–
খাদ্যের অভাব সৃষ্টি করলে তো সরকারেরই অসুবিধা। সে কাজ তারা করবে কেন?
এই জন্য করবে যে, ওই সরকার এখন আর আপনাদের সরকার নয়। আপনাদেরকে গায়ের জোরে পদানত রাখা ছাড়া সরকারের গত্যন্তর নেই। অতএব খাদ্যাভাব সৃষ্টি করতে পারলে সরকারের এখন ভাল হবে দুদিক। থেকে। কল্পনা করতে পারেন সেই দুটো দিক কি কি?
না, আপনি বলুন।
প্রথমতঃ খাদ্যাভাবে আপনারা দুর্বল হয়ে পড়বেন। তখন আর লড়াইয়ের ক্ষমতা থাকবে না। আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবেন। দ্বিতীয়তঃ যে সকল খাদ্য এখন তারা লুট করে নিয়ে রেখে দিচ্ছে, পরে তা থেকে কিছু কিছু আপনাদের ক্ষুধার মুখে তারা তুলে দেবে। এইভাবে তারা আপনাদের উপকার করবে। আপনারা উপকৃত হবেন। এবং উপকৃত ব্যক্তির মানসিকতা লাভ করবেন।
অর্থাৎ কৃতজ্ঞ থাকব ওদের কাছে।
ঠিক তাই। দেখছেন না, যে অবস্থা ওরা সৃষ্টি করেছে তাতে আমাদের সামনে পথ এখন দুটি হয় বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হবে, না হয় ওদের দান হাত পেতে নিয়ে অসম্মানের জীবনে আধমরা হয়ে বাঁচতে হবে।
জামাল সাহেবের যুক্তি, সুদীপ্তর মনে হল, অকাট্য ও অভ্রান্ত। একটু ভেবে বললেন
কিন্তু যে ঘৃণা ওরা আমাদের মনে সৃষ্টি করল কোনো দিন তা কি আর প্রীতিতে রূপান্তরিত হবে?
হল না হল বয়েই গেল। শুধু চাই মদ-মাগী ও হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা। সেজন্য পূর্ব-বাংলাকে শোষণ অব্যাহত রাখতে হবে। প্রীতি চাইলে শোষণ চলে না-এটুকু বুদ্ধি ওদের আছে।
তা আছে। এবং এই বুদ্ধির তারিফ করতে হয় বৈ কি। প্রীতি-ভালোবাসা সম্পর্ক স্থাপন করতে গেলেই সামনে মর্যাদার প্রশ্ন উঠে। অতএব ওইসব ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না? হরিণকে যেখানে হত্যা করে মাংস খেতে হবে সেখানে কি প্রতিমন্ত্র আওড়ালে চলে? সেখানে চাই রাইফেল।
সেই রাইফেল নিয়ে ওরা পূর্ব বাংলায় নেমেছে সেই ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দেই। নেমেছে মৃগ-শিকারে-স্বর্ণমৃগ। কিন্তু স্বর্ণমৃগের সন্ধানে বেরুলে গৃহলক্ষ্মী সীতাকে হারাতে হয় না। কিন্তু সীতা থাকলে তো তাকে হারাতে হবে। সীতা থাকেন সুসভ্য মানুষ রামচন্দ্রের ঘরে। কোনো অসভ্য বা অর্ধ-সভোর ঘরে। সীতা থাকবেন কী করে এবং কোনো অর্ধ-সভ্য জোর করে সীতা হরণ করতে গেলে তার পরিণতি কি হয়?—
–আপনারা স্বাধীন বাংলা বেতারের খবর শুনছেন……
স্বাধীন বাংলা সচকিত হলেন সুদীপ্ত। বুলা কখন ট্রানজিস্টর নিয়ে উপস্থিত। হয়েছেন। সেই ট্রানজিস্টরে স্বাধীন বাংলার বাণী বেজে উঠল। মা ভৈঃ। আর ভয় নেই। স্বাধীন বাংলার বাণী এখন বাংলার আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ট্রানজিস্টরে কান পাতলেই তা শোনা যাবে।