তখন আল্লাহ তাঁর উপর কৃপা করলেন। হঠাৎ একদিন আইয়ুব খানের। কাছে ডাক পড়ল মালেক সাহেবের। খান সাহেব মালেক সাহেবকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন–
আমি অযথা কাউকে দুঃখ দেব না। আপনাদের আগেকার সকল গুনা মাফ করে দেওয়া হল। এখন আমি চাই যে, আপনারা সকলে জাতি-গঠনের কাজে আমার হাত শক্ত করুন।
জাতি গঠনের মহান দায়িত্বের কথাগুলি আইয়ুব খান সাহেব সামনে। রাখলেন। পেছনে রইল রাইফেল। চোখ বন্ধ করে যারা সেই মহান দায়িত্ব পালনে পা বাড়াল সেই রাইফেল কখনো তারা দেখতে পায় নি। তারা। ভাগ্যবান। কিন্তু অনেক হতভাগা একটু ইতস্তত করেছিলেন, এবং অনেকেই তারা সিধে হয়েছিলেন দু-একটা রাইফেলের গুতো খেয়ে। অনেকে তাও হন নি। তাঁদের মধ্যে ছিল দেশদ্রোহিতার শিরোপা।
বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও রাজনীতিকদের একটা তালিকা তৈরি করে তাঁদেরকে তিনটে ভাগে বিভক্ত করেছিলেন খান সাহেব।—এক দল সাদা, এক দল কালো এবং এক দল হলুদ। এই ভাগ কিন্তু অত্যন্ত নিরপেক্ষভাবেই করা। হয়েছিল। এবং সাদা তালিকার নিষ্পাপ বোকা ভালো মানুষগুলিকে অত্যন্ত সম্মান দিয়ে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। অত ভালো মানুষ দিয়ে দেশের কাজ হয় না। তবে তোমাদের কিছু বলাও হবে না। হাজার হলেও তোমরা বোকা। ভালো মানুষ। হলুদ তালিকায় ছিলেন দুই ধরণের মানুষ—এক, নিষ্পাপ বটে, তবে বোকা নয়, এবং সঙ্কল্প সাধনে অত্যন্ত দৃঢ়চেতা। দুই, অল্প পরিমাণে দাগধরা। শয়তানীতে নেমেও বিবেকটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা যাঁদের আছে। এই হলুদ তালিকার মানুষগুলি ছিলেন আইয়ুব খানের কাছে অত্যন্ত ডেনজারাস, ভয়াবহরূপে বিপজ্জনক। এদের হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে খান সাহেব মাঠে নেমেছিলেন। তাঁর সহায়ক হয়েছিলেন। কালো তালিকার মানুষগুলি। কালো তালিকায় ছিল খুব বাছা বাছা নামগুলি— পাকা চরিত্রহীন, পাকা শয়তান, পাকা বদমায়েশ, কিন্তু সেই সঙ্গে অতি ধুরন্ধর ও প্রচন্ড রকমের বুদ্ধিমান। ভাগ্যক্রমে এই কালো তালিকায় মালেক সাহেব পড়েছিলেন। খান সাহেবের দরকার ছিল বুদ্ধিমান চরিত্রহীন মানুষ। ওদের দিয়েই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হওয়া সম্ভব। তাই ওদের কাছেই নিজেকে ব্যক্ত করলেন খান সাহেব—দেখ হে, তোমাদের সর্বপ্রকার অতীত দুষ্কর্মের তালিকা আমার হাতে আছে। আমি তা ঠিক মতো রেখেই দেব। কিছু বলব না তোমাদের। কিন্তু তার বিনিময়ে আমি যতো দুষ্কর্ম করব সে সবের সাফাই তোমাদের গাইতে হবে। নেশান বিল্ডিংয়ের (জাতিগঠনের) কনট্রাকটরি তোমাদের দেব। তা থেকে তোমরা করে খেতে পারবে কিন্তু সাবধান, বেঈমানী করার চেষ্টা করো না। মনে রেখো, আমি পাঠান। পাঠান কখনো বেঈমানী সহ্য করে না।
মালেক সাহেব শুনেই সঙ্গে সঙ্গে হাত জোড় করেছিলেন–
তওবা তওবা কী যে বলেন স্যার। যা বলবেন তাই করব স্যার।
তোমরা বাঙালিরা তো সব হিন্দুদের গোলাম ছিলে। ছিলে না?
হাঁ স্যার। ঠিক স্যার। ছিলাম বৈ কি স্যার।
অত স্যার স্যার করবে না। শোনো। গোলাম তোমরা যেকালে ছিলে, সেকালে ছিলে এখন তোমরা আজাদ। এই আজাদী তোমাদের জন্যে কে এনেছে বলতে পার? এই আমি–আয়ুব খান।
নিজের বুকে বুড়ো আঙুলের টোকা মেরে দেখিয়েছিলেন খান সাহেব। আর অমন যে চালু মাল মিঃ আব্দুল মালেক তিনিও খান সাহেবের কথা শুনে। কিঞ্চিৎ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ধারণা, আমাদের আজাদী কায়েদে আজমের অবদান। সে কথা ভুলে গিয়ে বলতে হবে তা এনেছেন এই পাঠান পান। সাহেব? মিঃ মালেককে চুপ থাকতে দেখে খান সাহেব বলে চললেন—
আমি তোমাদের আজাদী এনে দিয়েছি, আমি তোমাদের মুক্তিদাতা। কিন্তু মুক্তি দিলেই তা কি সকলে নিতে পারে? বল, পারে?
না হুজুর। বহু কাল খাঁচার ভেতরে থাকার পর পাখিকে ছেড়ে দিলে সে উড়তে পারে না।
ঠিক। তোমাদের বাঙালিদের অবস্থা হয়েছে খাঁচার পাখির মতো। দীর্ঘকাল হিন্দুয়ানীর খাঁচায় তোমরা পোষা ছিলে। এখন ছাড়া পেলেও তাই উড়তে পারছ না। মানে, হিন্দুয়ানী ত্যাগ করতে পারছ না। তোমাকে এই কাজের ভার আমি দিতে চাই বুঝতে পারছ?।
মালেক সাহেব বুঝতে চেষ্টা করলেন। খান সাহেব বলে চললেন—
আমি একটা সংস্থা গড়ব মনে করছি। কী নাম দেব বলতে পার?
হুজুর তার কাছে সাজেশন চেয়েছেন, আহা কী সৌভাগ্য! গৌরবে ও গর্বে মালেক সাহেব স্ফীত হয়ে উঠলেন। একটু মাথা নত করে ভেবে বললেন
ন্যাশনাল ইনটিটিউট ফর দি প্রটেকশান অফ দি বেঙ্গলিজ ফ্রম দি কাফিরস।
রাসকেল।
খান সাহেব রাগে ফেটে পড়লেন। আর একটু হলে লাথিই মেরে বসতেন। বুট সুদ্ধ পাটা লাফিয়ে উঠেছিল ফুট খানেক। মালেক সাহেব ভয় পেয়ে গেলেন। কিন্তু না। খান সাহেব আর বেশি কিছু করলেন না। একটুও না ভেবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললেন—
ওটার নাম হবে একাডেমি ফর দি ডেভেলপমেন্ট অফ ন্যাশনাল ইন্টেগ্রিটি আভ মিউচুয়্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। তোমাকে এর ডিরেক্টর করব, বুঝেছ।–আনন্দে হাত কচলাতে কচলাতে মালেক সাহেব তখন গলে জল হবার উপক্রম।
হুজুরের মেহেরবানি।
খান সাহেব অর্থাৎ আয়ুব খান সোফা ছেড়ে উঠে পায়চারি শুরু করলেন। অগত্যা মালেক সাহেবও উঠে দাঁড়ালেন। হুজুর দাঁড়িয়ে থাকলে তিনি বসে থাকেন কী করে? কিন্তু হুজুর বাঁ হাতের একটা ইঙ্গিতে মালেককে বসতে বল লেন। হুজুরকে একটু চিন্তান্বিত দখাচ্ছে। প্রায় পঞ্চাশ সেকেন্ড পর তিনি বল লেন—