কিন্তু সুদীপ্ত যে খোদ জামাল সাহেবেরই পরিচিত ব্যক্তি। সেটা জানা গেল বেশ দেরিতে। ভদ্রলোকদের যখন এ বাড়িতে থাকতেই দিতে হবে তখন একটু বাজিয়েই দেখা যাক। জামাল সাহেব ভেবেছিলেন। কিন্তু এ কী! এ যে সেই ফিরোজের বন্ধু। সেই নির্ভেজাল অধ্যাপকটি যে! কিন্তু অধ্যাপক সাহেব জামালকে চিনলেন না। কারণ পাজামা-চাপকান পরিহিত ও নকল ওফশুশ্রুশোভিত জামাল আহমদকে সুদীপ্ত কেবল কোরাইশী নামেই জানতেন। অবশ্যই কোরাইশী জামাল সাহেবের পৈত্রিক পদবী। কিন্তু নিজে কখনো তিনি নামের পরে কোরাইশী লেখেন না। তবে ছদ্মবেশ নিলে জামাল সাহেব বন্ধুমহলে পারভেজ কোরাইশী হয়ে যান। কিন্তু জামাল সাহেবকে দেখে পারভেজ কোরাইশীকে কল্পনা করা ঝানু গোয়েন্দার পক্ষেও ছিল অতি কঠিন কর্ম। ইচ্ছে করেই জামাল সাহেব সুদীপ্তর কাছে তার পারভেজ কোরাইশী পরিচয়টিকে গোপন রাখলেন। এবং আলাপ শুরু করলেন নীলক্ষেত এলাকার এক ভদ্রলোকের প্রসঙ্গ তুলে। সুদীপ্ত বিস্মিত হলেন—
তাকে চেনেন নাকি। কিন্তু তিনি ভাগ্যবান। আগেই দেশে চলে গেছেন।
তিনি যান নি। তাকে পাঠানো হয়েছিল।
এইরকম একটা অবস্থা যে আসছে সেটা কিছু আগেই জামাল সাহেবরা আঁচ করেছিলেন। সেই জন্য বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচী স্থির করে লোক পাঠানো হচ্ছিল। মনে হচ্ছে, আর-কোন পথ না পেয়ে ওরা এবার গায়ের জোর দিয়ে বাঙালিকে পদানত করতে চাইবে। যদি তাই হয়, তার যথোচিত উত্তর এবার দিতে হবে। জোর যার মুলুক তার? ঠিক আছে, বাঙালির জোরটাই এবার তবে দেখো। বাঙালি গায়ের জোরের চেয়ে মনের মায়া-মমতাগুলোকেই এতোকাল। বেশি মূল্য দিয়ে এসেছে। তার ফলে যদি তাকে মার খেয়েই যেতে হয়। চিরদিন? না। সেটা মেনে নেওয়া যায় না। মার এতোকাল কাউকে দিই নি। বলে কোনো কালেই দেব না। আমরা প্রস্তুত। মরতে প্রস্তুত। মারতে প্রস্তুত।
সুদীপ্ত একটি প্রশ্ন করলেন—
আপনারা যদি বুঝেছিলেন, এমন অবস্থা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে তা হলে সে সম্পর্কে আমাদেরকে পূর্বাহ্নেই কিছুটা আভাস দিলেন না কেন। তা হলে নিরাপদ আশ্রয়ে পালিয়ে বাচতাম।
এই অভিযোগ শুধু আপনার কেন, আমারও। আমরা অবস্থাটা আঁচ করলাম অথচ জনসাধারণকে সে সম্পর্কে হুশিয়ার করে দেবার প্রয়োজন। অনভব করলাম না কেন? কেন জানেন। বহু বর্বরতা বাঙালি দেখেছে, কিন্তু এবারের বর্বরতা সব কিছুকে হার মানায়। আমাদের কল্পনা হার মেনেছিল।
জামাল সাহেবদের কল্পনা ছিল সুসভ্য ভদ্রলোকের কল্পনা। আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য এবং যাদের নিয়ে সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে নামতে হবে কেবল তাদের উপরেই প্রতিপক্ষের সশস্ত্র হামলা প্রত্যাশা করেছিলেন তাঁরা। তারা একটা সাবধান বাণী প্রত্যাশা করেছিলেন। নিশ্চয়ই চরম ব্যবস্থা কিছু নেবার আগে প্রেসিডেন্টের কোনো একটা ঘোষণা প্রচারিত হবে। তাতে নতি স্বীকারের হুমকি থাকবে এবং নতি স্বীকার না করলে তখনই………..। সত্যিই তো, একটুও সতর্ক না করে নিরস্ত্র মানুষকে কোন সশস্ত্র বাহিনী। আক্রমণ করে এমন শুনেছ কখনো?
তা ছাড়াও, জামাল সাহেব বললেন, ওরা যে ঘরে ঘরে ঢুকে মানুষ মারবে,। রাতের আঁধারে এসে ঘুমন্ত পল্লীকে জ্বালিয়ে দেবে এ সব ছিল আমাদের কল্পনারও অতীত। এইসব বীভৎসতার শতকরা একভাগ মাত্র কল্পনা করেই তা থেকে স্বদেশবাসীকে বাঁচাবার জন্য সে রাতে মুজিব ভাই ধরা দিয়েছিলেন।
এখন মনে হচ্ছে, তিনি ধরা না দিলেই ভালো হত।
কিন্তু ঢাকা শহরে এখন জোর গুজব, মুজিব ভাই ধরা দেন নি। অবশ্য গুজবটাকে বিশ্বাস করার কোনো কারণ সুদীপ্তর ছিল না। তিনি বরাবর ছিলেন ফিরোজের সঙ্গে, এখন জামাল সাহেবের সঙ্গে–এরা দুজনেই শেখ মুজিবুর রহমানের কাছের মানুষ। বিশেষ করে জামাল সাহেব মুজিব ভাইয়ের চরিত্রকে ভালো করেই চেনেন। অতএব বিপ্লবের নেতৃত্বদানের জন্য গোপনে শহর ত্যাগ করবেন এটা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। গণতন্ত্রসম্মত রাজনীতিটুকুই তার জানা। এবংএখন যখন সেই গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে তখন পরবর্তী দায়িত্ব এসে চেপেছে আমাদের উপরে। জামাল সাহেবের চিন্তায় কোন জটিলতা নেই। এবং জামাল সাহেবেরও ধারণা–মুজিব ভাই ধরা না দিলেই ভালো করতেন।
তিনি যে ভেবেছিলেন, তাঁকে পেলে ওরা আর সাধারণ মানুষকে মারবে না, সেটা এই দুদিনেই মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়ে গেছে। তা ছাড়া তিনি আজ বাইরে থাকলে আমাদের কাজ কতো সহজ হত।
কিন্তু ভবিষ্যতে প্রমাণিত হবে, তার রাজনৈতিক দর্শন অনুসারে তিনি ধরা। দিয়েই সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমানের কাজ করেছেন-বলে উঠলেন বুলা।
তাই তো বুলা এসে দাঁড়িয়েছেন। দুজনের কেউ তারা টের পান নি। সেই থে খানিক আগে জামাল সাহেবকে সঙ্গে এনে সুদীপ্তর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন সেই অবধি ঘরে তারা দুজনেই ছিলেন। বুলা যাবার সময় আমিনা ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে করে ভেতরে নিয়েছিলেন।
আসুন দিদি, আপনাদের শোবার ব্যবস্থা করে দিই গে।
এই সন্ধ্যাবেলায়? বিস্মিত হয়েছিলেন আমিনা। কিন্তু অনেকক্ষণ এই অন্ধকূপের মতো ঘরে কাটিয়ে তিনি এতোই অস্থির ছিলেন যে, অন্যত্র যাবার প্রস্তাবে তিলমাত্র প্রশ্নও তোলেন নি। বুলাকে অনুসরণ করেছিলেন। কিন্তু সুদীপ্তকে এই ঘরে ফেলে যাওয়াটা স্বার্থপরতা নয়? না, ঠিক এই প্রশ্নটাই বেলার মনে ছিল না। তবু এই ধরনের একটা অনুভূতি তার শিশুচিত্তে ছিল। সে বলে উঠেছিল