সারা বিশ্বে জাতীয়তাবাদ যখন মুমূর্ষ দশায় উপনীত, আমরা তখন তারই চর্চা শুরু করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। চরম লাঞ্ছনা ও দারিদ্র্য হবে দেশের মানুষের ভাগ্যলিপি।
কিন্তু দেশটা আগে তো আমাদের হোক, তারপর এ সব তর্ক ওঠাবেন। এখন যখন দেশের এক বিপুল জনগোষ্ঠী কেবলই ধর্মের নামে পশ্চিমাদের ঔপনিবেশিক শাসনকে স্বাগত জানাচ্ছে তখন চিত্তের মোহমুক্তির জন্য জাতীয়তাবাদই হচ্ছে একমাত্র দাওয়াই।
–এই ধরনের বিতর্ক জামাল আহমেদের সঙ্গে বুলাদির অনেক হয়েছে। কিন্তু সে সব অন্য দিনের কথা। নানা মতবাদ দেশের মধ্যে থাকবেই–একে অন্যের মতবাদ সম্পর্কে সহিষ্ণু হবে। এবং জনগণের সমর্থন যেদিকে যাবে, সেই পক্ষই আখেরে জয়ী হবে। কিন্তু এও তো গণতন্ত্রেরই কথা আর গণতন্ত্র ছাড়া শেষাবধি মানুষের পথই বা কই? একটা আছে লাঠির যুক্তি। সভ্যতার দাবি উপেক্ষা করে একটা পক্ষ যখনই স্বেচ্ছাচারী হল অন্য পক্ষের তখনই লাঠি ধরা ছাড়া পথ থাকে না। আজ বাঙালির সেই লাঠি ধরার দিন এসে গেছে। এইখানেই বুলাদি ও জামাল সাহেব এক।
পাঁচশে মার্চের পর বাংলাদেশের দল এখন দুটো–এক, সর্বপ্রকার অসম্মান শিরোধার্য করে এখনো যারা পাকিস্তানের মোহকে চিত্তে পুষে রেখে পাঞ্জাবীদের সঙ্গে মিলে মিশে থাকতে চায়। দুই, বাংলাদেশকে পুরোপুরি স্বাধীন দেখতে চায় যারা। জামাল সাহেব ও বুলাদি দুজনেই একমত যে—
বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা যারা একমত তাদের এখন সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়া দরকার। মতাদর্শের পার্থক্য যা আছে সে নিয়ে বোঝাপড়া হবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর।
তাই বুলাদি এখন জামাল সাহেবের সহায়ক।
বুলাদি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একজন অসাধারণ কর্মী। ঢাকা শহরের অনেকেই তাকে চেনে না আবার যারা চেনার তারা ঠিকই চেনে। বাইরে তিনি একজন নিরপরাধিনী শিক্ষয়িত্রী, অত্যন্ত সংযত শোভন ব্যবহার,কারো সাতে-পাঁচে নেই। বোরখা পরে বাইরে বের হন, বাইরে তিনি জামাতে ইসলামের সমর্থক। মেয়েদের মধ্যে জামাতে ইসলামের পুস্তিকা ইত্যাদি বিতরণের জন্য রাশি রাশি বান্ডিল আসে তার কাছে। তিনি সেগুলো আগুনে পড়িয়ে বুড়ো মায়ের জন্য দুধ গরম করেন। সরকারী মহলের কোনো সন্দেহ। এর বাড়ির ত্রিসীমানাও ঘেঁষে না। এবং সেই সুবিধাটুকুর পুরো সদ্ব্যবহার করেন। পাকিস্তান সরকারের সন্দেহভাজন বাঙালি দেশকর্মীগণ। জামাল সাহেব গতকাল থেকে সে সুবিধাটুকু না পেলে অনেকখানি বেকায়দায় পড়তেন বৈকি। কাল থেকে তিনি পুলিশ-ই.পি.আর ও ছাত্রদের যতো জনকে পেয়েছেন ঢাকা। শহরের বিভিন্ন বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন, এবং সুযোগ বুঝে পার করে দিচ্ছেন। মফঃস্বলের বিভিন্ন এলাকায়। সেখানে এদের নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করতে হবে। হাঁ, সরাসরি যুদ্ধই করতে হবে। যুদ্ধের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা। যখন তারা বোঝে না তখন আর উপায় কী?
সুদীপ্তরা আসার মাত্র দশ মিনিট আগে জামাল সাহেব এসেছেন এ। বাড়িতে। তার আগেই একজন দুজন করে তেইশ জনকে পাঠিয়েছেন। সে। এক অদ্ভুত কৌশল। একটা কোড নম্বর শিখিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই নম্বর বললে জায়গা মেলে বাড়িতে। কিন্তু সুদীপ্তরা তো কোন কোড নম্বর নিয়ে আসেননি। তদুপরি এসেছেন জামাল সাহেবের আগমনের প্রায় পরে পরেই। কে জানে জামাল সাহেবের পেছনে পেছনে কোনো গুপ্তচর এল কিনা! কিন্তু সঙ্গে স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে। এইভাবে কোনো গুপ্তচর আসে নাকি! কি জানি বাবা, দেশের যা অবস্থা। কিছুই তো বলা যায় না। বিশেষ করে জামাল সাহেব এই তো এলেন।–এইসব ভাবনা থেকেই তো বাইরের এই অন্ধকূপে বসিয়ে রাখা হয়েছে সস্ত্রীক সুদীপ্তকে।
কিন্তু বুলার মনে সন্দেহ বিশেষ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের তো বহু জনেরই চেনার কথা। নিজেকে সেই অধ্যাপক বলে পরিচয় দিতে যাবে এমন গবেট হলে গোয়েন্দাগিরি করা যায় না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্র ছিল ওই বাড়িতে আড়ালে থেকে সুদীপ্তকে তারা দেখল। এবং চিনতে পারল না। তা হলে? তা হলেও বুলা তাদেরকে সন্দেহ করলেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিও তো এককালে পড়েছেন। পড়তেন পদার্থবিদ্যা নিয়ে। কিন্তু কলাবিভাগের কজন শিক্ষককে তিনি চিনতেন। ছাত্র দুজনের ও একজন ভূগোলে, একজন রসায়নে। ইংরেজির অধ্যাপককে না চেনা তো খুবই সম্ভব। তার যুক্তি কেউ অস্বীকার করতে পারল না। কিন্তু অস্বীকার না করলেও তো। কথা থাকে। এতোগুলো যে লোক এখানে আছে তাদের সম্পর্কে সরকারি মনোভাবটা কি? এরা সবাই সরকারি দৃষ্টিতে প্রচণ্ড দেশদ্রোহী না? পেলে সকলকে সার করে দাঁড়িয়ে দিয়ে গুলি করে মারবে। তাই এদের সম্পর্কে। একটু অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে বৈ কি। সহসা এদের মধ্যে কোনো অচেনা ভদ্রলোককে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে কি?
তা বটে। তবু কি কারফিউ-এর সময় কাউকে পথে বের করে দেওয়া যায়? বিশেষ করে পাশের বাড়ির জমিলা খালাদের জামাই। কথাটা সত্য হওয়া। খুবই সম্ভব। তার এক বোনের জামাই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করেন-জমিলা। খালা প্রায়ই বলতেন। তবে পরিচয় হয়নি। তার কারণ যে তিন মাস হল। বুলারা এ বাড়িতে এসেছেন সেই তিন মাসের মধ্যে আমিনা মাত্র দুবার এসেছিলেন তার খালার বাড়ি। এবং একবার ছিলেন মাত্র ঘণ্টা খানেক, সেবার। খালাদের নতুন প্রতিবেশীর সাথে আলাপের সময় ছিল না। দ্বিতীয়বার স্বামী সন্তানসহ একটা পুরো দিন আমিনা এখানে কাটিয়ে গেছেন। কিন্তু সেদিন আবার বুলারা গিয়েছিলেন মানিকগঞ্জে দেশের বাড়িতে। অতএব তারা বুলাদের অপরিচিতই থেকে গেছেন। না।