আচ্ছা দিদি, আপনারা এখন বসুন। আমি খানিক পরে আসছি।
এরপর এমনি বসে না থেকে উপায়? বসেই আছেন তারা। কিন্তু ছেলেমেয়েরা ইতিমধ্যেই অবস্থাটাকে যেন সহজ করে নিয়েছে। আর পকেট থেকে রুমাল নিয়ে তিনজনে কী-একটা খেলা শুরু করে দিয়েছে তারা।
কিন্তু বুলার ব্যাপারটা কি? এমনি করে বসিয়ে রাখবে নাকি! বাড়িতে এক জায়গা না দাও সেটা বুঝি। জায়গা দেবার পর এমনি ঠাই বসিয়ে রাখাটা কি। ধরনের কাণ্ড! রসিকতা?
হাঁ রসিকতাই। তবু রসিকতাও নয়। এখন কি রসিকতার সময় অন্য। সময় হলে রসিকতা করা যেত। পাশের বাড়ির মাসিমার জামাইকে শ্ৰীমতী। বুলা কি ছেড়ে কথা কইতেন? ভগিনীপতি হওয়ার ঠেলা টের পাইয়ে দিতেন পদে পদে। জমিলা খালাকে বুলাও তো খালা ডাকেন। অতএব আমিনা তো সম্পর্কে দিদিই হবেন। অতএব সুদীপ্ত! বুনার রাজ্যে তোমার দশাটা কি হতে পারত ভেবে দেখ। কিন্তু সেই দশা সৃষ্টির সময় বুলার কোথায়?
দু দণ্ড কথা বলার সময়ও বুলার ছিল না। দেশের এই দুঃসময়ে এখন কি একটি মুহূর্তও বাজে কাজে ব্যয় করার সময় আছে? অবশ্যই সময় ও কথার বাজে খরচকে পুরোমাত্রায় পাপ মনে করার মতো পিউরিটান বুলা নন। মাকস্বাদ-লেনিনবাদে দীক্ষা নেয়ার পরও এখনও তাই গল্প-কবিতার বই পড়ার এবং আড্ডা দেওয়ার জন্য সময়ের অভাব তার হয় না। কিন্তু সে কথা শান্তির সময়ে চলে। এখন জরুরি অবস্থায় সব কথা অচল। এখন শুধু ঐ কথাটা সত্যি–ঐ যে মোক্ষম কথাটা বুলা শুনিয়েছেন-আমরা কেউ এখন। নিজের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর চলছি নে। অবস্থা আমাদের চালাচ্ছে। তবু অবস্থাকে আয়ত্তে আনার জন্যই তো চলছে যতো দুর্মর সাধনা। তাই সময়। নেই। কিংকর্তব্যবিমুঢ়তা কাটিয়ে এখনি তো রুখে দাঁড়ানোর সময়। কিন্তু বুলার কোনো পরিচয়ই যে সুদীপ্তর জানা নেই।
সাতটা বাজতেই বুলা ভাত-তরকারি নিয়ে হাজির হলেন। স্নেহমমতাময়ী একজন বঙ্গ ললনা।–
অধ্যাপক সাহেবকে একটু কষ্ট করতে হবে। এই অসময়ে চারটে খেয়ে নিতে হবে।
খেয়ে নিতে আর কষ্ট কি? আনন্দের সাথেই খাব।
আনন্দ আপনার কাছে খুব সস্তা মনে হচ্ছে। আমি কিন্তু সত্যিই আপনাদের কষ্ট দিয়ে খাওয়াব। এই দেখুন, তরকারি কিছু নেই।
তবু খেতে কোনো কষ্ট হল না সুদীপ্তর। ডাল আর সামান্য বেগুনের সাথে মাগুর মাছের একটা টুকরো। কিন্তু টুকরো এত ছোট করা সম্ভব? আঙুল কেটে যায়নি? না কাটেনি। তবে কাটতে পারতো। এবং কাটলেও কিছু করার ছিল না। বুলার তো দোষ নেই। সেই পঁচিশ তারিখের সকালে কেনা হয়েছিল দশটা মাগুর। আজকে আটাশ না, বেশিদিন হয়নি। এবং মাগুরগুলো বেশ বড়ো সাইজেরই ছিল। কিন্তু কাল থেকে খাচ্ছে কতো লোক? সুদীপ্ত সেটা জানেন না। বাইরে যে ঘরটাতে তারা আছেন, সেখানে থেকে এ বাড়িতে মানুষের সংখ্যাটিকে নির্ণয় করা যাবে না। কোনো শব্দ নেই। অথচ বাটির অভ্যন্তরে এখন বাস করছেন তেত্রিশ জন। গতকাল এসেছিলেন আঠারো জন। তার মধ্যে বারো জন আজ চলে গেছেন। এবং এসেছেন তার দ্বিগুণ, চব্বিশ জন আর বুলারা তিনজন। তার উপরে সুদীপ্তরা পাঁচজন। এই সুদীপ্তদের নিয়েই যতো সমস্যা হয়েছে বুলার। সমস্যা হয়েছে বাচ্চা তিনটিকে নিয়ে। তাদের জন্য দুধ চাই। তা গুঁড়ো দুধের টিন প্রায় ভরতিই আছে। কিন্তু চিনি আছে অতি সামান্য। দুবেলা কম করে হলেও অমন তিরিশ-চল্লিশ কাপ চা। হচ্ছে। তাতে কতো চিনি লাগে? বাচ্চাদের চিনি না হলে চলে? তাছাড়া, অমন, দুধের ছেলেরা—দুধের সঙ্গে পাকা কলা দিতে না পারলে বড়োদের কখনো তৃপ্তি হয়? ছেলে-মেয়েদের সামনে শুধু দুধ এনে ধরতে বুলার খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এলা তাঁকে বাঁচিয়েছে। এলা ভাত খেতে চেয়েছে। বুলা শুনেছেন–এলা যেন বলেছে, অত কি দরকার মাসি। শুধু ডাল-ভাত দাও না। আমরা ডাল-ভাত খেয়ে থাকব।
১৯. কোনো মতে ডাল-ভাত খেয়ে
কোনো মতে ডাল-ভাত খেয়ে এখন বাঁচলে হয়! এবং বাঁচতে হবেই। আর বাঁচতে হলে মরতেও হবে। মরতে শেখে নি যারা, তারা বাঁচতেও শেখেনি।
বাঙালিরা এখন মরতে শিখেছে, অতএব তাকে মেরে নিঃশেষ করে দেবার ক্ষমতা এখন পৃথবীতে কারো নেই। জানবে, মৃত্যুকে ভয় করে যারা মৃত্যুকে এড়াতে চায় তারাই মরে।
দলপতি তার দলের ছেলেদেরকে বুঝাচ্ছিলেন কথাগুলি। সকলেই জোয়ান ছেলে। কেউ ছাত্র, কেউ পুলিশ, কেউ ই.পি. আর-এর লোক। পঁচিশে মার্চের ভয়াবহ রাত্রির নারকীয় কাণ্ডের মধ্যে কোনো মতে যারা পালিয়ে বেঁচেছে এরা তাদের মধ্যে। না, এরা বুলাদিকে চেনে না। বুলাদির কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে এদের। যোগ বিশেষ ছিল না। বুলা যে একটি গোপন বিপ্লবী সংস্থার সদস্য সে কথা জানেন এক দলপতি জামাল আহমেদ স্বয়ং। আর কেউ না। অবশ্যই জামাল আহমেদের রাজনৈতিক মত বুলাদির নয়–একজন ন্যাশনালিষ্ট হলে অন্য জন কমিনিষ্ট। জামাল সাহেব আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত। বুলাদির যোগ পূর্ব বাংলার বেআইনী গোপন কুমিনিষ্ট পার্টির সঙ্গে। বিপ্লবে বিশ্বাসী জামাল সাহেবও এককালে কৃমিনিষ্টদের সঙ্গে অনেক উঠাবসা করেছেন–কমিনিষ্ট পার্টির কাজও করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসে যুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগের। সঙ্গে।
জাতীয়তাবাদের চর্চা দেশে কিছুদিন চলতেই হবে, তারপর আপনিই সমাজতন্ত্রবাদের চাকা ঘুরতে শুরু করবে।
জামাল সাহেবের এ মতের বিরোধিতা করে বুলা যুক্তি দেন–