এ সবের মধ্যে কিছু আবার আবিষ্কার করতে যাবেন না যেন। ছোট ছেলেদের যেমন কোনো জাত নেই, তেমনি তাদের বিশেষ কোনো ঘরও নেই। ক্ষিধে পেলেই তাদের খাবার অধিকার আছে। তা সে যে ঘরেই হোক।
ক্ষিধের সময় ও থিওরিতে আমরাও বিশ্বাসী–আমিনা বললেন।
সেই জন্যই আপনাদেরকে মেরে ফেলা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এই সব কথা আপনারা দেশের যুবকদের মধ্যে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন। দেশের সর্বনাশ। ডেকে আনছেন আপনারা।
এবার সুদীপ্ত বললেন–
কিন্তু আপনি তো বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকেও কথা কম জানেন না দেখছি।
।
আপনাদের কাছেই শেখা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এককালে পড়েছি তো।
এককালে? মানে, কোন কালে? কোন সাবজেক্টে? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে। নাকি?–প্রশ্ন সুদীপ্তর মনে একরাশ থাকলেও কোনোটাই তিনি তুললেন না। কোনোটারই উত্তর চাইলেন না। তিনি চুপচাপ দেখে গেলেন বুলা ও আমিনা আলাপ করতে করতে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছেন।
যতোটা পার, শুধু দুধ খেয়ে থাকতে হবে বাছারা! তোমাদের খালার ঘরে আর কিছু নেই।
ভাত?–এলা প্রশ্ন করে বসল।
প্রবল দুঃখের মধ্যেও একটু হাসতে হল সকলকে। এবং সুদীপ্ত শুধুই একটু হাসলেন। আমিনা বললেন—
দেখলেন, ইংরেজির অধ্যাপকের মেয়ে হলে হবেকি! একেবারে খাঁটি বাঙালি। খালা হতে চান, ডাল ভাত খাওয়ান।
বুলা এই সময় মুখের কাছে আঙুল এনে যেন আমিনাকে সাবধান করে। দিলেন।–
দিদি আস্তে। কথা যেন বাইরে শোনা না যায়।
সুদীপ্ত যেন অনেক দূরে থেকে মহিলা দুজনকে দেখছিলেন। শাশ্বত বঙ্গজননী। একজন খাওয়াচ্ছেন এলাকে, একজন বেলাকে। অনন্ত নিজেই খাচ্ছে। কিন্তু বসেছে বুলার কাছে। বুলাই তাকে কাছে বসিয়েছেন।
নাহ, বাঙালি মরবে না। এতো প্রীতি মমতার মৃত্যু হয় না।
কিন্তু শুধুই তুমি প্রীতি-মমতা দেখলে? ঈর্ষা-কলহ দেখনি? আর প্রকাণ্ড পরশ্রীকাতরতা?
হাঁ, তাও তো ঠিক ঈর্ষা-কলহ–বিশেষ করে পরশ্রীকাতরতা এবং ক্ষুদ্রতা–সুদীপ্তকে কে যেন কানে ধরে কেবলি বাঙালি-চরিত্রের দীনতা ও তুচ্ছতাগুলিকে দেখিয়ে নিয়ে বেড়াল অনেকক্ষণ! ততক্ষণে বুলা চলে গেছেন। কিন্তু অতীতের দীনতাসঙ্কুল ঈর্ষাকুটিল গলিপথ পরিক্রমণ যেন সুদীপ্তর ফুরোচ্ছে না।
কিন্তু তিনি কি বুলার প্রতি অবিচার করছেন না! বুলাকে কেন্দ্র করে তোমার মনে একই ধরনের চিন্তার উদয় হওয়া অন্যায় সুদীপ্ত। খুবই অন্যায়। অন্যায় বৈ কি। গতকাল থেকে বাঙালি বাঙালিকে কম সাহায্য করেছে! ফিরোজের চাচারা সংখ্যায় কজন? বোধ হয়, শতকরা একজন হতে পারে। এবং তারা হয়ত দুর্ভাগ্যক্রমে ওই একের কবলেই পড়েছিলেন। তার জন্য সমগ্র জাতিকে অপবাদ সইতে হবে?
এক মীরজাফরের জন্য সমগ্র বাঙালীকে যুগে যুগে অপবাদ সইতে হচ্ছে না?
ননসেন্স। মীরজাফর আবার বাঙালি কবে ছিলেন? ওই যে, মীরপুর-মোহাম্মদপুরে অবাঙালিরা আছে না! ওরা তো প্রায় পাইকারী হারে আজ পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে হাত মিলিয়ে বাংলার দুর্দশা ঘটাচ্ছে। সেজন্য ইতিহাসের কাঠগড়ায় আসামী হতে হবে বাঙালি জাতিকে? না, তা হবে কেন। এবং এও ঠিক যে, ওই জন্য সকল অবাঙালিকেই বেঈমান বিশ্বাসঘাতক বলারও কোনো যুক্তি নেই। তার মাও তো অবাঙালি ছিলেন। আহ, ভারত ছেড়ে আসার ছমাসের মধ্যেই তিনি জান্নাতবাসিনী হলেন। ঐ শোকটা সুদীপ্তর ভুলতে অনেক সময় লেগেছিল। সুফিয়ার শোক ভুলতে না পেরে মা সব সময় কেমন যেন হয়ে থাকতেন। সেই শোকেই তো মারা পড়লেন এত তাড়াতাড়ি। বড়ো ভাই বদলি হয়ে গেছেন রাজশাহীতে। সেখানে কেমন আছেন কে জানে। এখনো তো কোনো খারাপ খবর পাওয়া যায়নি। তবে সবচেয়ে নিরাপদে আছে ছোট ভাই প্রদীপ্ত হাসান। প্রদীপ্ত ভারত থেকে আসেনি। ভালো করেছে। অথচ এই কদিন আগেও নক্সাল-পন্থীদের খবরে সুদীপ্তর মনে হয়েছিল, প্রদীপ্ত এখানে চলে এলে ওই সব হাঙ্গামা থেকে বাঁচত। কি জানি কখন কি দুর্বিপাকে পড়তে হয়। হিংসার রাজনীতিতে ভারত এখন কলুষিত। এখন ওখান থেকে সরে আসাই তো ভালো। কিন্তু কেন যে প্রদীপ্তটা আসে না? সুদীপ্ত ভাবতেন। ভাবতেন সামান্য কদিন আগেও। কিন্তু এখন? সুদীপ্তর আজ মনে হচ্ছে, নক্সালপন্থীরা পাকিস্তানিদের তুলনায় ফেরেশতা।
বুলা যাওয়ার সময় পূর্ব দিকের জানালাটিও বন্ধ করে দিয়ে গেছেন। অযৌক্তিক কিছু করেন নি। পথের দিকের জানলা খুলে রাখা যায় না। এখন একটি কেবল দক্ষিণের জানালা খোলা। তাতে বাতাসের সমাগম বিশেষ হচ্ছে না। ঘরে সুতীব্র গরম। ছেলেমেয়েদের গরম সহ্য করার অভ্যাস নেই। তারা কষ্ট পাচ্ছে খুব। কিন্তু সেই পরিমাণে জ্বালাচ্ছে না। ছেলেরাও যেন এক রকম করে টের পেয়ে গেছে, এ অবস্থায় কান্নার ফলে ঘোরতর বিপদ হতে পারে।
ক্রমে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। ঠাই বসে থাকতে থাকতেই এল সন্ধ্যা। তাতে অবস্থার পরিবর্তন কেবল এইটুকু হল যে ঘরের স্বল্পশক্তিসম্পন্ন বিজলি বাতির আলো আরো স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ হল। দিনের ভীরুতা কেটে সে যেন রজনীর স্বচ্ছন্দচারিণী নায়িকা হয়ে উঠল। দেয়ালের একটি কালো দাগে দুচোখ নিবন্ধ। করে সুদীপ্ত সেটাকে একটা বাঘের মুখবয়ব দান করতে চেষ্টা করলেন। দুরন্ত বাঘের প্রবল প্রাণকে আর বিপুল অরণ্যকে সেই মুহূর্তে মনে মনে তিনি প্রার্থনা করছিলেন। কিন্তু আমিনার অসুবিধা হচ্ছিল চরম। নিভৃত আত্মসংলাপ, ধ্যান কল্পনা-এ সবের কোনটাতেই অভ্যস্ত নন তিনি। কাজে ও কথায় সময় কাটানো তার অভ্যাস। আর অভ্যাস আছে সামান্য তাস খেলার। এমনি করে বসে থাকা, স্বামীর সম্মুখে হলেও, তাঁর পক্ষে অত্যন্ত কঠিন কর্ম। বুলাও যে আসে না ছাই। তিনি কি ভেতরে যেতে পারেন না। কিন্তু বুলা ডাকলেন না যে। শুধু ডাকলেন না তাই নয়, যাবার সময় মেয়ে বলে গেলেন—