আব্বু কি খাব?
সত্যিই তো, কি খাওয়ানো যায় ছেলেমেয়েদের! সঙ্গে বিস্কুট ও গুঁড়ো দুধের টিন আছে। কিন্তু পানি? বাংলাদেশে পানি চাইলে অবশ্যই পাওয়া যায়। কিন্তু সে চাওয়ার ভার তো আমিনাকে দিতে হয়। আমিনাকে বলবে নাকি ভেতরে থেকে একটু পানি চেয়ে আনতে! না, সে সাহস সুদীপ্তর হল না। নিজের জন্য চাইলে আমিনা কিছু বলবে না। চেষ্টা করে হয়ত জোগাড় করে এনে দেবে। কিন্তু মেয়ের দরকারে উঠতে বললে দেবে ধমক। মেয়েকে এ দুঃসময়ে ধমক। খেতে দেওয়ার চেয়ে একটু সোহাগ দেওয়া উত্তম বৈকি। সুদীপ্ত মেয়েকে সোহাগ দিয়ে ভোলাতে চাইলেন—
একটু কষ্ট করে থাক মা মণি। একটু খানি।
মায়ের কাছে একটা চেয়ারে বসে ছিল অনন্ত। ছেলে মানুষ হলেও এখন কিছু একটা বলা উচিত বলে তার মনে হল
জী ছোট আপা, যেখানে সেখানে খেতে হয় না। আমরা তো খাচ্ছি নে। তোমার বড়ো আপা খাচ্ছে না।
ছোট বোনকে অনন্তর সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিটা অন্য সময় হলে হাসি জাগত—একটু কৌতুকের সঙ্গে মা-বাবা উভয়ে সেটা উপভোগ করতেন। কিন্তু এখন? উভয়েরই মনের গভীরে কোনো জমাট তুষার যেন গলতে শুরু করেছিল। এবং তা অশ্রু হয়ে বেরোতে চাইলে উভয়েই ছেলেমেয়েদের সামনে প্রখর সতর্কতায় তাকে গোপন করলেন।
অনন্ত তার মায়ের কাছে, আব্বার কাছে বেলা। মাঝখানে বেচারা এলাটা কারো সঙ্গ পায় না সে একবার তার মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, একবার বাপের কাছে। বাপের কাছে এলা শুধায়—
এখানে কেন এলে আব্দু! নানীরা কই?
নানী অর্থাৎ আমিনার খালার বাড়ি ইতিপূর্বে একাধিকবার এলা এসেছে। এলা তাই চেনে বাড়িটা। সে বাড়ি বন্ধ থাকলে চল ফিরে যাই। তা না, এখানে কেন?
সুদীপ্ত এক হাতে কোলের বেলাকে জড়িয়ে ছিল। আর-এক হাতে এলাকে কাছে টেনে নিয়ে মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন–
তোমার নানীরা একটু বাইরে গেছেন আম্মু। ফিরে এলেই আমরা তোমার নানীদের বাড়ি যাব, কেমন?
সেটা ছোট্ট একখানি বাইরের বসার ঘর। পুব-দক্ষিণ দুদিকে দুটি জানলা, এবং দুটি দরজা। পশ্চিম দিকের দরজা দিয়ে অন্দরমহলে যাওয়া যায়, পুব দিকেরটা রাস্তায় বেরুবার। উত্তর দেয়াল-সংলগ্ন একটি টেবিল এবং খান চারেক কাঠের চেয়ার। তাতেই ঘরের অর্ধেক জায়গা জুড়ে ফেলেছে। এই ঘরে তাদের রাত্রিবাস করতে হবে? হয়ত হবে। নিশ্চয়ই হবে। সেজন্য মনে শঙ্কা লাগছে নাকি! এর চেয়েও ছোট ঘরে মানুষ বাস করে না? তবে ইতিমধ্যেই তারা যে ঘেমে উঠেছেন। মার্চের শেষ সপ্তাহের গরম, তদুপরি সারা দুপুর প্রায় পথে পথে কেটেছে। ছেলেমেয়েদের মুখগুলো কেমন শুকনো আর করুণ দেখাচ্ছে। সুদীপ্তর বুকের মধ্যে একটি আহা ধ্বনির হাহাকার খেলে গেল। কি যে ভয়াবহ রাত্রি সামনে আসছে! আল্লাহকে ডাকলেন সুদীপ্ত। কিন্তু আমিনা তখনো ভাবছেন, কাল যদি আসতাম! কথা তো শুনবেন না। বন্ধুর বাড়ি যাবেন। কেমন দিব্বি আজ ঢাকার বাইরে গ্রামের খোলামেলা জায়গায় ছেলেমেয়ারা ঘুরে বেড়াত। খালা কি তাকে ফেলে যেতে পারতেন!
আমিনার ধারণায়, জিঞ্জিরাতে গিয়ে খালারা বেঁচে গেছেন। এবং পরম সুখে আছেন। সুখে ছিলেন। কিন্তু ওই একটা দিন। পরদিনই সেখানে। পাকিস্তানিরা তাদের কারবার শুরু করেছিল। সেটা তাদের নীলক্ষেতের চেয়ে কম কিছু ছিল না। কিন্তু তাতে এখন কি। ভবিষ্যতকে তো মানুষ দেখতে পায় না। পেত যদি? অন্ততঃ আমিনা যদি সেই ভবিষ্যতের কিঞ্চিৎ কল্পনাও করতে পারতেন তা হলেও এতোবার জিঞ্জিরার কথা এখন স্মরণ করতেন না। একদিন তো আমিনাকে স্মরণ করতে হয়েছিল–জিঞ্জিরাতে যাওয়া হয়নি যে, সেটা আল্লাহর অপার কৃপা। আল্লাহর কৃপাতেই তারা বেঁচেছেন। তার খালারা কেউ বাঁচেন নি। সারা জিঞ্জিরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুশান হয়ে গিয়েছিল।
এক ঘণ্টা পর প্রায় পাঁচটার দিকে সেই বুলা নামে মহিলাটি আবার এসেছিলেন।
চারটে থেকে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে এ অবস্থায় আপনাদেরকে যেতে বলতেও পারি নে। আবার থাকবেন যে তারও অসুবিধা বিস্তর।
সুদীপ্ত বললেন—
আমাদের অসুবিধা কি বলছেন! আপনাদের যে অসুবিধা সৃষ্টি করেছি সেইটেই ভাবতে লজ্জা পাচ্ছি।
কিন্তু কি আর করবেন! ইচ্ছে করে তো আর করেন নি। তবে কথা কি জানেন, আমরা কেউ এখন নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর চলছিনে। অবস্থান আমাদের চালাচ্ছে।
বাহ ভদ্র মহিলা কথাটা ভারি সুন্দর বলেছেনতো! নিঃসন্দেহে খুব বুদ্ধিমতী মহিলা। বাঁচা গেল। সুদীপ্ত মনে মনে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। মহিলার যে বুদ্ধি আছে এটা তাদের অনুকূলে না গিয়েই পারে না। বিপক্ষে গেলে? এতোক্ষণ এখানে প্রবেশাধিকারই মিলত না।
আমিনা তাঁদের আলোচনায় যোগ না দিয়ে কাজের কথা তুললেন—
বোন, একটু গরম পানি দিতে পারেন। শুধু খানিকটা গরম পানি। সামান্য গরম হলেই চলবে।
কেন?
বাচ্চাদের একটু দুধ খাওয়াতাম।
তা হলে পারি নে।
আমিনা একটু বোকা বনে গেলেন। এবং সুদীপ্তও। এখানে কি যে তারা বলবেন, পুনর্বার গরম জলের অনুরোধ শোভনীয় হবে কি না, কেননা ওটা যে। না হলেই নয়, বাচ্চাদের তো খাওয়াতেই হবে তারা ভাবছিলেন। এমন সময় বুলা বেরিয়ে গেলেন। আমিনা স্বামীর মুখের দিকে তাকালেন। সুদীপ্ত ও তাকিয়েছিলেন স্ত্রীর মুখের দিকে। দুজনেই দুজনকে নীরবে প্রশ্ন করলেন–ব্যাপরটা কি হল?
ব্যাপার কিছুই হয়নি। আধ ঘণ্টা পর বুলা একটা বড়ো কেতুলিতে দুধ আর। রেকাবীতে ডজনখানেক বিস্কুট নিয়ে এলেন।–