চলুন ভাবী, আপনাদের পৌঁছে দিই।
না ভাই, কিছু দরকার নেই। এটুকু আমরা দিব্বি পৌঁছে যেতে পারব। পারলে কাল সকালে একবার খোঁজ নেবেন।
সুদীপ্তদের বড়ো সুটকেশটা হাতে নিয়ে ফিরোজ তাঁদের সাথে পা। বাড়িয়েছিলেন। মীনাক্ষীও বেরিয়ে এসেছিলেন গাড়ি থেকে। বেশ তো, ওঁদের একটু পথ হেঁটে গিয়ে আমরা একেবারে তাঁদের পৌঁছে দিয়ে আসি।
কিন্তু আমিনা এ ব্যবস্থায় কিছুতেই রাজি হলেন না।–
এই তো সামান্য দু পা গিয়ে সাত নম্বর বাড়ি। অকারণে আর কষ্ট করতে দেব না আপনাদের। সুটকেশটা আপনি ওকে দিন।
বলেই অবলিলাক্রমে একটা ব্যাগ তিনি কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন, এবং অন্যটা বা হাতে নিয়ে ডান হাতে এলাকে ধরে পথ চলা শুরু করলেন। অতঃপর স্ত্রীকে অনুসরণ করা ছাড়া গত্যন্তর কি? তার একটা হাত বেলা ধরেই ছিল, অন্য হাতে ফিরোজের কাছ থেকে সুটকেশটা তিনি নিয়ে নিলেন। এবং খুব একটা মলিন হাসি হেসে বিদায় নিলেন বন্ধুর কাছ থেকে। আমিনা বলে। দিলেন–
কাল কিন্তু ভাবীকে নিয়ে আসবেন। এই সামনের সাত নম্বর বাড়ি। আসব।
হয়ত ফিরোজ আসবেন। কিন্তু সে তো সেই আগামী কাল নটার আগে। নয়। তারা এমনি বেকুবের মতো কাজ করেছেন যে, ফিরোজের বাড়ির নম্বরটাও নেন নি। তালা-ঝুলানো লোহার গেটের সামনে স্বামী ও সন্তানদের। নিয়ে আমিনা তখন কি ভাবছিলেন?
না, কিছুই ভাবেন নি। অত ভেবে কাজ করা মেয়েদের অভ্যাস নয়। তিনি সোজাসুজি স্বামীকে বললেন।
এখন কি করবে কর। আমি তো আর ভাবতে পারছি নে।
কেন পারবে না শুনি! সেই দুপুর থেকেই তো খালার বাড়ি খালার বাড়ি করছিলে। ঠেলাটা সামলাও এবার। কিন্তু ঠেলাই যদি সামলাবেন তা হলে আর স্ত্রীলোক হতে গেলেন কেন? এতোক্ষণ তো বেশ প্রবল পরাক্রম দেখানো হচ্ছিল? এখন যে বেকায়দায় পড়েছেন, অমনি অবলা সেজে বসলেন—কি করবে কর, আমি তো আর পারি নে। হাঁ, আমরা সব পারি। পুরুষ যখন হয়েছি। তোমরা দয়া করে কেবলি তালগোল পাকাবে, আর আমরা খুলব। সেই জন্যই তো আছি আমরা।
সুদীপ্ত পাশের বাড়ির দরজায় গিয়ে কড়া নাড়লেন। বেশ কয়েকবার জোরে। জোরে কড়া নাড়ার পর ভেতর থেকে একটা নারীকন্ঠের সাড়া পাওয়া গেল–
কে? কাকে চান?
আপনাদের সাথে আমরা একটু কথা বলতে চাই, আমরা বিপদে পড়েছি। একটু খুলবেন?
আপনারা কারা? বাড়িতে কোন পুরুষ নেই।
তা হলে আপনার কাছেই না হয় দুটো কথা শুধিয়ে নিতাম। একটু যদি খুলতেন!
আপনি কেমন ধারা ভদ্দর লোক! বলছি বাড়িতে পুরুষ নেই।
তাও কপাট খুলতে বলেন! তাও আবার এই কারফিউ আওয়ারে!
না, না দেখুন…মানে আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী আছেন। আমিনার দিকে তাকিয়ে—এই যে, তুমি একটু কথা বল না।
খুব আস্তে বিড় বিড় করে আমিনা বললেন—
আমি কি বলব! তোমারই বুদ্ধির দৌড় একটু দেখা যাক।
কিন্তু স্বামীকে এ কথা তিনি শোনালেও বুঝতে তার কোনোই অসুবিধা। ছিল না যে, এই অবস্থায় তাঁর এখন এগোনো কর্তব্য। সত্যিই তো, কারফিউ আওয়ারে কোন স্ত্রীলোক কোনো পুরুষকে বাড়ির দরজা খুলে দেবে এটা ভাবা যায়? কথাটা শুনতে তো কেমন। আমিনা একটু এগিয়ে বললেন—
আমরা ভাই হঠাৎ বড়ো বিপদে পড়ে গেছি। একটু যদি খুলতেন।
_ একটু খানিই খুলল-কপাট নয় জানলা! জানলার ফাঁক দিয়ে মহিলা আমিনার সাথে কয়েকটি কথা বললেন। আমিনা তার খালার কথা শুধালেন। পাশের বাড়িতে থাকতেন। অতএব কোথায় গেছেন সেটা যদি জানা যেত! কিন্তু জানা গেলেই বা কি লাভ!
তাঁরা তো ভাই বুড়িগঙ্গার ওপারে সেই জিঞ্জিরায় চলে গেছেন।
কালই গেছে নাকি?
না, কাল যেতে পারেন নি। আজ সকালে গেলেন। আমরা কত মানা করলাম। সবাই মিলে আসুন, এক সাথে থাকি। কপালে যা আছে তার তো। আর রদ হবে না। কিন্তু কে শোনে ভাই।
আমরা তা হলে কি মুশকিলে পড়লাম বলুন তো! এখন তো আর। ফিরতেও পারিনে। বাসা থেকে বেরিয়ে কি ভুলটাই করলাম!
কোথায় বাসা ছিল আপনাদের?
আর বলবেন না ভাই। নীলক্ষেতে থাকতাম আমরা। উনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।
কে রে বুলা? বলতে বলতে একজন প্রৌঢ়া এসে দাঁড়িয়েছিলেন ঘরের মধ্যে। বুলা মুখের কাছে আঙুল এনে সঙ্কেতে আমিনাকে চুপ থাকতে বললেন। এবং প্রৌঢ়াকে যা বলার তা নিজেই বললেন। খুব চাপা স্বর। কিছু তার শোনা গেল, কিছু গেল না। অবশেষে বুলা নামক মেয়েটি তঁাদেরকে একটু অপেক্ষা করতে বলে প্রৌঢ়াকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন।
কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন। বুলা নিজেই কপাট খুলে তাদেরকে ভেতরে নিয়ে বসালেন। ঘরে একখানা টেবিল, এবং কয়েকখানা কাঠের চেয়ার ছিল। সেখানে তাঁদের বসতে দিয়ে তিনি বললেন–
একটা কথা। কেউ এসে কড়া নাড়লে খুলে দেবেন না। কিংবা কোন প্রকারের সাড়া দেবেন না যেন।
আমিনা শুধু সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। বুলা আবার যথারীতি ঘরে খিল। তুলে দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। হাঁ, মাত্র এইটুকুর জন্যই এখন খোদার কাছে মনে মনে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন সুদীপ্ত। আমিনা কিন্তু খোদার অবিচারকে স্মরণ করলেন। এতো বিপদের পরও ভাগ্যের এই পরিহাস। কাল কতো করে বললাম, চল খালার ওখানে যাই। কাল এলে তো এই বিপদটা হত না। দিব্যি খালাদের সাথে ওপারে জিঞ্জিরায় চলে যেতাম! কেমন নিরাপদে থাকতাম। কিন্তু নিরাপদ আশ্রয় খোদা আমার কপালে লেখেনি। এখন। কি সারারাত এখানে ছেলে-মেয়ে নিয়ে বসে কাটাতে হবে?
ইতিমধ্যেই বেলা তার আব্বার কাছে আবেদন জানিয়েছে—