ঠিক এই জন্যেই হবে, প্রেস ক্লাবের দেয়ালে যে প্রকাণ্ড গর্ত ছিল তা আর বিশেষ কিছু মনে হল না তাদের কাছে। রাজারবাগ পুলিশের সদর দপ্তর দেখার পর ওটা আর আদৌ আকর্ষণীয় ছিল না। তবু ফিরোজ তাঁর গাড়ির গতি। মন্থর করে এক সময় প্রায় থেমেই গেলেন।
এখানেও কামান দাগতে হয়েছিল নাকি! কেন? এখানে তো ছাত্র ছিল না, পুলিশ ছিল না। তবে?
আবার যুক্তি চাও! এই জন্যই মরেছ তোমরা। যা দেখছ সব মেনে নাও, তবে পেছনে কোনো যুক্তি দেখতে চেয়ো না।
তাই তো। সতর্ক হলেন ফিরোজ। The Peole, সংবাদ, ইত্তেফাঁক-এ সব সংবাদপত্র অফিস যে একেবারে ধুলিসাৎ করে দিয়েছে তার হয়ত কোনো কারণ থাকতেও পারে। কিন্তু প্রেসক্লাব থেকে কোনো পত্রিকা বেরোত নাকি! তা-না বেরুলেও সাংবাদিক তো বেরুত। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁচা ছেলেগুলো। ওইখানে ঢুকে আডডা দিতে দিতে সব এঁচড়ে পাকা হয়ে যেত না! অতএব এটাকে মূল সুদ্ধ উপড়ে ফেলে দাও। দেশের মধ্যে বানু বদমাইশের দল হচ্ছে–শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। নচ্ছারগুলো কেবলি দেশপ্রেম দেখানোতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। কেন? তা হলে এসো বাছাধনরা, দেশপ্রেমের পরীক্ষা দাও। কে কত মরতে পার দেখি। কতো শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক ঢাকা শহরে মরেছেন?
হিসেবটা দিতে পারতেন সাংবাদিকরাই। সেই জন্যই তো সাংবাদিকদের। উপর এতো রাগ। দেখলে না, যতো বিদেশী সাংবাদিক ঢাকায় ছিলেন সকলকে ঝেটিয়ে বের করে দিয়ে তারপর ওরা শুরু করেছে ধংসযজ্ঞ। কিন্তু ঝাট দেবার। সময়ও কিছু তো এড়িয়ে যায়। দু-একজন সাংবাদিকও যদি এড়িয়ে গিয়ে থেকে থাকেন! আল্লাহ, বিদেশের অন্ততঃ একজন সাংবাদিক যেন থাকেন, শহরে। তাতে লাভ কিচ্ছু লাভ নেই। বাইরের লোক একটু শুধু জানবে। কিভাবে আমরা সবাই মরলাম সেইটুকু শুধু জানবে সকলে।
শুধু সকলকে জানানোর জন্যই মাঝে মাঝে ছবি নিতে ইচ্ছে করছে ফিরোজের। এই স্থান ও কাল থেকে কিছু দূরে যারা আছেন, বা থাকবেন। তাদের জন্য এর কিছু ছবি তো নিয়ে রাখতেই হয়। তা নইলে তারা আমাকে। ক্ষমা করবেন কেন? ইতিহাস তথ্যপঞ্জী দেবে। কিন্তু কিছু দেখতে পারবে তো। দেখাতে জানে সাহিত্য এবং ছবিও। ফিরোজ তো ছবি আঁকতে জানেন না? অতএব বৃষ্টির ধারাজলের তৃষ্ণা কলের জলেই মেটানো যেতে পারে। ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে রাখা যেতে পারে। কিন্তু মেয়েদের যে প্রবল আপত্তি।
ভাই, চারপাশে দেখেছেন না, একটা জনপ্রাণী নেই। গাড়ি থামাবেন না।
তুমি আমাদের সকলকে মারবে। সবখানে গোঁয়ারতুমি চলে নাকি! তুমি। হলফ করে বলতে পার, এইখানে কোথাও আর্মি লুকিয়ে নেই।
তা থাকতে পারে। মীনাক্ষীর যুক্তি ফেলে দেওয়া যায় না। ফিরোজ আর নামলেন না গাড়ি থেকে। তবে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর সোজা পথও ধরলেন না। গন্তব্যস্থল তার কোন্টা? হাঁ, পুরোনো ঢাকাই বটে। এবং আমিনাও জানিয়ে দিয়েছেন, তিনিও পুরানো ঢাকাতেই যাবেন। স্বামী-সন্তান নিয়ে আপাততঃ খালার বাড়িতে উঠবেন। রাস্তার নাম ও বাড়ির নম্বর শুনে ফিরোজ বুঝলেন আমিনারা যেখানে যেতে চাইছেন সেটা অন্য রাস্তায় হলেও তার গন্তব্যস্থল থেকে সামান্যই দূরে। গাড়িতে দু তিন মিনিটের বেশি লাগবে না। অতএব হাতে যেটুকু সময় আছে এই রাস্তাটা দিয়ে একটু ঘুরে যাওয়া যাক। অবশ্যই স্বাভাবিক অবস্থায় এই ইচ্ছেটা ফিরোজের মনে জাগত না। সুদীপ্তও বাধা দিতেন। হাঁ বটে, কারফিউ আরম্ভ হতে এখনো দেরি আছে। এবং দুষ্কর্ম তারা যা শুরু করবে সেই কারফিউ শুরু হলে পর। যেন কোনো দিক দিয়ে কেউ পালাতে না পারে। তা হলেও ঘরের বাইরে এখন যত কম থাকা যায়। ততই ভালো। অতএব সোজা পথ ধরে কোনো-একটা ঘরে পৌঁছানোই তো বুদ্ধিমানের কর্ম। সুদীপ্তও সেই কথা বলতেন। কিন্তু এখন কিছুই বললেন না। তাঁদের সকলকেই কেমন একটা নিশীতে পেয়েছে যেন! নিশী-পাওয়া ব্যক্তির মতো ফিরোজ গাড়ি চালিয়ে চললেন, এবং অন্যেরা দেখতে দেখতে দেখতে চললেন।
জনমানবহীন রাস্তার দু পাশে মাঝে মাঝে গুলিবিধ্বস্ত বাড়ি মানস, পুড়িয়ে-দেওয়া জনপদের চিহ্ন-কয়েকটা দেখলেই আর কোনো বৈচিত্র পাওয়া যায় না। ধ্বংসের কোন বৈচিত্র্য থাকে? বৈচিত্র্য সৃষ্টির মধ্যে কিন্তু এই বৈচিত্র্য-হীন ধ্বংসলিলা দেখে বেড়ানোর মধ্যে কী একটা নেশা আছে যেন।
সারি সারি স্বল্পমূলধনের দোকান—নিম্ন মধ্যবিত্তেরা কোনোমতে টিন দিয়ে বানিয়ে ব্যবসা করে খাচ্ছিল। সব ওরা পুড়িয়ে দিয়েছে।…একটা দেয়াল গেলো বাড়ির বিপুল আঙিনায় পোড়া মোটর গাড়ি দেখা গেল অন্ততঃ পঁচিশ ত্রিশখানা। ভিতরে একটা গাড়ি মেরামতের কারখানা ছিল। একজন। রিক্সাচালকসহ রিক্সাটা পথের পাশে কাত হয়ে পড়ে আছে। দেখেই বুঝা যায়। রিক্সা নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় পাশ থেকে গুলি করেছে। তার শিথিল মুঠিতে রিক্সার হ্যাণ্ডেল তখনও লেগে ছিল।….আহ, ওই দেখ দেখ, গাছের ডালে। কিশোর বালকের লাশ ঝুলছে ঘন ঝাকড়া গাছ দেখে সেখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছিল বালকটি। কিন্তু ঝাকড়া গাছ দেখলেই সেখানে এলোপাথাড়ি গুলি। করেছে ওরা। সেই গুলিতে সে মারা গেছে। কিন্তু ঘন ডালের ফাঁকে শরীর আটকে গিয়ে মাথাটা নিচের দিকে ঝুলছে।…এখানে এটা? একটা স্কুল ছিল। আর ওখানে ওইটে দৈনিক পত্রিকার অফিস ছিল। ছিল কিন্তু নেই। আর্মি ধংস করে দিয়েছে। কিন্তু ধংস মানে যে, এতোখানি তা এখানে না এলে বিশ্বাস করা শক্ত হত। দরজা জানলা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি মেশিন, কাগজপত্র সব গলে পুড়ে একাকার হয়ে গেছে—শ্মশানের কঙ্কালের মতো উলঙ্গ দেয়াল। কোনোমতে দাঁড়িয়ে।…এবং এমনি সব দৃশ্যাবলির অপূর্ব মিউজিয়াম সমগ্র ঢাকা নগরী।
১৮. পুরোনো ঢাকার এইখানে
পুরোনো ঢাকার এইখানে, হাঁ এইটেই তো-এই তো তার খালার বাড়ি কতো এসেছেন। তবু যেন আমিনা বাড়িটাকে চিনতে পারছেন না। কি করেই বা চিনবেন? কখনো তো লোহার গেট এমন করে বন্ধ দেখেন নি। লোহার গেটে বিরাট তালা ঝুলছে। কোথায় গেছেন তার খালা-আম্মা! কিংবা তার খালাত ভাইয়েরা? স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে আমিনা যেন অকুল সমুদ্রে পড়লেন। আম। তো সময়ও বেশি নেই। বিশ-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই কারফিউ শুরু হয়ে যাচ্ছে। ফিরোজকে ছেড়ে দিয়ে কি ভুলটা যে হয়ে গেল! এবং সে জন্য সম্পূর্ণ জারী আমিনা। এখানে সঙ্কীর্ণ গলিতে গাড়ি ঢোকালে বেরুতে অসুবিধা হতে পাবে বিবেচনা করে বড়ো রাস্তার পাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে এটুকু পথ, পথ। সামান্যই, ফিরোজ তাদের এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।–