ওই শালাদের ইসলামে ওটা জায়েজ হতে পারে। ওই ইসলাম আমরা মানি নে।
বস্তুতঃ ফিরোজ ও ওদুদ সাহেবের মধ্যে ও বিষয়ে বিরোধের অবকাশ প্রায়। ছিলই না। অতএব কোন তর্ক ওঠেনি। এমনিই আলোচনা চলেছিল অনেকক্ষণ। কিন্তু সেটা সন্ধ্যার পরের ঘটনা।
বর্তমানের ঘটনা হচ্ছে, গাড়ির গতি মন্থর হতে দেখে একজন সৈনিক এগিয়ে এল তাদের পানে। এবং সৈনিকটিকে এগিয়ে আসতে দেখে ফিরোজের গাড়ি একেবারে থেমে গেল।
কিয়া মাঙ্গতা?
চট করে একটা বুদ্ধি খেলে গেল সুদীপ্তর মাথায়। বিশুদ্ধ উর্দুতে প্রশ্ন করলেন—এইখানে গুল আহমদ কিরমানি সাহেবের বাসাটা কোথায় বলতে পার?
স্বয়ং ফেরেশতারও সে কথা বলার সাধ্য ছিল না। কিন্তু পাকিস্তানি সৈনিকের অসাধ্য কিছু থাকে নাকি! সে নির্দ্বিধায় বলে দিল—আগে বাটত। এগিয়ে যাও, এগিয়ে গেলেই পাবে। ফিরোজ গাড়ি নিয়ে এগোলেন। কিছু দর এগিয়ে ফিরোজের মনে হতে লাগল, তিনি যেন একটা ভূতুড়ে শহরের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে চলেছেন।
এইখানে একটা মসজিদ ছিল না? হাঁ, ঐ তো। ভূতুড়ে পোড়া বাড়ির মতো। দাঁড়িয়ে আছে মসজিদটা। ঐ মসজিদে সারাক্ষণই মানুষ থাকত-ফিরোজ বরাবর দেখেছেন। সে একটা দেখার মতো জিনিস। হয় নামাজ চলছে, না হয়। ওয়াজ, না হয় মিষ্টান্ন কিংবা গোশত-রুটি বিতরণ। তা মানুষ কি পাঁচ দশ জন? পঞ্চাশ-ষাটের কম কোনো সময়ই নয়। এ না হলে দেশ গোল্লায় যাবে। কি করে-ফিরোজ ভাবতেন আর এতো যে মিষ্টান্ন-গোশত-রুটি এদের কে দেয় সেও ছিল ফিরোজের কাছে এক পরম বিস্ময়। সুদীপ্ত এ সব জানতেন না। কেন না? এ পথে কখনো তার আসার দরকার হয় নি। অতএব গোটা মসজিদ। শূণ্য দেখে ফিরোজের মনে যে ভাবান্তর হল সুদীপ্তর সেটা হয় নি। এবং সেই জন্যই বোধহয় হবে, সুদীপ্তর চোখে যা পড়ল ফিরোজ তা দেখেন নি। এমন কি মসজিদের বারান্দায় একটা কুকুরকে আমিনা যে শুয়ে থাকতে দেখলেন তাও ফিরোজের নজরে পড়ে নি। চকিতের মধ্যে কেবল এটুকু তিনি দেখলেন, গোলাগুলির ভয়ে লোকে মসজিদ ছেড়েছে। আমিনা দেখলেন, হায় হায়, যে মসজিদে মুসল্লি যায় সেখানে কুকুর! কিন্তু সুদীপ্তর দৃষ্টি গিয়েছিল ওপরে, মিনারের পানে—ওই যেখানে দাঁড়িয়ে মুয়াজ্জিন আজান দিয়ে থাকেন। কিন্তু ওখানে একটা মৃতদেহ যেন। গাড়ি দ্রুত চলে গেল। বেশি কিছু দেখা গেল না আর।
তা হলে সুদীপ্ত ঠিকই দেখেছিলেন। ওরা গাড়ি থামিয়ে নেমে খোঁজ নিলে একটি মৃতদেহকেই সেখানে দেখতেন। মসজিদের মিনারে মুয়াজ্জিনের প্রাণহীন দেহ। মুয়াজ্জিন কি মিনারে উঠে রাইফেল তাক করেছিলেন শত্রুর পানে?
অবশ্যই রাইফেলের আওয়াজ ওই এলাকায় গত দুদিনে বিস্তর শোনা। গেছে। এবং একবারও আজান শোনা যায় নি। পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষ। ছাব্বিশে মার্চের ভোরে ফজরের আজান শোনে নি। কেউই শোনে নি? সকলের কথা ওঠে না। যারা ফজরের সময় ঘুমিয়ে থাকে তারা কোনোদিনই আজান শশানে না। কিন্তু ওই সময় ঘুমোয়নি যারা? তারা নামাজ না পড়লেও আজানটা। শোনে। ওই দিন আর তা শোনে নি। একেবারেই শোনে নি বললে কিছুটা ভুল বলা হয়। পাড়ার পেনশন প্রাপ্ত সাবরেজিস্টার বৃদ্ধ আব্দুল আলিম সাহেব প্রতিদিনের মতোই শুনেছিলেন-আল্লাহু আকবার…। গোলাগুলির কর্কশ আওয়াজের মধ্যে সেই মোলায়েম আল্লাহু আকবার ধ্বনি বৃদ্ধের নিকট ঠিক রোজকার মতো সঙ্গীতময় মনে হয়েছিল কি? না ঠিক অন্য দিনের মতো। নয়—সেদিনের আল্লাহু আকবার ধ্বনি বৃদ্ধের কানে নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্যে বেহেশতের আশ্বাসবাণীর মতো মনে হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আল্লাহু আকবার আর দ্বিতীয়বার আলিম সাহেব শোনেননি। কিন্তু বিস্তর গুলিগোলার আওয়াজ শুনেছিলেন। পরহেজগার আলিম সাহেবের ভাষায় ওইগুলো ছিল। শয়তানের গোঙানি—ওই শয়তানদেরকে মৃত্যুদশায় ধরেছে। তারি আলামত এই সব। কিন্তু শয়তানের গোঙানির কাছে আল্লাহর ডাক যে সয়লাব হয়ে। গেল! সে থেকে আজ পর্যন্ত আর আজান পড়ে নি মসজিদে। অবসরপ্রাপ্ত জীবনে বৃদ্ধ সকল প্রকারের রাজনীতিচর্চা বাদ দিয়ে কেবলই নামাজ কালাম। নিয়ে ছিলেন। কিন্তু হায় হায়, এ কি হল! জুমার নামাজের সময়ও কারফিউ উঠল না। হায় আল্লাহ, জীবনে এই প্রথম তাঁকে জুমার নামাজ বাদ দিতে। হল। নাসারা ইংরাজের অধীনে দীর্ঘকাল চাকরি করেছেন, কখনো নামাজে কোনো প্রকারের বিঘ্ন সৃষ্টি হয়নি একদিনও। ওই বিধর্মিদের রাজত্বে কখনো যা হয়নি, আল্লাহ, তাই হল ইসলামী রাজ এই পাকিস্তানে। হিন্দুস্থান থেকে। হিন্দুদের অত্যাচারে পালিয়ে এসেছেন এমন কিছু মুসলমানের সাথে তার দোস্তি আছে। কিন্তু তারাও কেউ কোনোদিন বলে না যে, সেখানে হিন্দুরা কোথাও মুসলমানদের জুমার নামাজ বন্ধ করে দিয়েছে। হিন্দুস্থানের মুসলমানদের। নসিবে যা ঘটেনি তাই ঘটল এই পাকওয়াতনে! আফসোস, ইয়া মাবুদ। সাতাশ তারিখে কারফিউ উঠে গেলে লোকে যখন আক্রান্ত এলাকা ছেড়ে দিক-বিদিকে নিরাপদ এলাকার সন্ধানে বেরিয়েছিল বৃদ্ধ আলিম সাহেব তখন বেরিয়েছিলেন মসজিদের পানে। মুয়াজ্জিন হঠাৎ আজান বন্ধ করেছিলেন কেন? কিছু ঘটেনি তো। মানে, কি আবার ঘটবে! তিনি তো আজানই দিচ্ছিলেন। আর কিছু তো করেননি। তবে?
মসজিদে ঢুকে আলিম সাহেব কেঁদে ফেলেছিলেন হাউ হাউ করে। আল্লাহর ঘরের এই দশা! মসজিদের মেঝেতে রক্তের দাগ। অনেক রক্ত। এবং রক্ত এক জায়গায় নয় সারা মসজিদ জুড়ে, নানা স্থানে। বিশেষ করে গ্রামের পাশে এবং কোণগুলোতে। মসজিদের মধ্যেও ওরা মানুষ হত্যা করেছে! আহা ওদের কি দোষ! মোয়াজ্জিন সাহেবই তো যতো গোলটা পাকালেন! আজান দিতে উঠে সকলকে জানিয়ে দিলেন, আমরা এখানে আছি। ওখানে তারা ছিলেন সংখ্যায় পনেরো-ষোল জন। যথারীতি এবাদত বন্দেগী চলছিল। শুক্রবারের রাত—এই রাতের ফজিলত বিস্তর। কেউ কোরআন পড়ছিলেন। কেউ তসবিহ্ জপ করছিলেন, কেউ পড়ছিলেন নফল নামাজ। এমন সময় বোধহয় ইসরাফিলের শিঙ্গা বেজে উঠল। দুনিয়া ফানা হতে শুরু করল নাকি! বাতি নিবিয়ে দোর বন্ধ করে সকলে আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলেন। আল্লাহকে ডাকতে ডাকতেই ভোর হল। এখন ফজরের নামাজ। সকলে চাইল, ঘরের মধ্যেই চুপি চুপি আজান দিয়ে নিঃশব্দে নামাজ সেরে নেয়া যাক। কিন্তু মোয়াজ্জিন শুনলেন না। তিনি নিয়মমাফিক ওজু সেরে মিনারে উঠলেন। এখন আল্লাহর নামে ঘোষণা করবেন তিনি। আল্লাহর নামে সকল বালা-মসিবত দূর হবে। হবে নাকি! তোমরা যে আসলে সবাই ভণ্ড মুসলমান তা পাকিস্তানিরা জানেন না? গভর্ণর ফিরোজ খান নুন জানতেন, তোমাদের কারো খাতনা হয় না! অতএব সেই খান সাহেবের দেশবাসিগণ জানে তোমরা আদিতেই অমুসলমান থেকে গেছ। আয়ুব খান জানতেন, তোমরা সবাই হিন্দুদের গোলাম ছিলে, এখন আজাদ হওয়ার পরও সেই গোলামীর প্রবৃত্তি তোমাদের মধ্য থেকে যায় নি। অতএব তোমাদের মুখে আজানের ধ্বনি খাঁটি মুসলমানের মতো শোনায় না। পাকিস্তানি জওয়ানদের কানে সেই রাতের আজান কেমন শুনিয়েছিল? ভূতের কানে রাম নামের মতো! অন্ততঃ খুব-অসহ্য লেগেছিল তাতে সন্দেহ নেই? এবং অসহ্যকে সহ্য করে নেবার উদারতা জওয়ানদের কাছে আশা কর নাকি! অতএব এখন দেখ, সারা মসজিদ জুড়ে রক্ত। সেই রক্তের লোভেই এসে থাকবে কুকুরটা। এসে ফিরে যাবার সময় কি মনে করে। মল ত্যাগ করে গেছে। কিন্তু কোথায়? হায় হায়, ঐখানে দাঁড়িয়ে যে এমাম খুতবা পাঠ করেন! আলিম সাহেব শিশুর মতো কাঁদলেন খানিক। তারপর গেলেন মিনারে। মৃত মোয়াজ্জিনের রক্তে ভেজা লাশ—দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। দেখলেন এবং চলে এলেন। মসজিদে কুকুর প্রবেশের দুঃখ ভুলে গেলেন। হাঁ, লাভ ওইটুকুই। একটা বেদনাকে তো চাপা দিতে পারে আর একটা বেদনাই।