হামিদা আমার সঙ্গে চলে আসতে চাইছিল।
মীনাক্ষী গাড়ির মধ্যে কথাটা ফিরোজকে জানাবার অবকাশ পেলেন। ফিরোজ খুব সহজভাবে নিলেন কথাটা। এখন আর ঐ কথার কোন মানে হয়। না। অতএব যেন একটা সংবাদ শুনলেন, যেন হামিদা নামে একটি মেয়ের। মনের ইচ্ছাটাকে জানা গেল মাত্র—এমনি একটা ভাব নিয়ে তিনি শুধু বললেন–
ওখানে থাকা তো হামিদার পক্ষে কষ্টকরই বটে।
শুধুই কষ্টকর, হামিদার পক্ষে ওটা আস্ত একটা জাহান্নাম।
–আমিনা তার অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করলেন। তিনি সারাক্ষণ অন্দরমহলে ছিলেন, বাইরের ঘরে একবারও আসেন নি। সেখানে ভেতরের ঘরের প্রতিটি জানলা পুরু পর্দা দিয়ে ঢাকা; মুহূর্তের জন্যও তার কোনো-এক প্রান্ত ও একটু ফাঁক করার হুকুম নেই। বারান্দা ঘন চিক দিয়ে ঘেরা। মানুষ ওখানে থাকে কি করে? শুধুই আলো-বাতাসের অভাব যে, তা-ই নয়, ভীষণ নোংরাও বটে। আর বাতাস ওর মধ্যে ঢুকতে না পারলেও মাছি ঠিকই ঢুকে—এতো মাছি সারা। ঘরে! ছি-ছি, সারা গা ঘিন ঘিন করে এখনো সেই দৃশ্য মনে পড়লে। ওর মধ্যে স্বাস্থ্য বাঁচে? কিন্তু চাচার ইসলাম তো বাঁচে। আমিনার বাঁচতে ইচ্ছা করেনি। অন্ততঃ একটা রাতও যে এখানে কাটাতে হবে মনে তেমন সম্ভাবনার উদয়। হতেই আমিনার মরে যেতে ইচ্ছা করেছিল। কিন্তু প্রাণ পেয়ে যেন বেঁচেছেন। যখন মীনাক্ষী গিয়ে খবর দিয়েছেন–
না ভাই, এখানেও থাকা হচ্ছে না আমাদের। আবার যে কোথায় যাই।
চলুন না সকলে আমার খালার বাসায় যাই। বেশ বড়ো বাড়ি ওদের। ফিরোজের চাচী তখন সেখানে ছিলেন না। কিন্তু হামিদা ছিল। মীনাক্ষীদের চলে যাবার কথা শুনে হামিদার মন খারাপ হয়েছিল খুবই। সে মীনাক্ষীকে অনুরোধ জানিয়েছিল–
আমাকেও সুদ্ধ আপনাদের সঙ্গে নিয়ে চলুন না বুবু।
এখন মীনাক্ষীর বার বার মনে হতে লাগলো, মেয়েটাকে সঙ্গে নিয়ে এলেই ভালো হতো। কিন্তু নিজেরাই তারা কোথায় যাবেন—সেই। অনিশ্চয়তার মধ্যে তখন হামিদার অনুরোধকে গুরুত্ব দেওয়া সম্ভব হয় নি।
এত বেশি নির্জনতা কি সহ্য করা সম্ভব? বড়ো রাস্তায় নামতেই নির্জনতার। বিভীষিকা তাদেরকে চারপাশ ঘিরে আক্রমণ করল। এই বিভীষিকার মধ্য দিয়ে বোধ হয় তাদের এ যাত্রা আর ফুরোবে না—এমনি মনে হতে লাগল। কিন্তু সব যাত্রাই তবু ফুরোয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মানুষের দেখা পেলেন।
শান্তিনগর বাজারের কাছে-বহু মানুষ। আসবার সময় তো এখানে একটি জনপ্রাণীও ছিল না। কিন্তু এখন এতো মানুষ! এক সঙ্গে অনেক মানুষ, মানুষের চীৎকার এবং সারি সারি ট্রাক। এ দেখে মনে বল পাবার কথা। কিন্তু ফিরোজের বুক কেঁপে উঠল। কোনো বিজন প্রান্তরে একটি মানুষের জন্য সমস্ত চিত্ত যখন পিপাসিত তখন যদি মানুষের দেখা মেলে। কিন্তু পরক্ষণেই যদি। বোঝা যায়, সে মানুষেরা সব মানুষ উড়ে! প্রথমে যাদের মানুষ মনে হয়েছিল, ফিরোজরা দেখলেন, একটিও তারা স্বাভাবিক মানুষ নয়। কিছু সৈনিক এবং অধিকাংশ লুটেরা। আপনিই গাড়ির গতি মন্থর হয়েছিল-মূলতঃ ভয়ে সামান্য কৌতূহলও তার সঙ্গে ছিল। এতোগুলো মানুষ এখানে করছে কি? বাজার লুট করছে। বুঝতে বেশি বিলম্ব হয়নি ফিরোজের। প্রথমেই বুঝলেন জনতার ভাষা-বাংলা নয়। উর্দু ভাষার প্রবল বাক্যস্রোত অনর্গল প্রবাহিত হচ্ছে আর বোঝাই হচ্ছে ট্রাকগুলি। গম, ছোলা, গুঁড়ো দুধের টিন, চা, চিনি, কেরোসিন, ঘি, সোয়াবিন এবং সেই সঙ্গে আরো কতো কি। পাঁচটা ট্রাক ইতিমধ্যেই বোঝাই হয়ে গেছে। যষ্ঠটি বোঝাই হচ্ছে। আর একটি জওয়ান মুভি ক্যামেরায় সেই বাজার লুটের ছবি নিচ্ছে অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে। কিন্তু কেন? কারণটা সেই মুহূর্তেই ফিরোজ বুঝতে পারেননি। বুঝেছিলেন বহু পরে যখন একটি সাংবাদিক-সম্মেলনে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, বাঙালিরা বিহারীদের প্রাণ নিতে এবং সম্পত্তি লুটপাট করতে শুরু করলে তখন বাধ্য হয়ে তাঁকে সেনাবাহিনী শহরে নামাতে হয়েছিল। ….ওরে হারামজাদা! ফিরোজ উত্তেজিত হয়েছিলেন সেদিন।
কিন্তু আজ কেমন যেন একটু ভয় করতে লাগল। অবশ্যই বাজারে উর্দুর সংলাপ-বিচিত্রা চিরদিনই ফিরোজের মনে একটা অদ্ভুত রসের সঞ্চার করে কিন্তু আজ রসাপুত হওয়ার অবকাশ ছিল কোথায়।
…আবে চান্দু, ই ধার লে আও, ই ধার…আরে চাউল নেহি, গম লে আও, ছোলা লে আও, জলদি করো জলদি…গুঁড়া দুধ? জরুর লেগা…
হরেক রকমের কথা। ফিরোজরা বুঝলেন, যেহেতু এরা অবাঙালি, অতএব লোভটা গমের প্রতি। চাল রেখে দিয়ে গম নিয়ে যাচ্ছে। তবু রক্ষে। চাল থাকলেই বাঙালির চলবে। চলবে নাকি? অবাঙালিদের এতেই বোকা পেয়েছ? তারা যুদ্ধ করে ঢাকা শহর জয় করে নিয়েছে না। বিজিত সম্প্রদায়ের সমুদয় মাল-মাত্তা, মায় আওরাতগুলি পর্যন্ত, বিজয়ী সম্প্রদায়ের জন্য সেরেফ হালাল। তা নিয়ে তারা যা খুশি করতে পারে। চাউল পছন্দ নয়। ভালো কথা। ইচ্ছে হলে পুড়িয়ে দেবে। তোমাদের জন্য রেখে দেবে কেন শুনি!
কিন্তু এটা কি ধরনের কাণ্ড! সামরিক বাহিনীর প্রহরায় বাজার লুট হচ্ছে!
কেন হবে না? সন্ধ্যার পর উঠেছিল কথাটা, ইসলামের আইনে এ তো। জায়েজ।
বলেছিলেন আব্দুল ওদুদ সাহেব। ফিরোজের চাচাত ভাইয়ের এক শ্যালক। চাচার বাড়ি থেকে ফিরোজ অন্য এক চাচাত ভাইয়ের শ্যালকের বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন। সন্ধ্যার পর সেই বাড়ির ছাদ থেকে সকলেই তারা দেখেছিলেন, শান্তিনগর বাজার জ্বলছে। লুটপাট শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। এবং লুণ্ঠন শেষ হওয়ার পরেও ছিল কয়েক শো মণ চাল ও বাঙালিদের ব্যবহার্য অন্যান্য জিনিসপত্র। সেগুলো নিয়ে অবাঙালিরা করবে কি? অতএব তাতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল তারা। এই সব লুটপাট ও আগুন সম্পর্কেই মন্তব্য করেছিলেন ওদুদ সাহেব। ফিরোজ প্রতিবাদ করেছিলেন–