হ্যাঁ মা, চল যাই। তোমার আম্মাকে ডাক। তারপর ফিরোজের পানে তাকিয়ে–চল উঠি।
ফিরোজ এই কথাটির প্রতীক্ষাতেই ছিলেন যেন। যদিও এ বাড়িতে আজকের রাতটা থাকবেন বলেই এসেছিলেন, তবু এখন এখান থেকে বেরোতে পারলেই যেন বাঁচেন। পুলিশ তিনজনকে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে দেখেও এখানে রাত্রি যাপন করবেন এতোখানি সাহস কিংবা নির্বুদ্ধিতা কোনটাই ফিরোজের ছিল না। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন—
আরে তাই তো। হাতের ঘড়ির পানে তাকিয়ে ঘড়ি দেখতে দেখতে এখনই তো বেরোনো দরকার মীনাক্ষী, ভাবীকে ডাক।
মীনাক্ষী? বৌ-মার ঐ নাম রাখা হয়েছে বুঝি? গাজী সাহেব কেবল নাজমা নামটাই জানতেন। কী সুন্দর নাম-নাজমা! তাও পছন্দ নয় ছেলের। ও যে মুসলমানের নাম। তা বাবা, হিন্দু মেয়ে বিয়ে করলেই পারতে, একটা মুসলমান মেয়েকে হিন্দু বানানো কেন! নাহ, কথাটা চেপে রাখা যায় না। গাজি সাহেব বলেই ফেললেন—
বাবা ফিরোজ, একজন মুসলমানকে হিন্দু বানানো যে কতো বড়ো কবীরা। গুনাহ, তা জান?
নাজমা ততক্ষণে ভেতরে চলে গেছেন, পেছনে পেছনে হামিদাও গেছে। বেরিয়ে পরার জন্য ফিরোজ মন প্রস্তুত করে ফেললেন। হাঁ, বেরোতেই হবে। থাকবেন বলে এসেছিলেন। কিন্তু থাকাই যখন হবে না, তখন আর এক মুহূর্তও না। পথ যে কি ভয়াবহ সে অভিজ্ঞতা আসবার সময়ই হয়েছে। এতোক্ষণে তা আরো ভয়াবহ হওয়ার কথা। কারফিউ শুরু হতে কতো দেরি আর? এখনো পয়তাল্লিশ মিনিট। না, সময়টা কম নয়। তবু যতো তাড়াতাড়ি বেরোনো যায়–ফিরোজ ভাবছিলেন। এমন সময় চাচার ঐ প্রশ্ন–মুসলমানকে হিন্দু বানানো যে কবীরা গুনা তা কি জান? হা জানি, কিন্তু বাঙালিকে খোট্টা বানানোর চেষ্টা তার চেয়েও জবর গুনা। কিন্তু খাক, কথা বললে কথা বেড়ে যাবে। কথা বাড়িয়ে এ বাড়িতে আর তিনি সময় নষ্ট করতে চান না। তাই, তিনি যেন শুনতেই পান নি এমনিভাবে অন্যমনস্ক থাকতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু চাচা তা থাকতে দেবেন কেন। তবে চাচা আর আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কিছু বললেন না। যেন স্বগতোক্তি করলেন—
এই জন্যই তো বাপ তোমাদের দলকে এখানে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে।
ফিরোজ মনে মনে ঠিক করেছিলেন, কিছু বলবেন না কিন্তু স্বভাব যাবে কোথায়? বলে উঠলেন—
মনে হচ্ছে যেন আপনিই আমাদের দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন?
আলবৎ করেছি। কেন করব না? তোমরা বসে বসে এখানকার মুসলমানগুলোকে হিন্দু বানাবে আর আমরা তাই দেখব হা করে! আমাদের ঈমান কি এতোই কমজোর হয়ে গেছে!
না। আর কিছু বলা হবে না। তার বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, বাংলা শব্দে নাম রাখলেই যদি মুসলমানীতু চলে যায় তবে সে তো যাওয়াই উচিত চাচা! কিন্তু না। থাক। যাবার সময় আর তিক্ততা বাড়িয়ে লাভ নেই। ওই তো মেয়েরাও সর বেরিয়ে এসেছে। চল যাওয়া যাক।
আচ্ছা আসি চাচা। আস-সালামো আলায়কুম্।
ওয়া আলাইকুম উস্-সালাম। মাঝে মাঝে এসো বাবা। আজ এসে যা উপকারটা করেছ!
কি ভাবে?
ওই যে তোমার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। শহরের যা অবস্থা। গাড়ি না হলে বেরোনোই দায় এখন। ফোনও অচল হয়ে আছে সারা শহরে। অথচ দেশদ্রোহী কজন গাদ্দার পুলিশকে যে বাড়িতে ধরে রেখেছিলাম সে খবরটা ওদেরকে দেওয়া দরকারও ছিল খুবই।
তাই নাকি! তা সে খবরটা এতো ঘটা করে দেবার দরকারটা কি শুনি। বাড়িতে আর্মি আসা দেখে তো সেটা অনুমান করা গিয়েছিল। তবে মনে কোনো বদ মতলব আছে নাকি! এখনও তোমার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে? এ জন্য তো এখনো তুমি জাত রাজনীতিক হতে পার নি—ফিরোজ নিজেই নিজেকে শোনালেন। এতোখানি বোকামির কোনো মানে হয়। চাচাজি জামাতে ইসলামের লোক, ওখানে আপাততঃ আত্মগোপন করে বাইরে যাবার পথ খুঁজবেন—ছেলের কি আশা! এখনো যদি জামাতে ইসলাম না চিনে থাক রাজনীতি ছেড়ে দাও গে।
গাড়ি ছেড়ে দেবার মুহূর্তে চাচা শুধিয়ে বসলেন—
এখন তোমার বাড়িতেই যাচ্ছ তো বাবা। মানে, দরকার পড়লে তোমার বাড়ি গেলেই তোমাকে পাব তো?
চাচার মুখের দিকে তাকালেন ফিরোজ। কি ধরনের দরকার চাচা? তোমার চোখে ওটা কি? ঐ ধূর্ত হায়েনাটাকে এখনো চিনতে ভুল হবে ভেবেছ? ফিরোজ মুখ ফিরিয়ে নিলেন–
হাঁ, পাবেন। তবে দেশ যেদিন স্বাধীন করতে পারব সেইদিন।
বলেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। আর একটা কাগজের ঢেলা ছুড়ে দিলেন চাচার গায়ে। ওটা সেই হাশমত খাঁনের বয়ে-আনা চিঠি। কিন্তু চিঠি চাচার হাতে রইল। কি সেটা?—সে কৌতূহলের চেয়েও বড়ো একটা বিস্ময়-বিমূঢ়তা ছিল চাচার মনে। এ্যা, বেতমীজ ভাইপো বলে কি! এখনো তবে বিষদাঁত ভাঙেনি। আচ্ছা…। কিন্তু হায়, ভাইপো যে নাগালের বাইরে! এখন যে হাত-পা কামড়াতে ইচ্ছে করে। জাহেলটাকে এমনি ছেড়ে দিলাম! এটা কী দিয়ে গেল! চিঠিখানা চাচা পড়লেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলে। দিলেন। তারপর কোরানের একটি আয়াত পড়ে বলে উঠলেন—ওরে, আল্লাহ। ওদের অন্তঃকরণ সীলমোহর করে দিয়েছে, ওদের কি আর সুপথে ফেরানো যায়। ওরা জাহেল।
কিন্তু একটা জাহেলকে ছেড়ে দিলেন তিনি? হায় হায়! মিলিটারি তো এসেই ছিল বাড়িতে। একই সঙ্গে দুই কাজ হয়ে যেত। লাভের মধ্যে গাড়িখানা মানা পেয়ে যেতেন। কিন্তু এখন যে পস্তানোই সার। এক কাজ করা যায়…কিন্তু ছাই ফোনও তো অচল। সচল থাকলেই বা হত কি! গাড়ির নম্বর জানা আছে? ওই দেখো, গাড়ির নম্বরটাও নেওয়া হয় নি। যাঃ, সব হাতছাড়া হয়ে গেল।