তোমরা দেশকে বাঁচাবে, আর আমি তোমাদের বাঁচাব না?
হাঁ তা বাঁচাতেই তো হবে। ছেলেরা তাকে মধুদা বলে না! দাদা তো ছোট ভাইদের ভালোবাসবেই। ছোট ভাইদের ছোট-খাটো অপরাধ কি ধরলে চলে?
না যদি চলে তা হলে তুমিই অপরাধী।
অতএব মধুদাকে মারতে হবে। আর ডঃ দেবকে? তিনি পাকিস্তানের আদর্শে বিশ্বাসী নন। অতএব তাকেও মারতে হবে বৈ কি!
ডঃ দেব যে পাকিস্তান বিরোধী ছিলেন এমন কথা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের মুখেই শুনেছেন। তিনি হচ্ছেন প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী ডঃ আব্দুল খালেক। ডঃ খালেককে অবশ্য একটু চেনা কঠিন, কিন্তু মিঃ মালেকের ভাই বললে সকলেই তাকে চিনবে। স্ত্রীর অর্থে বিলেত গিয়েছিলেন। সেখানে থেকে পি এইচ.ডি, হয়ে এসে একটা হলের প্রভোষ্ট হয়েছেন, বেনামীতে দুখানা দোকান। চালাচ্ছেন নিউ মার্কেটে, এবং সমাজ সেবার মানসে সদস্য হয়েছেন রোটারি ক্লাবের। সুদীপ্তর সঙ্গে জানাশোনা মোটামুটি হলেও সকলের সঙ্গে তিনি বড়ো একটা মেশেন না। তাই তার নাম যত পরিচিত, তিনি নিজে তত পরিচিত। নন। কিন্তু মিঃ মালেক এদিক থেকে একজন প্রথিতযশা ব্যক্তি। পাস করেছেন পলিটিক্স নিয়ে। কিন্তু পলিটিক্স করেন না। ও সম্পর্কে পড়াশুনাও করেন না। লেখেন কবিতা। নিয়মিত ক্লাবে আসেন। এদিক থেকে তিনি ছোট ভাই খালেকের ঠিক বিপরীত। এবং প্রচুর আড্ডা জমাতে পারেন। আর বিস্তর মিথ্যা বলা ভদ্রলোকের অভ্যাস। ক্লাবে কোন দিন মালেকের পাশে বসলে সুদীপ্ত সেদিন সহস্র গ্যালন মিথ্যার ধারাজলে স্নান করে ঘরে ফেরেন। মিছে কথা ভদ্রলোক বলতেও পারেন ভারি সুন্দর করে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই সে মিছে কথা নিরীহ গোছের হয় না। অন্যের প্রচন্ড ক্ষতি হতে পারে এমন মিছে কথাও তিনি অবলীলাক্রমে বলে যেতে পারেন। চিন্তার সূত্র ছিড়ে দিয়ে ফিরোজের কণ্ঠস্বর এল—
আমার কি মনে হয় জান, এই যে কান্ডটা এহিয়া করল, এক হিসাবে এতে আমাদের লাভই হবে।
তা কিন্তু আমি তো দেখছি, তোমার লোকসান। আমরা পাঁচজন এসে চেপেছি তোমার ঘাড়ে। একি সোজা কথা।
মোটেই সোজা কথা নয়। ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে। তবে মনে রেখো, এহিয়ার ঘাড়ে যে বোঝা এবার আমরা চাপাব তাতে ঐ সব ব্যথা-বেদনা কিছু নয়, ঘাড়টাই ভেঙ্গে যাবে।
ঐ কাজটা করো না ভাই, অনেকে এতিম হয়ে যাবে।
তুমি দালালদের কথা ভাবছ তো। না, তাদেরকে এতিম করে দুঃখ আর দেব না। এতিম হওয়ার আগেই তাদেরকে খতম করে দেব।
মালেক-খালেক ভ্রাতৃদ্বয়ও এই দালালদের পর্যায়ে পড়ে। বিশেষ করে মা লেক সাহেব এ ব্যাপারে তুলনাহীন। বয়সেও বেশ প্রবীণ। কিন্তু ছেলে-মানুষীতে এখনও অদ্বিতীয়। ঐটুকুই আকৃষ্ট করে সুদীপ্তদের।
এই ভ্রাতৃদ্বয়ের কথা মনে করেই সুদীপ্ত এখানে বললেন, কয়েক জন দালালের কথা মনে এলে আমার কি ইচ্ছে করে জান!
কী? দেশত্যাগ ইচ্ছে করে? না প্রাণ ত্যাগ
আমার ইচ্ছে করে অন্ততঃ এক ঘন্টার জন্য ইয়াহিয়ার একটি বর্বর সৈনিক হয়ে যাই।
এই তো ভুল করলে অধ্যাপক। এহিয়ার বর্বর সৈনিকরা কখনো দালাল মারতে পারে না। তারা ভালো মানুষ মারে।
তাই তো। কথা তো ফিরোজ ঠিকই বলেছে। পশু কি কখনো পশু মারে? পশুর ধর্ম মানুষ মারা। মানুষ মারে পশুকে। হাঁ, তা হলে তাকে একটি মানুষই হতে হবে। শক্ত সমর্থ মানুষ। কিন্তু পঁচিশের রাতে কি ওরা কেবলি ভাল মানুষ মেরেছে। প্রায় তাই-ই। কেবল ভুল করে দু একটা সেম সাইড হয়ে গেছে।
০৩. কীর্তিমান পুরুষ বটে মালেক সাহেব
কীর্তিমান পুরুষ বটে মালেক সাহেব। এম. এ. পাস করেছেন ১৯৪৫-এর দিকে। সে সময়ে তিনি কমিউনিস্টদের গাল দিয়ে মাসিক মোহাম্মদীতে কবিতা লিখতেন। কেন না ঐটেই সবচেয়ে নিরাপদ ছিল সেই সময় দেশ স্বাধীন হলে মুসলিম লীগ অথবা কংগ্রেসের রাজত্বে বাস করতে হবে। অতএব তাদের কাউকে ঘাটানো নিরাপদ নয়। আবার একান্তই দেশ যদি স্বাধীন নাই হয় তা হলে বাস করতে হবে বৃটিশ রাজত্বে। অতএব বৃটিশের বিরুদ্ধেও কিছু লেখা যায় না। অথচ সেকালে পলিটিক্যাল বিষয়ে কবিতার বেশ বাজার দর। ছিল। এবং বৃটিশ-কংগ্রেস-মুসলিম লীগ সকলকেই খুশি করা যায় এমন বিষয় ছিল কমিউনিস্ট-বিরোধিতা। তাই লিখলেন “লাল বন্দুকের গান।” স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানে শুরু করলেন মুসলিম তাহজীব ও তামুদুন নিয়ে গবেষণা। সেই সময় তিনি একটি প্রবন্ধ লিখলেন। তার আরম্ভটা এইরকম “মাঝে মাঝে কবিতা লিখিয়া থাকি। কবিতা আমি ভালবাসি কিন্তু তদপেক্ষাও আমি বেশি ভালোবাসি আমার দেশকে। দেশ আগে। তারপরে সাহিত্য। দেশের স্বার্থ অগ্রে বিবেচনা করিতে হইবে পরে সাহিত্যের কথা আসিবে। আমি সাহিত্যের ছাত্র নহি। অতএব সাহিত্য সম্পর্কে সকল তত্ত্ব আমার না জানা থাকিতেও পারে। কিন্তু রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু পড়িয়াছি (এম.এ. পাস করার পর রাষ্ট্রবিজ্ঞান সম্পর্কিত একখানি গ্রন্থও তিনি পড়েন নি)।-রাষ্ট্র বিজ্ঞানের মধ্যে লব্ধ জ্ঞানের দ্বারা এই দৃঢ় প্রতীতী আমার মধ্যে জন্মিয়াছে যে…।” এই ভাবে শুরু করে সেই প্রবন্ধে মালেক সাহেব প্রমাণ করেছিলেন—নব গঠিত রাষ্ট্রের স্বার্থেই পাকিস্তানি জাতির জন্য রবীন্দ্র-চর্চা বিপজ্জনক। বিগত শতাব্দীর। পুঁথি সাহিত্যের আদর্শ হবে আমাদের পাকিস্তানি সাহিত্যের আদর্শ। আহা, পাক। সরকার কী খুশিই তখন হয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে মালেক সাহেব ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পেয়ে গিয়েছেন। প্রথমে লেকচারার, পরে তিন বছরের মধ্যেই পাঁচ জনকে ডিঙ্গিয়ে হয়েছিলেন রীডার। কিন্তু হায়! রীডার হওয়ার ছমাসের মধ্যেই এ কী কান্ড। অভূতপূর্ব সেই কান্ড ঘটল ১৯৫৪-তে। পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের ঘটল ভরাডুবি। পাকিস্তানের রজিনীতিক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রাধান্য শুরু হল। না, সে জন্য কপাল চাপড়ে লাভ নেই। বুদ্ধি থাকলে সব নদীতেই পার হওয়া যায়। বুদ্ধিখাটাতে শুরু করলেন মালেক সাহেব। কিছুক্ষণ ভাবলেন, আওয়ামী লীগের মনের কথাটি কী?-পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের মধ্যে থেকেও আমাদের বঙ্গীয় সত্তাটিকে আমরা ভুলতে পারি নে। ভুলব না। ব্যাস, মালেক সাহেব পূর্ব বাংলা নিয়ে ভাবে গদ গদ হয়ে একটা প্যানপেনে কবিতা লিখে ফেললেন। একুশে ফেব্রুয়ারির উপর। গানও লিখে ফেললেন একটা। একটা প্রবন্ধে লিখেই ফেললেন–পাকিস্তানের প্রথম রুদ্র (লেখক বোধ হয় রুদ্র শব্দের মানে জানতেন না) আবির্ভাবে অনেকেই আমরা বিমূঢ় হইয়াছিলাম। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আমরা সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়াছি। … “একটু মিছে কথা লেখা হয়ে গেল—লিখতে লিখতেই মালেক সাহেব ভেবেছিলেন, সত্যিকার জ্ঞানোদয়টা তার বায়ানতে হয় নি, হয়েছিল চুয়ান্নতে। তা হোক, যাহা বায়ান্ন তাহা চুয়ান্ন। এ ধরনের এক-আধটু মিথ্যা জায়েজ। এটা কলি যুগ না? কলি যুগে যোল আনা সত্য অচল। এইভাবে কিছু সত্য কিছু মিথ্যাকে আশ্রয় করে মালেক সাহেব ভারি সুন্দর সচল রইলেন চুয়ান্ন-পরবর্তী দিন গুলিতে। এমন সময় কী ভাগ্যের পরিহাস! আয়ুব খানের সেই মারশাল ল (গ্রাম্য উচ্চারণে মারশালা) জারি করলেন। আয়ুব খান এসে মারশাল ল জারি হওয়ার দিন মালেক সাহেব সারাদিন রোজা থেকে খোদার কাছে কেঁদেছিলেন। হায় হায়, এমনি করে কি কেউ নিজের পায়ে কুড়াল মারে। কোন কুক্ষণে কেন এইসব কবিতা-গান লিখেছিলাম। আল্লার কাছে বিস্তর কাদাকাটা করলেন মালেক সাহেব। নামায আগে থেকেই পড়তেন, এবার নফল নামাযের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন। আগে দাড়ির সঙ্গে গোঁফও কিছুটা রাখতেন। এখন খুর দিয়ে গোঁফও চেছে ফেললেন, দাড়ি রয়ে। গেল বহাল তবিয়তে। গুম্ফবিহীন দাড়িতে মুখের চেহারাটা এবার খাটি মুসলমানের মতো দেখতে হল। কিন্তু দিলে তবু ভরসা হয় না। নির্জনে একা। থাকলেই আল্লাহকে ডাকেন।