কি বলছেন সাহেব। আমাদের বুদ্ধি বিবেক?-বুদ্ধি বিবেক আপনাদের নেই? আপনাদের বুদ্ধি-বিবেক কি কয়?
না, সুদীপ্তর মতো ভদ্রলোকের কাজ নয় চাচার মুখোমুখি হওয়া। অতএব সুদীপ্তকে আড়ালে দিয়ে ফিরোজ সামনে এলেন–
আমাদের বুদ্ধি-বিবেক দিয়ে তো চাচা আপনাদের পাকিস্তান চলবে না, সে জন্যই বলা হচ্ছে..। কিন্তু ফিরোজের আর বলা হল না। তার কথায় আরো তেতে উঠে চাচা। আরো বেশি মাত্রাজ্ঞান হারালেন, এবং ফিরোজকে তার বক্তব্য শেষ করতে না দিয়ে বলে উঠলেন–
কিয়া বাত! আপনাদের পাকিস্তান! পাকিস্তান শুধু আমাদের তোমাদেরও নয়?
মনে মনে চাচা এবার খুব খুশি। কেমন ঠেসে ধরেছি বাবা! পলিটিক্স আমাদেরও জানা আছে। তোমাদের ভেতরে কি আছে আমরা তা দেখতে পাই মনে কর! পাকিস্তানকে তোমরা যে কখনো মেনে নিতে পার নি সে কি আমরা জানি নে! সামান্য একটু বিরতি দিয়ে চাচা আরো বললেন–
সেই জন্যই তো ইয়াহিয়া খানকে এমন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হল। এ ছাড়া দেশকে বাঁচানোর আর কি পথ ছিল বল।
তা ঠিক। তার চাচার পক্ষে ঠিক এই রকমটাই ভাবা স্বাভাবিক। ইয়াহিয়া খানের এত নরহত্যার সমর্থনও তা হলে আছে দেশে। অবশ্যই চাচা বলবেন, নরহত্যার সমর্থক আমরা নই, তবে আমাদেরই কর্মের ফলে ইয়াহিয়া খানকে যে এই নরহত্যার পথ বেছে নিতে হয়েছে সেই সত্যকে তো বাবা। অস্বীকার করতে পারবে না।
তাই নাকি চাচা! এ যে খোদ ইয়াহিয়া খানের কণ্ঠস্বর মনে হচ্ছে। এবং ইয়াহিয়া খানের শয়তানীর জবাব তো আজ একটাই, সেটা কোন মানব কণ্ঠের ভাষায় দেওয়া যাবে না আর, দিতে হবে অস্ত্রের ভাষায়। চাচা, তোমার জন্যও মনে হচ্ছে, তেমনি অস্ত্রের জবাব আবশ্যক হয়ে পড়েছে। হাঁ মাঝে মাঝে এমন। এক-একটা সময় আসে যখন লাঠির যুক্তি ছাড়া আর কোনো যুক্তির পথে। এগোনো যায় না। কিন্তু এই মুহূর্তেই ফিরোজ তার চাচাকে লাঠি দেখাতে চান না। তিনি প্রবল চেষ্টায় শান্ত কণ্ঠে বললেন–
কিন্তু এহিয়ার কর্মের ফলেই যে আমাদেরকে অহিংস অসহযোগ। আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হয়েছিল সেইটাই বা আপনি অস্বীকার করবেন কী। করে? অহিংস আন্দোলন দমনের জন্য…
অহিংস আন্দোলন?—ফিরোজের কথা শেষ হবার আগেই চাচা প্রায় গর্জন করে উঠলেন, বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা হয় নি ঢাকা শহরে? আমি তা স্বচক্ষে দেখেছি।
তবু বলব দাঙ্গা হয় নি। ফিরোজের কণ্ঠে উত্তেজনা আর গোপন থাকল না, দাঙ্গার চেষ্টা হয়েছিল মাত্র। এবং সে জন্য গোপন উস্কানী ছিল ওই এহিয়া-সরকারের। আমরা যথাসময়ে সে চেষ্টা বানচাল করে দিয়েছি। তা না। করলে এই ঢাকা শহরে একজনও বিহারি বেঁচে থাকত ভেবেছেন।
না, ওই সব ভাবতে চাচা রাজী নন। তিনি কেবল সেইটুকু ভাবতে ও বলতে পারেন যেটুকু তার মনিবরা তাকে শিখিয়ে থাকেন। অতএব কেবল সেই শেখানো কথার পুঁজি নিয়ে তিনি ভাইপো ফিরোজের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলতে পারেন না। কিন্তু সে তো অন্য সময়ের কথা। এখন যে সময়টা তাদের। অত্যন্ত অনুকূলে যাচ্ছে বলে তারা মনে করেন সেই সময়ও তাকে ভাইপোর কাছে হার মানতে হবে? যুক্তিতে না পারলে শক্তিতে হারাবে কে? চাচা তাই বলে উঠলেন—
কি বলছ বাবা! ঢাকা শহরে একজন বিহারিকেও রাখতে না! আমরা তা হলে। কি বসে বসে তামাসা দেখতাম? বিহারিরা মুসলমান না! নিরপরাধ মুসলমানের রক্তে মাটি ভিজিয়ে তোমরা আমাদের হাত থেকে রেহাই পেতে ভেবেছ।
শেষের কথাগুলি দাঁতে দাঁত চিপে এমন ভঙ্গিতে চাচা বললেন যে, মেয়েরা তো মুখে আচল দিয়ে হেসেই ফেললেন। ফিরোজ হাসলেন না। ভীষণ ক্রুদ্ধ হলেন। ভণ্ডামীর একটা তো সীমা থাকা দরকার। এখনি বললেন, আমরা বিহারি মেরেছি বলে ইয়াহিয়া সৈন্য লেলিয়ে দিয়েছে আমাদের পেছনে। এখন আবার বলছেন, আমরা যদি বিহারিদের রক্তে ঢাকার মাটি ভেজাতাম তা হলে তারা তা সহ্য করতেন না। আমরা তা হলে, চাচা, করেছি কোন কামটা? বিহারি মেরেছি? না, ভবিষ্যতে মারতাম?…কিন্তু এ প্রশ্ন ফিরোজ তুললেন না। অন্য একটি কথা তার মাথায় এসেছে। তিনি বললেন–
কিন্তু এখন তো, চাচা মুসলমানের রক্তে ঢাকার মাটি সয়লাব হয়ে গেল। না কি করেছেন সে জন্য? বা করছেন? উঠুন, ইসলামী জোস একটু দেখান।
চাচা সহসা গম্ভীর হয়ে গেলেন। হাতের লাঠি আস্তে মেঝের উপর ঠুকে বললেন–
বাবা ফিরোজ, তোমার সঙ্গে আমার রসিকতার সম্পর্ক নয়। তুমি বলছ, মুসলমানের রক্তে ঢাকার মাটি সয়লাব হয়েছে। আমি বলছি, হয় নি।
বলতে বলতেই চাচার কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়ল আবার। আবার তেমনি দাতে দাত চিপে বললেন–
যারা সব মরেছে তারা মুসলমান বলতে চাও? তারা দেশের দুশমন? তারা কাফের।
সহসা হামিদা কি মনে করে কথা বলে উঠল–
কিন্তু মামা, আমাদের মনিরুজ্জামান স্যার সম্পর্কে শুনেছি, খুবই ঈমানদার ও পরহেজগার ছিলেন।
তির্যক দৃষ্টিতে ফিরোজের চাচা হামিদার দিকে তাকালেন। কিন্তু ধীর কণ্ঠে বললেন–
ওটা তুই বুঝবি নে মা। আল্লাহ পাক ওটা ঈমানদারের ঈমান পরীক্ষা করেছেন।
এই সময় বেলা এসে তার আব্বার কোলে চড়ে গলা জড়িয়ে ধরল—
চল, বাড়ি যাবে না আলু।
তাই তো মা, ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছ। চাচার সঙ্গে ফিরোজের আলোচনা এখন যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তাতে মাঝখানে কাউকে এসে দুজনের দুকান ধরে দুদিকে সরিয়ে দেওয়াই তো কর্তব্য। হ্যাঁ, সে কর্তব্য পালনের উপযুক্ত ব্যক্তি এখানে বেলাই হতে পারে।