চিঠিখানা পড়ে তা নীরবে ফিরোজ সুদীপ্তর হাতে চালান করে দিলেন। ইংরেজিতে টাইপ করা একখানা চিঠি নিচে মওলানা নাম সই করেছেন আরবীতে। সুদীপ্ত পড়তে পড়তে শুনলেন, ফিরোজ বলছেন—
খলিশদের এটা কি রসিকতা? নাকি এ বেকুবের স্পর্ধা? যা খুশি আমাদের দিয়ে করিয়ে নেওয়া যায় বলে মনে করে নাকি?
আবার কাকে গালাগালি শুরু করলে?
—বলতে বলতে মীনাক্ষী এলেন ঘরে। তাঁর সঙ্গে হামিদার হাতে চায়ের সরঞ্জাম। চাচী সঙ্গে কিছু নাশতা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মীনাক্ষীই বাধা দিয়েছেন—
এই মাত্র ওরা সব খেয়ে বেরুলো। আর কিছু লাগবে না। শুধু চা দিন।
স্যারকে শুধুই চা দেওয়া যায় নাকি!
—হামিদা বাধা দিতে গিয়েছিল। কিন্তু মীনাক্ষীর ধমক খেয়ে থেমে যেতে। হয়েছে তাকে।
তোর স্যার যখন তোর বাড়ি যাবে তখন তোর ইচ্ছে মতো খাওয়াস। এখন আমাদের বাড়িতে কি খাওয়ানো দরকার সেটা আমরা বুঝব।
মীনাক্ষী ঠিকই বলেছেন। তখন মাত্র চায়ের পিপাসা ছিল ওদের। চা খেতে খেতেই চাচা এলেন। পরদার ফাঁক দিয়ে চাচাকে দেখা গেল। কিন্তু চাচার পেছনে ওরা কারা? সশস্ত্র ফৌজের একটা ক্ষুদ্র দল যে। সকলেই শিউরে। উঠলেন? চকিতে সকলের মনেই নানা কথার বিদ্যুৎ খেলে গেল।
চাচা আমাদেরকে আর্মির হাতে তুলে দিবে নাকি! আমার জন্য আমার বন্ধুও মরবে।…….
আমি এখানে! ভদ্রলোকের কোন আত্মীয় আর্মিতে থাকে নাকি! নাকি অন্য কিছু ব্যাপার আছে! কি থাকতে পারে এখানে!
–ও মা মিলিটারি যে! মামার বাড়ি সার্চ করবে নাকি! তা হলেই হয়েছে। লোকগুলো এখনো তো ভরা আছে গ্যারেজে?……
লোকগুলো মানে তিনজন পুলিশ। রাজারবাগ পুলিশের লোক ওরা। আর্মির সাথে যুদ্ধ করে কিছু ওদের মরেছে, কিছু পালিয়েছে। অনেকেই আশ্রয়। নিয়েছে আশেপাশের বাড়িতে। চাচার বাড়িতে যে তিনজন এসেছিল তাদেরকে বেশ সমাদরেই চাচা বরণ করেছিলেন। কারফিউ ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই গতকাল ওরা পালাতে চেয়েছিল। কিন্তু চাচা বলেছিলেন
না বাবারা, ওই কাজ করবেন না। অবস্থা একটু শান্ত হোক, আমি নিজে গাড়িতে করে আপনাদেরকে সাভারে অথবা ডেমরার ওদিকে কোথাও রেখে আসব।
এ কথায় খুবই আশ্বস্ত হয়েছিল পুলিশ তিনজন। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল মনে মনে। তারা যে এমন একজনের ঘরে ঠাই পেয়েছে সে একান্তই কপালের গুণে। আহা, মানুষ তো নয় গো, যেন ফেরেশতা একেবারে। নামাজ, কালাম, মুখভরা দাড়ি দেখলেই ভক্তি হয়। গ্যারাজ থেকে অচল গাড়িখানা বের করে সেইখানে জীর্ণ কম্বল ও তোসক। বিছিয়ে তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। তাতে অসুবিধা বিশেষ ছিল না। কারণ ঘরখানা প্রথমে তৈরি হয়েছিল চাকরদের বাসের জন্যই। অতএব ছোট একটি জানলা সেখানে ছিলই। পরে ওটাকে গ্যারাজ বানানোর জন্যে সামনের দিকটা ভেঙে দরজা বড়ো করা হয়েছিল; কিন্তু জানলাটি বন্ধ করা হয় নি। পলি তিনজনকে সেখানে পুরে বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে রাখা হত, যেন কেউ সন্দেহ না করে। ঘরে দেওয়া হয়েছিল পেচ্ছাব ইত্যাদির জন্য একটা খালি কেরোসিনের টিন, এবং এক কলসী পানি। অতএব ব্যবস্থাটাকে পুলিশের কাছে যতোদূর সম্ভব নিখুঁত বলেই মনে হয়েছিল। খাবারের সময় ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে খাওয়ানো হত। সেইটেই ওদের নিকট প্রতীয়মান হত পরম সমাদর বলে।
আটাশে মার্চের বেলা প্রায় তিনটের দিকে পরম সমাদরে গ্যারাজের তালা খুলে ফিরোজের চাচা গাজী মাসউদ-উর রহমান বাঙালি পুলিশ তিনজনকে পাঞ্জাবি সৈনিকদের হাতে তুলে দিলেন। কর্তব্য সমাধা করে একটা পরম তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে চাচা ঘরে এসে সোফার উপর বসলেন। হামিদাকে বিজলি পাখা চালিয়ে দিতে বললেন এবং ফিরোজদের দিকে লক্ষ্য করে। বললেন— একটা দায় চুকল। উহ্! কী যে দুশ্চিন্তায় ছিলাম বাবা!
অতঃপর নিজেই আনুপূর্বিক ঘটনার বিবরণ দিয়ে বললেন—
তোমরা হয়ত ভাবছ, আমি বেঈমানী করলাম। আশ্রিতকে রক্ষা করা। আশ্রয়দাতার কর্তব্য। হাঁ বাবা, আমি সে কথা একশো বার মানি। আশ্রিত যদি আমার নিজের জীবনের শত্ৰ হত আমি তাকে জীবনের বিনিময়ে হলেও রক্ষা করতাম। কিন্তু এই পাক-ওয়াতানের সাথে বেঈমানী কিছুতেই আমরা সইবো
ফিরোজ বা অন্য কেউ কিছুই বলেন না দেখে তিনি আবার বলা শুরু করলেন–
আগে তো দেশ। তারপর মানুষ। বল এ কথা তুমি মান কি না।
না। আর চুপ থাকা যায় না। কিছু বলতেই হয়। কিন্তু সোজা কথা তো। বলা যাবে না। কে জানে, তাঁদেরও দশা ওই পুলিশের মতো হয় কি না। ফিরোজ একটু ভেবে বললেন–
না চাচা, আগে ইসলাম। তারপর দুনিয়ার যা কিছু সব।
বল কি বাবা,! ঠেলা খেয়ে মতি ফিরল নাকি! এমন কথা তো এর আগে। কখনো তোমাকে বলতে শুনিনি।—না। তা বলে সহজে বিশ্বাস করছিনে। তুমি ঠাট্টা করছ বোধ হয়।
চাচা তবে ঠিকই ধরেছে তো। মনে মনে ফিরোজ একটু হাসলেন। এবং চুপ করে গেলেন। সুদীপ্তও ব্যাপারটা বুঝে ফেলেছেন ততক্ষণে। তিনি একটু অভিনয়ের চেষ্টা করলেন। ফিরোজকে সমর্থন করে বললেন—
–জি না। ঠাট্টা করবে কেন। ঠিকই তো বলেছে। আপনাদের মতো বুদ্ধি-বিবেক যাদেরই আছে তারাই বলবেন, ইসলামকে বাদ দিলে এই পাকওয়াতানের অস্তিত্ব কোনোখানেই টেকে না।
সুদীপ্ত ফিরোজের চাচাকে খুশি করতে চাইছিলেন। কিন্তু সব কাজ সকলে পারে? অন্ততঃ সুদীপ্ত যা করতে চাইছিলেন তা যে পারেন নি সেটা চাচার পরবর্তী কথাতেই বুঝা গেল। চাচার কণ্ঠস্বরে বেশ উত্তেজনা–