হাশমত এক সময় তাঁদের নীলক্ষেত আবাসিক এলাকার দারোয়ান ছিল। মাত্র মাস দুয়েক আগেও ছিল। এখন করছে কি?
বেবসা করি হুজুর।
হাশমত খাঁ ব্যবসা করছে! ভালোই তো। বিহার থেকে মোহাজের হয়ে এসে হাশমত খাঁ পিওনের চাকরি করত একটা অফিসে। তাতে চলত না। অগত্যা রাত্রে দারোয়ানী। রাত্রে তাদের এলাকা পাহারা দেবার ভার নেওয়ার ফলে আরো অতিরিক্ত ষাট টাকা আয় হত। এইভাবেই চলছিল। হঠাৎ গত জানুয়ারিতে নীলক্ষেতের চাকরি সে ছেড়ে দেয়। কেন ছাড়ল, কোথায় কি কাজ পেল ইত্যাদি কোনো প্রশ্নই তখন কারো মনে জাগেনি। কিন্তু এখন তো শুধাতেই হয়—
ব্যবসা করছ তুমি? কিসের ব্যবসা?
মহম্মদপুরে একঠো মনিহারী দোকান পেয়েছি হুজুর।
পেয়েছি মানে কিনে পাওয়া নয়। সে ইতিহাস কয়েকটি প্রশ্ন করে জেনে নিলেন তারা, অর্থাৎ সুদীপ্ত ও ফিরোজ। মীনাক্ষী ও হামিদা বাইরের লোকের সমাগম হতেই ভেতরে চলে গেছেন।
হাশমতের কাছে সংক্ষেপে যা জানা গেল তাতে হাশমতের কোনো দোষ। নেই।
আমার কোনো দোষ নাই আছে হুজুর। জোর করে আমার কাছে দিয়ে গেল।
লোকটির বাড়ি ছিল ময়মনসিংহে। গতকাল নাকি জোর করে তার মনিহারী দোকানটা সে হাশমতকে দান করে গেছে। হাশমত ছিল ওই দোকানের সেলসম্যান। গত জানুয়ারি মাসে সব রকমের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে এই কর্মে ঢুকেছিল। মহম্মদপুর এলাকায় অবাঙালি সেলসম্যান ছাড়া দোকানের পসার জমানো ছিল শক্ত। অতএব হাশমতকে নিযুক্ত করে ভদ্রলোক ভারি সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলেন। তা ছাড়া হাশমত বেশ চালাক চতুর লোক; এবং ভারি বিশ্বস্ত। হাশমতের চেষ্টায় এক মাসেই দোকানের আয় প্রায় দ্বিগুন বৃদ্ধি পেয়েছিল। সবি তো বোঝা গেল। কিন্তু সেই বিশ্বাসের পুরস্কার স্বরূপ গোটা দোকানটাই একেবারে দান করে গেল। ওই রকম দান কেউ করে নাকি! সুদীপ্ত শুধালেন—
লোকটা কি আর কখনো ফিরে আসবে না বলে গেছে?
তা কিছু বলেনি হুজুর। খালি কাল সকালে হামারে চাবি দিয়ে বলে গেছে—রোজ তুমি দোকান খুলবে, আর কেউ পুছ করলে কিংবা লুঠ করতে এলে তুমি বলবে দোকানটা তোমার, বুঝলে।
তাই নাকি! তারপর?
তারপর নিজের হাতে তিনি বাংলা হরফে লেখা সাইনবোর্ড নামিয়ে ফেললেন। হামারে বললেন, উর্দুতে একঠো সাইনবোর্ড লিখে এখানে টানিয়ে। দিও।
তুমি তা দিয়েছ তো?
হাঁ, হাশমত সে আদেশ পালন করেছে। সে তার মনিবের অত্যন্ত বিশ্বস্ত কর্মচারি। আগে দোকানের নাম ছিল মুক্তা মনিহারি। এখন সেখানে গেলে। দেখা যাবে, বাংলা হরফের কোনো চিহ্ন তার ধারে কাছে কোথাও নেই। তার পরিবর্তে উর্দু হরফে সবুজ কালি দিয়ে লেখা—হাশমত ইসটেশনারি।
ফিরোজ এতক্ষণ কিছু বলেন নি। সব শুনছিলেন। এবং বুঝতে কোনোই। কষ্ট হচ্ছিল না যে, দোকানটাকে নিছক বাঁচানোর জন্যই ভদ্রলোকের এতো সব চেষ্টা। দোকানের মালিক অবাঙালি—এমন একটা ধারণা বাইরে প্রচারিত থাকলে তবেই ওই এলাকায় তা লুটপাটের কবল থেকে রেহাই পেতে পারে। ঠিকই ভেবেছিলেন ভদ্রলোক। কিন্তু যে সর্ষে দিয়ে ভূত ভাগনোর আয়োজন করেছেন সেই সৰ্ষেতেই যে ভূত! ফিরোজ শুধালেন—
আচ্ছা ধর, কয়েকদিন পর যদি দোকানের মালিক ফিরে আসেন।
তো হাম কিয়া কারে গা! দোকানের মালিক তো এখন হামি—ও তো এখন হামারা দোকান আছে।
তা আছে, থাক। কিন্তু সেই ভদ্রলোক এসে যদি ফেরত চান।
কিয়া বাত? খয়রাত করে আবার তা ফেরত চাইবে! চাকু মেরে একেবারে হালাক করে দিব না!
দুজনেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, হাশমত এখন আর সেই পিয়ন নয়। যেন। এখন সে যেন এই এক দিনেই তাদের সঙ্গে সমমর্যাদাসম্পন্ন ভদ্রলোক হয়ে উঠেছে।.. তা যা খুশি হোক গে, আর ভাবা যায় না। কতো আর অত্যাচারের অবিচারের যন্ত্রণা পোহানো যায়! না, ঐ প্রশ্ন আর নয়! ফিরোজ কাজের কথা পাড়লেন
এখানে এসেছ কি উদ্দেশ্যে।
গাজী সাহেব কা লিয়ে একঠো খত্ হয়।
গাজী সাহেব অর্থাৎ ফিরোজের চাচার কাছে একটা চিঠি নিয়ে এসেছে হাশমত। কার চিঠি? সে কথা কি আর বলবে! এখন সে একটা দোকানে। মালিক। অতএব বুদ্ধিমান হয়েছে বৈ কি। তবু একটু বাজিয়ে দেখা যাক না–
খত পাঠাল কে?
মওলানা সাহাব ভেজ দিয়া।
কোন্ মওলানা! দেখা গেল হাশমত খাঁ এই লাইনে একজন গবেট। সর কথা অকপটে বলে ফেলল। এমন কি যখন শুনল যে, ফিরোজ হচ্ছেন গাজী সাহেবের ভাইপো তখন বিনা দ্বিধায় চিঠিখানা ফিরোজের হাতে সঁপে দিয়ে চলে গেল সে। গাজী সাহেবের মতো লোকের ভাইপো যখন তখন সে ঈমানদার না। হয়ে যায় না–হাশমতের চিন্তার দৌড়—এর চেয়ে বেশি হবে কি করে?
কিন্তু হাশমত বড়ো উপকার করে গেল। চিঠিখানা তার চাচার নয়, তারই পাওয়ার দরকার ছিল বেশি। খোদ সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এই ব্যক্তিগত পত্রে মওলানার একান্ত বিশ্বাসভাজন গাজী সাহেবকে অত্যন্ত জরুরি কয়েকটি কথা লেখা হয়েছে। তার সারকথা হচ্ছে,সামরিক কর্তৃপক্ষের এই মুহূর্তেই কিছু দালাল দরকার। মুসলিম লীগ বা জামাতে ইসলামের লোক হিসাবে যারা চিহ্নিত হয়ে আছে তাদের কথার এখন খুব একটা দাম হবে না। সে জন্য খোদ আওয়ামী লীগের কোনো লোক পেলে ভালো হয়! গাজী সাহেব তার ভাইপো ফিরোজকে যদি হাত করতে পারেন তাহলে মওলানা জানিয়েছেন, সরকার। তাকে একটা আমদানি লাইসেন্স দিতে রাজী আছে। ফিরোজকে কি করতে হবে তারও সামান্য ইঙ্গিত পত্রে আছে। আপাততঃ সামরিক বাহিনীর কাজ সমর্থন করে একটা বিবৃতি দিতে হবে—বলতে হবে,আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক দুস্কৃতিকারী যে দেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিল তার সাথে অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সদস্যের কোন যোগ নেই। ওই দুস্কৃতিকারীদের দমন করতে গিয়ে সেনাবাহিনীকে যে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে সেটা যথেষ্ট সময়োপযোগী হয়েছে; ওই ব্যবস্থা গৃহীত না হলে দেশ জাহান্নামে যেত.. ইত্যাদি। পরিশেষে বলা হয়েছে, ফিরোজ কথা শুনতে না চাইলে তাকে যেন ভয় দেখানো হয়—তার ঘর-বাড়ি, লুটপাট করা হবে, তাকে ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে পীড়ণ চালানো হবে, পরিশেষে সামরিক আদালতে বিচার করে হত্যা করা হবে।