সকলকে নিপ দেখে হামিদা আবার বলল–
আর সবচেয়ে দুঃখের কথা কি জানেন স্যার! আফিয়ার স্বামীর লাশ পর্যন্ত ওরা দেয় নি। কোথায় নাকি গর্ত করে পুঁতে ফেলেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল অধ্যাপককেই ওরা অমনি করে মাটি চাপা দিয়েছে। ধর্মীয় বিধান অনুসারে সৎকারটুকু পর্যন্ত করতে দেয় নি! কে জানে, হয়ত একই গর্তে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুয়ে আছেন কোনো পকেটমারের সঙ্গে জড়াজড়ি হয়ে! এমনটা করা কি উচিত হয়েছে?—সুদীপ্ত ভাবছিলেন। আর ফিরোজ ভাবছিলেন—ঠিক ওই রকম ছাড়া ও খবিশরা আর করবে কি শুনি! অধ্যাপক তো কখনো দেখে নি জীবনে। দৌড় তো সেই মক্তবের ওস্তাদজি পর্যন্ত। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে লেক্টরাইট। বর্বরদের সঙ্গে একত্র বাসের এই হচ্ছে জ্বালা। জীবনের মূল্যবোধ যাদের মধ্যযুগীয় তাদের পাশে আধুনিক চেতনাকে পদে পদে বিড়ম্বনা সইতেই তো হবে। কিন্তু আর নয়। এর অবসান এখন চাই-ই।
১৭. পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল
আচ্ছা দুলা ভাই, এই যে আপনাদের পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল, এর পর আপনারা করবেন কী?
হামিদা প্রশ্নটা করতে চেয়েছিল খুবই সরল ভাবে। কিন্তু ফিরোজ সহসা যেন তার চাচার মানসিকতা ঐ কণ্ঠস্বরে লক্ষ্য করলেন। সেটা অবশ্য ফিরোজেরই দোষ। তিনি যদি সকল ঝোপেই বাঘ দেখতে শুরু করেন তা হলে লোকে সে জন্য করবে কী? হামিদার একটি সরল প্রশ্নের উত্তরে ফিরোজ যা বললেন তা যেন তার চাচাকে শোনানোর জন্য–
কী আর করব! তোমার মামাদের প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়ে নাকে খত দিয়ে বলব—যা হবার হয়েছে, এবারের মতো মাফ করে দিন; আর কখনো বলবো না যে, আমরা বাঙালি; আর কখনো গণতন্ত্র চাইব না; অর্থনীতিক ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সমতা দাবী করব না; তা ছাড়া বাংলা ভাষা ভুলতে চেষ্টা করব। রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনলে কানে আঙ্গুল দেব। পরিশেষে তোমার মামার মতো দাড়ি রেখে দেব।
এতো দুঃখেও সুদীপ্তর হাসি পেল। হাঁ, ফিরোজের ঐভাবে কথা বলার অধিকার আছে বটে। হামিদা তাঁর না হয় ছাত্রী, ফিরোজের তো শ্যালিকা। কিন্তু শ্যালিকার ভূমিকায় হামিদা ভয়ানক অযোগ্যা প্রমাণিত হল। হয়ত সম্মুখে একজন শিক্ষকের উপস্থিতি তার কারণ। হামিদা শুধু বলল—
আমি কিন্তু দুলাভাই রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালোবাসি। এবং ইংরেজি পড়ছি বলে বাংলা ভুলতে চাই তাও নয়। অতএব আমাকে আপনার এইভাবে কথা বলা উচিত নয়।
সুদীপ্ত দেখলেন, এবার তাকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। ওরা দুজনেই। পরস্পরকে ভুল বুঝেছে। এবং এতক্ষণের স্বাভাবিকতা থেকে কিছুটা বিচ্যত হয়ে পড়েছে। একজন বন্ধু, আর একজন ছাত্রী—দুজনের কথাই মনে রেখে। সুদীপ্ত বললেন–
ফিরোজের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটাকে মনে রেখে কথা বল হামিদা।
কিন্তু হায়, কি উদ্দেশ্যে তিনি কথাগুলি বললেন, আর তার ব্যাখ্যা হল কি রকম। মীনাক্ষী টিপ্পনী কাটলেন—
আপনি বুঝি এখানেও মাস্টারি শুরু করলেন।
ওই বদ অভ্যাসটা যে ছাড়তে পারি নে, ভাবী।
বিশেষ করে ছাত্রী পেলে।
—কণ্ঠস্বরটা ফিরোজের। কিন্তু একজন ছাত্রীর সামনে কি এমন করে বলাটা ঠিক হল ফিরোজের! সুদীপ্তর তাকানোর ভঙ্গি দেখেই ফিরোজ বুঝেছিলেন, তাঁর বন্ধু মনে আঘাত পেয়েছেন। কিন্তু বন্ধু! এখন আঘাত পেলে চলবে কেন? এই তো কিছুক্ষণ আগেই বেশ উপদেশ বিতরণ চলছিল। এখন সেই উপদেশটা নিজেকে দিলেই তো হয়। হামিদা তোমার ছাত্রী হতে পারে, কিন্তু আমার তো শ্যালিকা, এবং তুমিও আমার বন্ধু। অতএব তোমাদের দুজনকে জড়িয়ে কোনো রসিকতার সুযোগ হাতছাড়া করি কেন?
কিন্তু সুদীপ্ত ঐ মুহূর্তেই অতখানি ভাবতে পারেন নি। তিনি তাই একটি গুরুতর কথা বলে ফেললেন—
না না, আমরা ছাত্র-ছাত্রীতে কোনো প্রভেদ মনে রাখি নে। বিশ্বাস কর।
মীনাক্ষী ও ফিরোজ দুজনেই এবার হেসে উঠলেন। এবং কথাটা বলার। পর সুদীপ্তর মনে হল, তাই তো, এতো হাল্কা কথা তিনি তো সচরাচর বলেন না। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, গত দু-তিন দিনের ঘটনায় তাঁর সেই পরিচিত সত্তা ও ব্যক্তিত্বের সবটুকু ওলট-পালট হয়ে গেছে।
সুদীপ্ত কিছুক্ষণ আর বলতে পারলেন না। কিন্তু বোঝা গেল, হামিদা বাকপ্রিয় মেয়ে। কিছু না বলে বসে থাকা তার পক্ষে খুব কঠিন কর্ম। সে তার দুলাভাইয়ের সঙ্গে অনবরত কথা বলে যেতে লাগল। তার অনেকখানিই সুদীপ্ত শুনলেন না। এবং মাঝে মাঝে শুনলেনও। তাতে ছাত্রীটিকে তার প্রিয়ংবদা মনে হল। প্রিয় কথাই হামিদা বলেছে–
আপনারা যে যাই বলুন দুলাভাই, শেখ সাহেবকে কিছুতেই ওরা ধরতে পারে নি।
কিন্তু শেখ সাহেবকে তোরা তো চিনিস নে—ফিরোজ মনে মনে বললেন। মুখে বললেন–
স্বেচ্ছায় তিনি ধরা না দিলে কেউ তাকে ধরতে পারে নি, এবং পারবেও না। তবে কথা হচ্ছে, ধরা না দেওয়ার ইচ্ছাটা তিনি করেছিলেন কি না।
ফিরোজ জানতেন, শেখ সাহেব ধরা দিয়েছেন। কেউ তাকে বাড়ি থেকে বের করতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে এমন কি জোর করে তাকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। তবু এই মুহূর্তে ওই গুজবটার কিছু মূল্য আছে। দেশবাসী জানুক, তাদের প্রিয় নেতা তাদেরকে পথনির্দেশ করার জন্য বাইরেই রয়েছেন।
বাইরে দরজা কড়া নাড়ার শব্দ হল। ফিরোজ গিয়ে খুলে দিলেন।–
কাকে চাই? কোথা থেকে আসছেন?
লোকটি ভেতরে আসতেই সুদীপ্ত তাকে চিনলেন—
আরে হাশমত খাঁ যে, কি খবর?