সেই মহিলাকে ফিরোজ নাকি দেখেছেন কাল। ফিরোজ গিয়েছিলেন। মেডিক্যাল কলেজে। তার দলের এক ভদ্রলোককে পৌঁছে দিতে গিয়েছিলেন। এবং সেই সঙ্গে দেখতে। কিন্তু বেশি কিছু দেখা হয়নি কাল। মেডিক্যাল কলেজ থেকে গিয়েছিলেন গুলিস্তান পর্যন্ত, অতঃপর ঐ পথেই ফিরে এসেছেন। পথের দুপাশে বহু মৃতদেহ তখনও ছিল। এবং সেই সকল মৃতদেহের পাশ মাড়িয়ে চলেছে জীবিতদের মিছিল। কোনমতে কপালের গুণে যারা বেঁচে গেছে সেই সকল জীবিত হতভাগ্যের দল। সেই জীবিতদের মধ্যেই একজন ছিল সেই শিশুটি। বয়স হবে বছর খানেক। তার কাহিনী কাউকে বলা যায়। সুদীপ্তর। কাছে বলতে গিয়ে ফিরোজ তো কেঁদেই ফেলেছিলেন। একটা বড়ো গাছের বিশাল গুড়ি পড়েছিল রাস্তার পাশে সম্ভবতঃ ব্যারিকেড সৃষ্টির জন্যই ওটার আমদানি হয়ে থাকবে। সেই গুড়ির আড়ালে হয়ত লুকিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলেন ভীত-সন্ত্রস্ত অসহায় রমণী। হয়ত ঘরে আগুন জ্বললে পথের বুকে নিরাপত্তা সন্ধান করেছিলেন। বাঁচাতে চেয়েছিলেন বুকের শিশুকে। ফিরোজ দেখলেন, মৃত জননীর স্তন চুষে তখনও বাঁচতে চাইছে সেই অবোধ অলৌকিকভাবে বেঁচে-থাকা শিশু। এ ঘটনা ফিরতি পথের। যাবার পথে দেখেছিলেন সে। মহিলাকে। কোলের একমাত্র শিশুকে বুকে চেপে পাশে একটা সুটকেশ এক হাতে ধরে রিক্সায় যাচ্ছিলেন এক ভদ্রমহিলা। ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেবের বিধবা পুত্রবধূ। চিরকুমার ডঃ দেবের পালিত পুত্রের স্ত্রী। কলি যুগের দেবতা দেখতে চাও? ডঃ দেবকে দেখ। একজন প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে কত উপার্জন ছিল তার? যা ছিল তার এক দশমাংশও বোধ হয় নিজের জন্য তাঁর খরচ হত না। বাকিটা? বাকি টাকা ব্যয় হত দান-ধ্যানে, এবং পালিত পুত্রদের। পেছনে। বহু দরিদ্র সন্তানকে তিনি পালন করেছেন তারা কেবলি যে হিন্দুই এমন নয়, হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদটা কি আর এযুগে মানবার বিষয়? বিনয়দা, সুতপাদি, সুকান্ত কিংবা মন্দিরাকে কখনো কি বিশেষভাবে কোনো ধর্মের লোক বলে সুদীপ্তর মনে হয়েছে? ডঃ দেব বিশেষ কোনো ধর্মের লোক ছিলেন না। বোধ হয়, সব ধর্মেরই লোক ছিলেন তিনি। মনে প্রাণে যিনি দার্শনিক, তিনি বিশেষ একটা ধর্ম বিশ্বাসের দ্বারা আবদ্ধ হবেন—এটা হয় কখনো?
কী হে, ঘুম ভেঙ্গেছে?
ফিরোজের সাড়া পাওয়া গেল। পাশের ঘরে সন্তানাদিসহ মহিলারা ছিলেন এবং এ ঘরে ছিলেন তারা দুই বন্ধু। ইচ্ছে ছিল, অনেক রাত অবধি দুই বন্ধুতে গল্প করবেন। কিন্তু গল্প জমে নি। গল্পের মেজাজ সুদীপ্তরও ছিল না। এবং সারা দিনের ক্লান্তিতে ফিরোজ অতি শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। জাগলেন এখন। এবং জেগে উঠতেই কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল তাঁর। সুদীপ্ত ইতিবাচক সাড়া দিয়ে পরে শুধালেন—
আচ্ছা, কাল তুমি যে ডঃ দেবের পুত্রবধূর কথা বলছিলে তুমি কি তাকে আগে থেকে চিনতে?
না। আমি চিনতাম না। আমার গাড়িতে যে ভদ্রলোক ছিলেন, তিনিই চিনিয়ে দিলেন। তার এক বন্ধুর নাকি বোন। স্বামীর নাম মোহাম্মদ আলি কিংবা ঠিক ঐ ধরনের কিছু একটা হবে। শুনেছিলাম, এখন মনে আসছে না।
অর্থাৎ মুসলমান। ডঃ দেবের মুসলমান পুত্রকে তার সঙ্গে এক সারিতে দাড় করিয়ে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সৈন্যেরা। দুটি লাশ পাশাপাশি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। আর দেখা গেছে মধুবাবুর লাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রিয় মধুদা। সুদীপ্তও ছাত্র জীবনের কথা স্মরণ করলে সেখানে মধুদার একটি উজ্জ্বল স্মৃতিকে বুকের মধ্যে লালিত দেখতে পান। জীবনের কতো আনন্দের, কতো বিষন্নতার, কতো বিতর্কের স্মৃতি ঐ মধুদার ক্যান্টিন! সেই প্রিয় মধুদা। মধুদা, তোমাকে ওরা মারলে! কিন্তু কেন? পঁচিশের রাতে সুদীপ্তর বুকের মধ্যে লুকিয়েও যেন বেলা যথেষ্ট ভয় পাচ্ছিল। তখনি সেই কন্যার কণ্ঠে একটি প্রশ্ন। শুনেছিলেন সুদীপ্ত, মর্মভেদী প্রশ্ন–আব্বা, ওরা আমাদের মারবে কেন? কন্যা কণ্ঠের সেই প্রশ্নই আবার যেন সুদীপ্ত শুনতে পেলেন মধুদার কথা মনে হতেই ওরা মধুদাকে মারবে কেন? হ্যাঁ রে অবোধ কন্যা, উত্তর একটাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ওরা ধ্বংস করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের। যা কিছু প্রিয় সরি ওরা শেষ করে দেবে। অন্ততঃ শেষ করতে চায়। মারতে চায়, ধ্বংস করতে চায়।
কেন করবে না শুনি! স্বাধীন চিন্তার নামে যতো সব ভেঁপোমি। ছেলে পড়াচ্ছ পড়াও। আমরা কি ভাবে শাসন করি, না করি তা নিয়ে তোমাদের। ফাদারের কি? আমরা কোন্ দিক দিয়ে উড়োজাহাজ চালাই, কোন ঘাঁটি থেকে তেল নেই, সে আমরা বুঝব। সাহেবদের বৃটিশ ডেপুটি হাই কমিশনে গিয়ে ধন্না দেওয়া হল-মালদ্বীপ থেকে আমরা বিমানের জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারব না। কী আবদার! বলি, দেশের ভালো মন্দ চিন্তাটা কি তোমাদের? না, আমাদের? কি বললে? দেশের ভাল-মন্দ তোমরাও বুঝতে চাও?
ঐ রোগেই তো মরেছে বাঙালি। বাবা, দেশের ভালো-মন্দ পশ্চিমা জওয়ানদের হাতে ছেড়ে দাও। আর নিজেরা ঘাস-বিচালি খেয়ে ঘুমাও, দেশের উন্নতির জন্য খুব করে চা-পাট উৎপাদন কর, কিংবা দ্রলোক হলে দেশের সংহতি রক্ষার জন্য কাজ করে বা থিসীস লিখে তমঘা নাও। এ সব পছন্দ না হলে? তোমাদেরকে ওরা মারবে। মারাটা তখন হবে জায়েজ।
এই সহজ কথাটি পঁচিশে মার্চ পর্যন্ত অনেকেই জানতেন না।
মধুদা জানতেন না যে, ছাত্রদের প্রিয় হওয়া অপরাধের। শুধুই মধুদা কেন, পৃথিবীর কোন মানুষেরই তা জানার কথা নয়। মধুদার ঋণ আমরা কী করে শোধ করব! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই শুধু মধুদার কাছে ঋণী? আক্ষরিক অর্থে তাই! বহু ছাত্রই তার ক্যান্টিনের ঋণ শোধ করতে পারে নি। কেউ কেউ তার মধ্যে ইচ্ছে করেও বটে। সব ছাত্ৰই কি ভাল থাকে। কিন্তু মধুদা সব ছাত্রকেই ভাল জানতেন। ছাত্রদের তিনি কি দৃষ্টিতে দেখতেন?