কেন? হিন্দু হব কেন?
তা নয়ত কি হইবেন? বাংলা হৈলে তো সব হিন্দু হৈয়া গেল। আর হিন্দু হৈলে দ্যাশও তো হিন্দুস্তান হৈয়া যাইব। আপনারা পাকিস্তানে সব হিন্দুস্তানের চর আইছেন।
ঠিক কইছ হাওলাদার বাই। এই যে ভাষা-আন্দোলন হৈল, এ সব তো এনাদের জন্যই। এনারাই আমাগো ছাওয়ালদের মাথা বিগরাইয়া দিছে।
মাথা বিগড়ে গিয়েছিল সুদীপ্তরও। পর পর তিনবার ইন্টারভিউ দেবার সময় প্রতিবারই নামের জন্য নিন্দা হল তার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা চাকরি তিনি পেলেন। ঢাকা থেকে বহু দূরের একটি মফঃস্বল কলেজে কোনো ইংরেজির অধ্যাপক পাওয়া যায় না। সেখানেই সুদীপ্তর অধ্যাপক জীবনের সূত্রপাত। সেই কবে ১৯৫৩-র কথা সেটা। আজ সুদীপ্ত সুদীর্ঘ আঠারো বছরের অভিজ্ঞ অধ্যাপক। ধাপে ধাপে উন্নতিও অনেক হয়েছে তার। সেই মফঃস্বল। কলেজ থেকে ঢাকা শহরের জগন্নাথ কলেজ। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
একটা যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল সুদীপ্তকে। উপরে উঠার নেশা। আরো উপরে। আরো উপরের নেশা সংক্রামক। ঐ সংক্রামক নেশাটা ক্রমে ক্রমে তখন সারা পাকিস্তানকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সদ্য তখন হিন্দু মধ্যবিত্তের। একটা বিপুল অংশ দেশ ত্যাগ করে চলে গেছেন। মাঠ ফাঁকা। ফাঁকা মাঠে গোল দিতে পারলে কে আর কষ্ট করে খেলা শেখে? এবং কোন খেলা না। শিখেই খেলায় জয়লাভ চাইলে চরিত্র হারাতে হয়। চরিত্রহীনের সম্বল তোষামোদ, আর দালালি। পাকিস্তানে এখন দালালির জয়জয়াকার, প্রচন্ড নির্লজ্জ দালালি—তোষামোদ আর উৎকোচ। সুদীপ্তর এখন প্রবল আফসোস হয়। তিনি কেবলি কবিতা লিখতে শিখেছিলেন। গল্প লিখতে পারলে? তোষামোদ ও দালালির যতো বিচিত্র চেহারা তিনি দেখেছেন তা সব যদি তিনি। গল্পে লিখতে পারতেন। বিশ্ব সাহিত্যে তার দ্বিতীয় মেলা ভার হত। বেশি দূরে যাবার দরকার তাঁর ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কয়েক জন সহকর্মীর জীবনবৃত্ত নিছক ইতিহাসের মতো বলে গেলেও বিস্ময়কর উপন্যাসের কাহিনী হয়ে যাবে। সবি জানেন সুদীপ্ত। কিন্তু উপায় নেই। তিনি গল্প কিংবা উপন্যাস লিখতে পারেন না।
দালালিও পারেন না। তবে একটি কাজ তিনি করেছিলেন। তা করেছিলেন ঐ উন্নতির নেশাতেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে ঢোকার জন্য এফিডেভিট করে নাম পালটিয়েছিলেন। কিন্তু তা কেবল ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের খাতাপত্রের। জন্যেই। অন্য সর্বত্রই তিনি এখনো সুদীপ্ত শাহিনই আছেন। ঐ নামেই এখনো কবিতা লেখেন।
০২. সুদীপ্তকে নাম লুকোতে হয়েছিল
পাক মুল্লুকে তরক্কির জন্য সুদীপ্তকে নাম লুকোতে হয়েছিল। এবং সেই রাতে বাঁচার জন্য লুকোতে হয়েছিল খাটের নীচে। কখনো খুব একজন সাহসী বলে। সুনাম ছিল না সুদীপ্তর। তা হলেও জীবনে কখনো খাটের নিচে শুয়েছেন এমন কোন দ্বিতীয় উদাহরণ সুদীপ্তর জীবনে নেই। ভয়ের রাত কখনো কি তাঁর জীবনে আসে নি? সেই পঞ্চাশের দাঙ্গায়? না। সেদিন তাঁদের পাড়া আক্রান্ত হলে কোন অন্ধকার কোণে লুকোবার কথা মনে হয়নি তো। বরং মনে পড়েছিল বন্ধুদের কথা। সেদিন তাই বন্ধু-গৃহের আশ্রয় প্রত্যাশায় পথে বেরিয়েছিলেন তাঁরা। এবং আশ্রয় পেয়েছিলেন। কিন্তু এবার? এবারও সুদীপ্ত সেই কালো রাতে কোন বন্ধুর মুখ মনে করতে চেষ্টা করেছিলেন। কোন বন্ধুর উজ্জ্বল প্রীতি সেই রাতের ভয়ের মুখ ফ্যাকাশে করে দেবে—এমন একটা আশাকে লালন করতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু কোনো আশা সেই রাতের ত্রিসীমানা ঘেঁসতে সাহস করে নি। কেউ আশা করেনি যে, ছাব্বিশে মার্চের সূর্যোদয় দেখবার জন্য এই রাতটুকু সে বেঁচে থাকবে। তবু অনেকে বেঁচে ছিল। এবং অনেকেই যে বেঁচে আছেন সেটা সুদীপ্তর কাছে পরম বিস্ময় বলে মনে হয়েছিল। অনেকে যারা মরেছিলেন তাঁরা যেন খুব স্বাভাবিক একটি কর্ম করেছেন। অতএব সকলেই তাঁদের সম্পর্কে একটা অদ্ভুত অসাড়তা অনুভব করেছিলেন। কিন্তু জীবিতদের নিয়ে বিস্ময়ের অন্ত ছিল না।
আপনি বেঁচে আছেন!
ভাই আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন। আপনি?
আমাদের বিল্ডিংয়ে পাঁচজন গেছেন। আমি যে কী করে বাঁচলাম আল্লাহ জানে।
সুদীপ্তর এখনো মন হয়, কি করে তিনি যে বেঁচে আছেন তা তিনি জানেন না। আল্লাহ জানেন। তবে হ, যারা মরে গেছেন, তাঁরা ঠিকই গেছেন, ওটা। কোনো সংবাদ নয়।
সংবাদ হয় কোটা? স্বাভাবিক ঘটনাধারার মধ্যে যেটা খাপ খায় না, যা হয় কিছুটা অস্বাভাবিক কিংবা সাধারণের গন্ডিকে যা অতিক্রম করে তাকেই মানুষ গ্রহণ করে একটা সংবাদ বলে। কিন্তু সেই পঁচিশের রাত থেকে মৃত্যুটা কি কোনো সংবাদঃ মৃত্যু এখন তো অতি সাধারণ অতি স্বাভাবিক আটপৌরে একটি ঘটনা মাত্র। অমন যে অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব বা অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মারা গেলেন, নিষ্ঠুরভাবে নিহত হলেন, অন্য সময় হলে তা। খবরের কাগজের কতো বড়ো একটা খবর হত ভাবুন দেখি!
সুদীপ্ত পাশ ফিরে একটু তন্দ্রাচ্ছন্ন হতে চেষ্টা করলেন। চেষ্টা ব্যর্থ হল। একে একে কয়েকটি মুখ এসে দাঁড়াল সুদীপ্তর সামনে—তাঁর শিক্ষক এবং পরে সহকর্মী অধ্যাপক ডঃ জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, তেইশ নম্বর বিল্ডিংয়ে তার নিকটতম প্রতিবেশী ডঃ ফজলুর রহমান, বন্ধু প্রতিম ডঃ মুকতাদির। ডঃ মুক্তাদিরের সংঙ্গে পরিচয় খুব দীর্ঘ দিনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাবে আড্ডা দিতে গিয়ে পরিচয়। ভারি সুন্দর একটি মন ছিল ভদ্রলোকের। এমন মানুষকেও মারে! কিন্তু কাকে মারাটাই বা ঠিক হয়েছে। ঐ ভাবে নৃশংস সৈনিকের হাতে পরম শত্রুর মৃত্যুও তো মানুষ কামনা করে না। ছী-ছি তারা কি মানুষ যারা ডঃ গোবিন্দ চন্দ্র দেবকেও গুলি করে মারে।