গত নির্বাচনে ফিরোজ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছেন। আওয়ামী লীগ এবার বাঙালি শোষণের অবসান দেখাতে চায়। ভালো মানুষ দেখলেই অমানুষদের জিব লক লক করে ওঠে। এবার ওঠাচ্ছি। পাকিস্তানের দু অংশের মধ্যে হাজার মাইলেরও বেশি ব্যবধান—অতএব দু অংশকেই হতে হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কোন অংশকেই অন্য অংশের উপর নির্ভরশীল করা চলবে না।
কিন্তু একটা ভালো মানুষের যুক্তি। এ যুক্তি মানতে হলে তো ভালো মানুষ হতে হবে। কিন্তু ভালো মানুষ কি ইচ্ছে করলেই হওয়া যায়? রক্তের মধ্যে তার বীজ থাকতে হবে না! এই গোড়ার কথাতেই ভুল করেছিল আওয়ামী লীগ। কি আশ্চর্য। শিশুর মতো তোমরা বিশ্বাস করলে আলাপ আলোচনার দ্বার খুলে রাখলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
কচু হবে। এহিয়া তোমাদের কলা দেখাবে।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ সাহেবের আলোচনা চলাকালেই মন্তব্য করেছিলেন। ফিরোজ। বঙ্গবন্ধু শেখ সাহেব একজন খাঁটি বাঙালি। তাই সরল। এবং সরলভাবেই প্রতারিত হচ্ছেন। ফিরোজ মনে করেন। কিন্তু সকলে এ কথা মনে করেন না। তাঁদের মতে—
নিজের বেকুবীর জন্য নিজেই প্রতারিত হবেন ইয়াহিয়া। এবং ধ্বংস করবেন সারা পাকিস্তানকে।
সারা পাকিস্তানের মানুষকে কি পরিমাণ প্রতারণা তিনি দিয়েছেন একদিন ইতিহাস সে কথা বলবে। পঁচিশে মার্চের বিকেল পর্যন্ত কথাবার্তা কোন্ পর্যায়ে ছিল? বাইরের লোক সে কথা জানে না। ইয়াহিয়ার ইচ্ছাতেই সে কথা জানাতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের অন্দর মহলের লোক হয়ে ফিরোজ তো সব জানেন। তার জানা ছিল, ঐদিন সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার পরিবর্তে লেলিয়ে দিলেন সেনাবাহিনী।–ইয়াহিয়ার ভাষণে অবশ্যই আশাপ্রদ কিছু থাকবে না, ফিরোজ জানতেন। এবং জানতেন, কিছুকাল একটা রাজনৈতিক অচলাবস্থার মধ্যে দেশকে হাবুডুবু খেতেই হবে। কিন্তু সেই সময়টা? এবং তারপর? সেই সময় আমাদের কর্তব্য। কি হবে? এবং তারপরেই বা দেশের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
পরের কথা পরে ভাবা যাবে, আপাতত চল ইয়াহিয়া কি বলেন শোনা। যাক। বন্ধুর কথায় রাজী হয়েছিলেন ফিরোজ। এবং সেই সন্ধ্যায় সকলে তাস। নিয়ে বসেছিলেন—সামনে রেডিও। কিন্তু রেডিও বলে না কেন যে, আজ রাতটার সময় প্রেসিডেন্ট দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন! সকলেই যখন প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণের জন্যে উদগ্রীব তখনি এল খবরটা। খবর পাওয়া। গেল–
ইয়াহিয়া সেনাবাহিনীকে শহর দখলের আদেশ দিয়েছেন।–আওয়ামী লীগের একজন স্বেচ্ছাসেবক খবরটা এনেছিল। শুনেই হাতের তাস খসে পড়ল ফিরোজের। এই প্রথম খুব ভালো তাস পেয়েছিলেন। টেক্কা সাহেব-বিবিসহ ডায়মন্ডের সাতখানা, এ ছাড়া বিভিন্ন রঙের আরো দুই টেক্কা এক সাহেব ও তিন বিবি। এমন চমৎকার তাস সচরাচর হয় না। ভারি উক্ত হয়েছিলেন ফিরোজ। কিন্তু পরমুহূর্তেই সব উৎসাহ আনন্দ নিভে গিয়েছিল। সেনাবাহিনীকে শহর দখলের আদেশ দেওয়া হয়েছে?
দখলের আদেশ? কেন? শহর কি তা হলে বেদখলে ছিল এতকাল? শত্রু কবলিত শহরে ইয়াহিয়া তাহলে এলেন কি করে? আর সেখানে একদিন দুদিন নয়, প্রায় দুসপ্তাহ তিনি কাটালেন বহাল তবিয়তে। কি করে সম্ভব হল শুনি?
ঐটাই বাঙালিদের দোষ। চট করে যুক্তির কোটরে ঢুকে প্রশ্ন তুলে ধরতে চায়। কিন্তু ঐ সব প্রশ্নট্রশ্ন চলবে না।
১২. ফিরোজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন
সত্যিই তখন কোনো প্রশ্নের কিংবা চিন্তার অবকাশ খুব ছিল না। ফিরোজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কোথায় যাবেন? রাস্তায় ব্যারিকেড। বড়ো বড়ো গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করা হয়েছে। এরি মধ্যে? এতো শীঘ্র এতো বিরাট গাছটাকে আনল কেমন করে? আর জনগণ জানলই বা কেন করে যে, এখনি এই রাতে এসবের প্রয়োজন। দেশবাসী তবে অনেক এগিত গেছে। বিকেলেও তিনি এই পথ দিয়ে পল্টন ময়দানের জনসভায় গিয়েছিলেন বিকেলেও যথারীতি জনসভা হয়েছে ন্যাপের। মওলানা ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থন জানিয়েছে আওয়ামী লীগকে। বুড়ো বয়সে মাওলানা! সেদিন ঘোষণা করেছেন, শেখ মুজিব তার সন্তানতুল্য। না, পঁচিশ তারিখের জনসভায় নয়। সকলেই তো জানে, পঁচিশ তারিখের জনসভায় মাওলানা। উপস্থিত ছিলেন না। ঢাকাতেই ছিলেন না। অসুস্থ হয়ে সন্তোষ চলে। গিয়েছিলেন। কয়েক দিন আগের অন্য এক জনসভায় বলেছিলেন, শেখ মুজিব আমার সন্তানতুল্য। ঠিক বলেছিলেন। একটা দলের সাথে দ্বিমত যতোই থাক, দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বটে। সেখানে কোনো মতভেদ দিয়ে কথা ওঠে নাকি! এই বৃদ্ধ বয়সেও মাওলানার চিন্তায় কোনো অস্বচ্ছতা নেই। এখন দলের নয়, দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বল। দেশের স্বার্থ নিয়ে লড়াইয়ে নেমেছে আওয়ামী লীগ। তুমি দেশ প্রেমিক হলে ৰবশ্যই তাকে সমর্থন জানাবে। সোজা কথা। বিভিন্ন আওয়ামী পার্টি, ন্যাশনাল লীগ এখন তাই শেখ সাহেবের সঙ্গে। সঙ্গে নেই জামাতে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, পিডিপি আর মুসলিম লীগের বিচিত্র শাখা। এই দলগুলো কি চায়? ঠিক কি যে চায় ফিরোজ বুঝতে পারেন না। ইসলামকে বাঁচানোই নাকি এদের লক্ষ্য। যত সব রাস্কেলের দল। আরে বাবা, ইসলামকে বাঁচানোর জন্য তোরা পাকিস্তান বানিয়েছিলি। কিন্তু ইসলামের অনুসারী অর্ধেক মানুষকেই তো হিন্দুস্থানে ফেলে পালিয়ে এলি তোরা। হ্যাঁ, সেই হিন্দুস্থানে যেখানে তোদের মতে, ইসলাম বিপন্ন। ইসলামের অর্ধাংশকে বিপন্ন করে বাকি অর্ধাংশ বাঁচাতে হবে — এ কোন্ ধরনের পলিটিক্স রে বাবা! আস্ত হাবারামের পলিটিক্স। পলিটিশিয়ানকে খানিকটা দার্শনিকও হতে হয়। না। ভাববাদি দার্শনিকের কথা হচ্ছে না। সমাজ বিজ্ঞান ও ইতিহাস-চেতনার উপর দাঁড়িয়ে অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সে সিদ্ধান্ত সাময়িক ভাবে সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট-বিরোধী হলেও যিনি তাতে পিছিয়ে যাবেন না তিনিই সত্যকার দেশ-নেতা। সাধারণ মানুষের যুক্তি ও বুদ্ধির কাছে তিনি নিজের বক্তব্য পৌঁছে দেবেন, কখনো তাদের সেন্টিমেন্টকে উত্তেজিত করে নিজের নেতাগিরি বজায় রাখবেন না। চিন্তা করে ফিরোজ দেখেছেন, প্রকৃত দেশ–নেতার এই গুণাবলি দেশ ভাগের সময় ছিল অতি অল্প কয়েকজনের মধ্যেই। মুসলিমদের মধ্যে ছিল কেবল মাওলানা আজাদের মধ্যে। কিন্তু জিন্নার অনুগামীদের বক্তব্যটা বর্তমানে কী?