সুদীপ্ত এ যুক্তি অগ্রাহ্য করতে পারেন নি। তিনি ইংরেজির অধ্যাপক হলেও ইংরেজি কবিতা সব সময় বুঝেছেন মনে মনে মাতৃভাষায় অনুবাদ করে। ভাগ্যিস বাংলা তার মাতৃভাষা। তাই অন্য ভাষায় কবিতা তবু কিছুটা বুঝা যায়। কিন্তু তার মাতৃভাষা পাঞ্জাবি হলে? নিশ্চয়ই কোন পাঞ্জাবি কখনো শেলি কীটস কিংবা রবীন্দ্রনাথের কবিতা বোঝে না। তা বুঝলে কি এমন করে মানুষ মেরে বেড়াতে পারে। আমেরিকানরা করেনি মাই-লাই কান্ড? কিংবা, বৃটিশরা জালিয়ানওয়ালাবাগ? না, কথা তা নয়। যাদের মাতৃভাষা দুর্বল তারা তাদের চেয়ে উন্নত ভাষায় কবিতা মোটামুটি বুঝবে না। না, কথা তা নয়। যাদের। মাতৃভাষা দুর্বল তারা তাদের চেয়ে উন্নত ভাষার কবিতা মোটামুটি বুঝবে না। কিন্তু এও ঠিক যে, একটা একটা জাতির সব মানুষই কবিতা রসিক হয় না। তাই উন্নত জাতির মধ্যেও বর্বর থাকে। এবং সেই বর্বরতার বিরুদ্ধে আপত্তি সভ্য জাতি হলে সে নিজেই তোলে। মাই-লাই-এর বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলেছেন একজন আমেরিকানই। ওয়ারেন হেষ্টিংসের অপকীর্তির সমালোচনা বৃটিশরাই করেছিল। পাঞ্জাবিরা হলে করত না। মানে, করতে ইচ্ছে করত না এমন নয়। তা করতে হলে যে মন লাগে সেইটেই তাদের নেই। অনেকেরই মন থাকে না। হা, থাকে শুধু ক্ষুধা ও রিরংসা।
এহেন পাঞ্জাবিদের কবলে বাঙালি জাতি?-জিজ্ঞাসা তীব্র হয়েছিল। ফিরোজের মনে। এবং রাজনীতির ইচ্ছে জেগেছিল। আর্টের চর্চা ভালো। কিন্তু ভালোটাই কি সব সময় সংসারে চলে? অনেক ভেবে এক সময় তিনি চাকরি। ছেড়ে দিয়েছিলেন এবং ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং রাজনীতি। ভদ্রলোক খুব একটা ঝুকি নিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। তবু জিতেছিলেন। সে ইতিহাস অনেক গভীর, এবং কিছুটা অপকীর্তিরও। বেশ কিছু অপকীর্তি শিখেছিলেন ফিরোজ। তা নইলে টাকা হয় না। টাকা না হলে অধমদের সঙ্গে রাজনীতি চলে না? তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন।
বুঝে তো উপায় ছিল না। কি নিয়ে বাঁচবেন! দেশ নিজের না হলে কোনো মতেই বাঁচা যায় না।
দেশটাকে আগে নিজের কর, তারপর হবে শিল্পসাহিত্যের চর্চা।
দেশ নিজের নয়? না। কথটা বন্ধু ঠিক বুঝেননি। ফিরোজ তাঁকে বোঝালেন—
পাঞ্জাবিদের পঞ্চনদের স্বার্থে কাশ্মীর দরকার। অতএব ভারতের সাথে বিবোধ কর। সে বিরোধে পূর্ব বাংলা উচ্ছন্নে যায় যাক। দেশের রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতা বাঙালির হাতে থাকলে এমন অপূর্ব যুক্তিমালার সৃষ্টিই হত না।
তোমার সাথে তর্ক নেই, বন্ধু বললেন—কথা হচ্ছে, সব কাজ সকলে পারে কি না।
সাহিত্যিক সব পারে।
ইচ্ছে করলেই পারে। গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ কত কাজ পেরেছিলেন সে হিসেব রাখ? বন্ধুকে বুঝিয়েছিলেন ফিরোজ। তিনজন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী। সাহিত্যিকের নাম উল্লেখ করে ফিরোজ দেখিয়ে দিয়েছিলেন—যুদ্ধ বা রাজনীতি কোনটাতেই সাহিত্যিকের রুচি ও পারদর্শিতা কারো চেয়ে কম হতে পারে না। তা ছাড়া যদি বল, ঐ সবে নামলে সাহিত্য-শিল্পের চর্চায় বিঘ্ন ঘটবে, আমি সেই অবস্থাটা মেনে নিতে রাজি আছি।
সুকুমার চিত্তবৃত্তির হানি ঘটবে? আমার মতো ক্ষুদে সাহিত্যিকের সুকুমার চিত্তবৃত্তির সমৃলে ধংস হয়ে গেলেও জাতির কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমি যদি দুশমনের উপর একটা গুলি ছুঁড়তে পারি তাতে দেশের অনেক লাভ।
তুমি গুলিও ছুঁড়বে নাকি!
তেমন দিন এলে ছুঁড়তে হবে বৈ কি।
কিন্তু তেমন দিন যতদিন না আসছে ততদিন করবেন কী? রাজনীতি ও ব্যবসা। রাজনীতিতে নামবেন কদিন থেকেই কথাটা নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করছিলেন। এমন সময়ই চিঠিটা এল। কোন প্রচন্ড চিঠি নয়। কিন্তু ফিরোজর ক্ষোভটা প্রচন্ডই হয়েছিল। ব্যাপরাটা ঘটেছিল একখানা বই নিয়ে।
কবি সত্যব্রত সেন ফিরোজর বন্ধু। পঞ্চাশের দশকে কবিতা লিখে। কলকাতায় খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এবং এ কালের প্রথা অনুসারে উঠতি ছোকরাদের কাছে ষাটের দশকে এসে সম্পূর্ণ সেকেলে প্রমাণিত হয়েছেন। তবু ভয়ে ভয়ে দ্বিতীয় কাব্য গ্রন্থ বের করে বন্ধু ফিরোজকে এক কপি উপহার। পাঠিয়েছেন! কলকাতার কবি ঢাকার বন্ধুকে বই পাঠাবে—এটা নিঃসন্দেহে পাকিস্তানকে বানচাল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র। নাকি অন্য কিছু ভেবেছিল পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ। দেড় পৃষ্ঠা ব্যাপি টাইপ করা একখানা চিঠি এসেছিল। পাকিস্তানি কাস্টমস্ বিভাগ থেকে লেখা চিঠিতে ফিরোজের কাছে জানতে চাওয়া হয়ছে–কোন অধিকার বলে মহীউদ্দিন ফিরোজ ভারত রাষ্ট্র থেকে বই আমদানী করেছেন? এ সম্পর্কে তাঁর কোন লাইসেন্স আছে কি না? থাকলে সেই লাইসেন্স তিনি কবে থেকে পেয়েছেন? ইত্যাদি।
বই হাতে পান নি, চিঠি হাতে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। মনে। মনে হাসবেন? নাকি গাল দেবেন? এলাহাবাদ থেকে লাহোরে কেউ উর্দু বই পাঠালে কি এমন চিঠি আসত? নিঃসন্দেহে আসত না। যতো আক্রোশ বাংলা বইয়ের উপর। বিশেষ করে কলকাতার বাংলা বই। কলকাতার বাংলা বইয়ে কি ওলা ওঠার বীজ থাকে? নাকি ওগুলো সব বিছুতির পাতা? আমরা তোমাদের শরীরে ঘষে দেব বলে ভয় করে? সরেফ ওটা হারামীপানা। হারামী রাসকেলরা বাঙালিদের সকলকে খোট্টা বানাতে চায়।মনে মনে সারাদিন গাল দিয়েও গায়ের জ্বালা যেন জুড়োতে চায় না। কিন্তু সব জ্বালাই তবু জুড়োয়। বিছের কামড়ও এক সময় ঠান্ডা হয়ে আসে। ফিরোজও এক সময়। ঠান্ডা হলেন। এবং তখনি চিন্তাটা সচ্ছ হল। রাজনীতি ক্ষেত্রে বাঙালির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত না হলে এই অন্যায়ের অবসান হবে না। সেইদিন থেকেই ফিরোজ সক্রিয় রাজনীতিতে নেমেছেন। নামার চিন্তাটা অবশ্য করেছিলেন কয়েক বছর আগে থেকেই।