ফিরোজের পৈত্রিক নিবাস ঢাকা জেলাতে হলেও বাল্য থেকে যৌবনের উন্মেষ ও তার পরেও কিছুকাল কাটিয়েছেন কলকাতায়। কলকাতার বিরহ তাঁকেও পোহাতে হয়। ঐ একটা বিষয় আছে সেটা পশ্চিম পাকিস্তানিরা বোঝে না! শিক্ষিত বাঙালির একটা বৃহৎ অংশই একদা কলকাতার সঙ্গে গাঁথা পড়েছিলেন—সেই কর্নওয়ালিসের আমল থেকে। বাঙালি কলকাতামুখি হয়েছে। কলকাতার সঙ্গে তার মেল–বন্ধন সুখের কি দুঃখের সে হিসেব মেলাতে বসা। আজ হয়ত অনর্থক নাও হতে পারে, তবে সে ইচ্ছেটা সব সময় মানুষের থাকে না। ফিরোজের একবারও ইচ্ছে করে না হায়াত খান লেনের সেই বাড়িটার মধ্যে দুঃখের খন্ড-মুহূর্তগুলিকে গেঁথে সাজাতে। কলকাতার সৌখিন আলো-হাওয়া সে বাড়িটাকে পছন্দ করে নি। তারা সারাক্ষণ সে বাড়ির দুয়োর-জানলা এড়িয়ে চলত। কিন্তু ফিরোজের মনের জগৎ একটা আছে না। যেখানেও আলো-হাওয়া বিস্তর। তার মনের সেই আলো-হাওয়ারা আজো সেই হায়াত খান লেনের বাড়িটাকে ঘিরে চির অভিসারিকা। কলকাতাকে কি ভোলা। যায়? এখনো কোন তারা ভরা রাতের নির্জন ছাদে চিত হয়ে শুয়ে অতীত সম্ভোগের মধুর মুহূর্তে মনে পড়ে— কলকাতা ঝরে এক ফোঁটা মধু অসীমের শতদলে। কথাগুলোকে সুর দিয়ে গাইতে ইচ্ছে করে। এবং গান পারেন না। বলে আফসোস হয়। সেই কলকাতা।
ভাষা আন্দোলনের পরের বছর ছোট ভাইকে কলকাতা পড়তে পাঠানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাঁর এক মুসলিম লীগের আত্মীয় তখন তাতে আপত্তি তুলেছিলেন এই বলে–
কলকাতায় যা পড়বে তা এই ঢাকাতেও সে পড়তে পারে। যে ডিগ্রী। কলকাতা দেবে তা এখন ঢাকাতেও পাওয়া যায়। অকারণে তবে কলকাতা-মুখি হও কেন?
এই জন্য যে, ঢাকায় লেখা-পড়া করে একটা ডিগ্রীই শুধু পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু শিক্ষিত হওয়া যায় না। এখানে ডিগ্রীধারী অশিক্ষিত লোকে দেশ ছেয়ে যাচ্ছে দেখছ না? দেশের মধ্যে কেবল শিক্ষিত হচ্ছে সেই কটি লোক। যারা বিদেশ যেতে পারছে।
মতটা একান্তই ফিরোজের। এবং কিছুকাল আগে পর্যন্তও ফিরোজের মধ্যে। এ বিশ্বাসের কোনো ব্যত্যয় লক্ষ্য করা যায় নি। তবু সাম্প্রতিক কালে ঢাকা শহরের গায়ে কিছু কিছু আন্তর্জাতিকতার ছাপ পড়তে শুরু করলে তার সেই। বিশ্বাসও একটু একটু করে ফিকে হয়ে আসছে। তা হলেও এখনো তার মনে কলকাতার স্মৃতি কেমন একটা সুখানুভূতির উজ্জীবন ঘটায়!
বাঙালির এই অনুভূতিটাকে ওরা চেনে না। চট করে ভুল বোঝে। ফজলুল হককেও ভুল বুঝেছিল ওরা। পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষে ওটাই স্বাভাবিক। ফিরোজ ভাবেন! অন্যের মনকে বুঝতে গেলে নিজেরও একটা মন লাগে না? ধর, যাদের মন নেই সেই পশুদের কথা। পশুদের শ্রেষ্ঠ সম্বলই হচ্ছে নখর। আর প্রবৃত্তি দুটি-ক্ষুধা ও রিরংসা। কথাগুলি ইদানিং গভীর করে চেপে ধরেছে। ফিরোজকে। দেশের দুই অংশ—পূর্ব ও পশ্চিম। মধ্যে হাজার হাজার মাইলের। ব্যবধানটা কি কেবলি ভৌগোলিক? পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে আমাদের নৈকট্য কেবলি ভৌগোলিক তো নয়। তবু পশ্চিম বাংলা বিদেশ। এবং চোখে দেখা। সত্য। মনের সত্য হতে গেলে যে উপাদান লাগে তার উপস্থিতি কই ঠাহর করা তো যায় না। চিন্তাটা দীর্ঘদিন ফিরোজের হৃদয় মথিত করেছে। পরে এক সময় তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে বাস্তব কর্তব্যবোধে। অন্যায় অবিচারকে পিটিয়ে দূর করার কর্তব্যে নামতে হয়েছে অগত্যা।
ফিরোজ সেইদিন ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সঙ্গত কারণেই। মানুষ কি শালা রাষ্ট্র নামক যন্ত্রটার কাঁচামাল? মনে মনে মুখ খিস্তি করে কাকে গাল দিয়েছিলেন তিনি জানেন না। তবে খুবই বিষণ ও অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছিলেন। রাষ্ট্রের ভূমিকা হবে বিশ্বস্ত ভৃত্যের, কিছুটা বন্ধুরও। কিন্তু প্রভুর ভূমিকা কিছুতেই নয়। এমন কি সে প্রভু খুব ভালো হলেও না।
কিন্তু একটি ব্যতিক্রম আছে। ফিরোজের এক বন্ধু রসিকতাচ্ছলে তর্ক তুলেছিলেন, আয়ুব খান নিজেকে প্রভু নয়, বন্ধুবলে জাহির করেছিলেন। অতএব তোমার…
বন্ধুকে বক্তব্য শেষ করতে না দিয়ে ফিরোজ বলে উঠেছিলেন—
এইটে হচ্ছে চোরের লক্ষণ। ঠাকুর ঘরে কে? কলা খাইনি। তোমাদের আয়ুবের অবস্থা হয়েছিল তাই।
সেইদিন এমনি রাজনৈতিক বিতর্কে অনেকক্ষণ অতিবাহিত করেছিলেন ফিরোজ। সেই প্রথম, কিন্তু শেষ নয়। বরং তিনি তারপর থেকে আরো বেশি করে রাজনীতি সচেতন হয়েছেন। চিরদিন এমনটা অবশ্যই ছিলেন না। কবিতা গান আর বাংলার আকাশ ও প্রকৃতি—এই ছিল তাঁর বাঁচার অবলম্বন। ধানমন্ডির ছোট বাড়িটা পৈতৃক। এবং ঐ বাড়িটাই। সরকারী চাকরি থেকে অবসর নিয়ে ঐ বাড়িটাই তার আব্বা করতে পেরেছিলেন ছেলে-মেয়েদের জন্য। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এবং ফিরোজের একমাত্র ভাইটি পাকিস্তান সরকারের বিদেশী দূতাবাসে চাকরি নিয়ে বর্তমানে নাইজেরিয়াতে অবস্থান করেন। অতএব এই পৈতৃক বাড়িটা বর্তমানে একা ফিরোজের দখলে। মা তো আগেই গেছেন, আব্বা গেছেন বছর দুই হল। বন্ধ্যা স্ত্রী এবং সরকারী প্রচার দপ্তরে একটি ছোট চাকরি নিয়ে বেশ ছিলেন এতোকাল। সুখের সংসার।
সুখের সংসার বৈ কি! আর কি চাই জীবনে। হা, আরো চাই। বই চাই। ভালো কবিতার বই। বিদেশী কবিতার বইয়ে মোল আনা সুখ হয় না। কবিতার স্বাদ মাতৃভাষাতেই সম্ভব —একান্তভাবে ফিরোজের কথা এটি। হয়তো আরো অনেকের কথা। কিন্তু ফিরোজ বলেন—
বিদেশের কবিতা মাত্রই আমাকে অনুবাদে বুঝতে হয়। কিন্তু কবিতার অনুবাদ হয় না।