প্রবল বিস্ময়ে ও ভয়ে আক্রান্ত হয়েছিল মেয়েটি। গতকাল কারফিউ ওঠার এই জেহাদ সম্পর্কে যতোই তথ্য সে অবগত হয়েছে ততই কেমন যেন হে মেয়েটি। এ্যারে বুঝি জেহাদ কয়? ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া, এলোপাথাড়ি গুলি করে মানুষ মারা, মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া— এই সবই জেহাদ বুঝি? এই জেহাদ আবার করে নাকি। একটা গ্রাম্য ক্রোধ তাকে গ্রাস করেছিল। সে কিছুক্ষণ আগেই মৌলভিকে শুধিয়েছিল–
অরে অ মিনসে, জেহাদ মানুষ কিসের লগে করে?
এছলামকে বাঁচানোর লগে জেহাদ করতে হয়। বেশি চেঁচাবি না যা।
মেয়ে মানুষ হলেও তার ঝাল মাখানো কথা সোবহান মৌলভির সহ্য হয় না। মেয়ে মানুষ বাপু দু-একটু রসের কথা বলবি। তা না, কাল থেকে খালি ফ্যাচর ফ্যাচর। ছাওয়াল হারিয়েছিস তো হয়েছে কি! আমার কথায় যখন রাজি হয়েছিস তখন ছাওয়াল তাড়াতাড়িই পাইবি। সে জন্য বেশি ভাবতে হবে না তোকে।
কিন্তু মেয়েটি তবু ভাবছিল। তার ভাবনারা অনন্ত শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট একটি বিপুল মহীরুহ হয়ে উঠেছিল। আমার ছাওয়ালটাও এমনি করেই জেহাদ করেছে নাকি!…… এমনি করে আগুন দিয়েছে ঘরে ঘরে। এমনি করে মানুষ মেরেছে। মেয়ে ধরেছে। এ্যা! ঐ কামে ছওয়াব হয় নাকি! আর ঐ সব কাম করলে তবেই এছলাম বাঁচে বুঝি! কি জানি! মুরুক্ষু মেয়ে মানুষ আমরা! কিন্তু—একটা কিন্তু কিছুতেই মেয়েটির মন থেকে যেতে চায় না।
সোবহান মৌলভি মেয়েটিকে গম্ভীর হয়ে যেতে দেখে ভাবে, ছেলের শোকটা আবার নতুন করে জেগেছে বোধ হয়। তাই সে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিল।–
করিমন বিবি, তুমি ছাওয়ালের লগে আর দুখু কইরো না। তা হলে ছওয়াব পাইবা। জেহাদের কামে… বাকিটুকু আর সে বলতে দেয় নি মৌলভীকে। পাশেই ঝাটা পড়েছিল। সেটা হাতে তুলে—তোর জেহাদের গুষ্টি নিপাত করি ……বলতে বলতেই খেংরাপেটা শুরু করলে দৌড় দিয়ে পালাতে হয়েছিল সোবহান মৌলভিকে। কিন্তু তারপর এক সময় ভাবতে হয়েছিল মেয়েটিকে এমনটা না করলেই ভাল হত। হয়ত মৌলভির কথাই ঠিক। ভাবছিল সে। ঠিক এমনি সময় নাজিম তার স্যারকে নিয়ে যাচ্ছিল ঐ গলি দিয়ে। মেয়েটি গড় গড় করে তার কাহিনী বলে গেল। সংক্ষেপে। এবং ততটুকু, যতটুকু একজন বাইরের লোককে বলা যায়। রাতের সেই ঘটনাটা বললনা। সেই রাতে যখন দুনিয়া ফানা হওয়ার যোগাড় তখনি মৌলভী সাব। সেই কামটা করল। না, সে বাধা বড় একটা দেয় নি। সাদী করবে বলে কথা দিয়েছে যখন তখন আর বাধা দিয়ে লাভ কি? সোবহান মৌলভি তাকে বুঝিয়েছিল—
এ কামে ছওয়াব আছে তা জানিস। এক একবারের কামে এক একটা কাফের কতলের ছওয়াব হয়।
মৌলভির সঙ্গে সম্পর্কের এই অংশটুকু মেয়েটা গোপন করল। কিন্তু। খেংরাপেটার কথাটা লুকালনা। শুনে সুদীপ্ত কান্নাহাসির মাঝখানে একটা ভারি অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেলেন। নাজিম হাসি চেপে বলল–
চলুন স্যার আমরা পালাই।
একটু দাঁড়াও—বলে পকেট থেকে তিনি পাঁচটি টাকা বের করলেন। মেয়েটির হাতে দিয়ে একটি উপদেশ দিলেন শুধু —
মা আপনি পারলে অন্য কোথাও চলে যান। নাজিম চালাও।
মেয়েটিকে আর কিছু বলার সুযোগ দিতে চান না তিনি। কেননা এখন তিনি। তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছতে চান।
১১. শিল্পী আমনের বৃত্তান্ত
শিল্পী আমনের বৃত্তান্ত সকলকে শোনালেন সুদীপ্ত। কিন্তু আশ্চর্য, কেউই তো। আমনের জন্য দুঃখিত খুব বলে মনে হল না। বরং সকলেই শিউরে উঠলেন সুদীপ্তর জন্য। সুদীপ্তর সম্ভাব্য পরিণতি ভেবেই উদ্বেগ প্রকাশ করলেন সকলে।
উহ্ খুব একটা বাঁচা বেঁচেছ। আল্লাহ বাঁচিয়ে দিয়েছে।
ভাগ্যিস, তিনি তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন। নইলে কী যে। হত! আল্লাহ!
সকলের কথাই সুদীপ্ত শুনলেন। কিন্তু ভাবলেন আমনের কথা। অনেকক্ষণ করো সঙ্গে কথা না বলে আমনের কথা ভেবে সময় কাটালেন সুদীপ্তর বন্ধু ফিরোজ একবার চেয়ার টেনে পাশে বসলেন। কিন্তু অনেকক্ষণ বসে এবং কয়েকটি কথা বলেও সুদীপ্তর মনের সাড়া পেলেন না। অবশ্যই ফিরোজের কথার উত্তরে সুদীপ্ত মূক ছিলেন না। কথার উত্তরে কথা দিয়ে গিয়েছিলেন ঠিকই। কিন্তু সেইটেই কি সব?
তুমি যে কখন বেরিয়ে গেলে, একটু অপেক্ষা করলে ফিরে এসে আমিও তোমার সঙ্গে যেতাম।
না, ভেবে দেখলাম, বাজার থেকে তোমার ফিরতে কত দেরি হয়, তাই
সুদীপ্ত বাক্য অসমাপ্ত রাখলেন। কিছুক্ষণ নীরবতা পোহানোর, পর একটা প্রসঙ্গ তুললেন ফিরোজ–
স্বাধীন বাংলা বেতারের কথা শুনেছ?
কৈ, না তো।
সুদীপ্তর কী হয়েছে আজ! হাঁ, অনেক কিছুই হয়েছে। তবু স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ শুনে বলার কথা কি শুধু ঐটুকু? আর কোনো কৌতূহল প্রকাশ পাবে না। এতেখানি ফিরোজ আশা করেন নি। সুদীপ্ত তার বন্ধু। সে তো আজকের কথা নয়। কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্সে এক সঙ্গে পড়েছেন তারা এক সঙ্গে তখন কবিতা লিখে মাসিক সওগাতে ছাপাতেন। সেই কবিতা লেখার সূত্রেই তাদের দুজনের বন্ধুত্ব গাঢ় হয়েছে। কিন্তু আজ আর ফিরোজ কবিতা। লেখেন না। কবিতা ছেড়ে এখন ব্যবসা ধরেছেন এবং রাজনীতি। সুদীপ্তর ধারণা ফিরোজ কবিতা ভালই লেখে, এবং নিয়মিত লেখা উচিত। কিন্তু ফিরোজের ধারণা, চল্লিশ বছর অবধি কবিতা লিখেও যখন কবি-খ্যাতি বিশেষ হয় নি, তখন আর তা হবার সম্ভাবনাও নেই। মেনে নেওয়া ভালো, কবিতার। দেশ বাংলায় যতোখানি ক্ষমতা থাকলে একজনের কবিতা লেখা উচিত ততখানি ক্ষমতা আমার নেই। অতএব কবিতা লেখার চেষ্টা করে অকারণ সময় ও কাগজের অপব্যয় করে কী লাভ? কোনো লাভ নেই, তবে কবিতা পাঠের লোভটা এখনো পুরো মাত্রায় আছে। ফিরোজ নিয়মিত কবিতা পড়েন। এবং কখনো বলেন না—কবিতা তোমায় দিলাম আজকে ছুটি।