সহজ নয়? সুফিয়া মরে নি? তোমার হাজার হাজার ভাই বন্ধু সেদিন কেমন করে মরে গেল তুমি দেখ নি? হাঁ, তিনি দেখেছেন। কিন্তু নিজের জীবনে তো এটাও তিনি দেখলেন যে, মরে যাওয়া অত সোজা নয়। মেরে ফেলা তো আরো কঠিন। তুমি কাকে মারবে? বিশ্বাসকে কখনো মারা যায় না। হ্যাঁ তো, সহস্র প্রাণের সেই দীপ্ত পাপড়ি—সেই প্রেম-ভালোবাসা-বিশ্বাস এক চুলও মরেনি।
এবং মরেন নি সুদীপ্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ঐ নামের কোনো অধ্যাপক আছেন নাকি! কখনো ছিলেন না।
হাঁ ছিলেন না। এবং নেই, তাও ঠিক। তবে এ-ও ঠিক যে, সুদীপ্ত শাহিন নামে যে ভদ্রলোক বন্ধু মহলে পরিচিত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অধ্যাপক এবং ইংরেজি বিভাগেই। কিন্তু অন্য নামে। কেননা পাক ওয়াতানে ওই নাম চলে না। সুদীপ্ত শাহিন!—এই নাম নিয়ে বহাল তবিয়তে বিরাজিত থাকবেন পাক ওয়াতানে? এই জন্যেই পাকিস্তান বানানো হয়েছিলো নাকি! ও সব চলবে না।
সুদীপ্ত শাহিন নাম পাকিস্তানে চলবে না। পাকিস্তানে পা দিয়ে কিছু দিনের মধ্যেই সুদীপ্ত কথাটা বুঝেছিলেন। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে ঢাকায় এসেছিলেন সুদীপ্ত। প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীন এবং তাঁর দল মুসলিম লীগ তখন বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাচ্ছিলেন।
একটা পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল বটে উনিশ শশী সাত-চল্লিশের চৌদ্দই আগষ্ট। সেটা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সত্তা, সেটা দেই। রাষ্ট্রের প্রাণ হচ্ছে তার অর্থনীতি, এবং তাঁর চিন্ময় সত্তার অভিব্যক্তি সাংস্কৃতিক বিকাশের মধ্যে। ঐখানেই ছিল গন্ডগোল। হাজার মাইলের ব্যবধানে বিরাজিত দুটো অংশের মধ্যে একটা অর্থনীতি গড়ে উঠলে তাতে একটা অংশের দ্বারা অন্য অংশের শশাষিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই, অর্থনীতির ক্ষেত্রে একাংশের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে অন্য অংশের উপর। মুসলিম লীগ প্রাণপনে সেই অর্থনীতিক। প্রাধান্য দেশের পশ্চিমাংশে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে উঠে-পড়ে লেগেছিল। মুসল মান হিসেবে সেইটেই কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়েছিল তাঁদের কাছে। কেননা মুসলমানের দৃষ্টি সব সময়ে হতে হবে কেবলাহমুখি, আমাদের কেবলাহ পশ্চিমদিকে। অতএব দেশের পশ্চিমাংশ অধিকতর পবিত্র অংশ। সেটা যে কাবাশরীফের নিকটতর এটা তো অস্বীকার করতে পারে না। মুসলিম লীগ বাংলার নাদান মুসলমানদের দৃষ্টি পশ্চিমমুখি করার জন্যে দেশের আর্থনীতিক প্রাণকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন পশ্চিম পাকিস্তানে। আর বাঙলার গঞ্জে, রেল স্টেশনে সর্বত্র তারা একটা করে দিকনির্দেশক খুঁটি পুঁতে দেয়, তার তীরের মতো ছুঁচলো মুখটা থাকে পশ্চিম দিকে—তাতে উর্দু ও বাংলা হরফে লেখা কেবলাহ্। তোমরা কেবলামুখি হও। কেবল অর্থনীতি ক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এতো বিশাল ব্যবধানে অবস্থিত ভৌগোলিক দিক থেকে বিচ্ছিন্ন দুটি দেশের একই সংস্কৃতি কোনো বাতুলেও চিন্তা করবে না। কিন্তু, একই সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী আমরা—এ কথা সত্য না হলে পাকিস্তানের চিন্ময় সত্তার অস্তিত্ব থাকে কোথায়? লোকে শুনলে বলবে কী? অতএব বল, আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তা অভিন্ন। এক ধম, এক ধ্যান, এক প্রাণ, এক ভাষা। এ সব না হলে একটা আধুনিক শক্তিশালী রাষ্ট্র হয় কী করে? অপূর্ব সব কান্ড সুদীপ্ত দেখেছিলেন প্রথম পাকিস্তানে এসে। হাজার মাইলের ব্যবধানে দুটি দেশকে সর্বাংশে এক করে তোলার জন্য একটা দেশের অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনকে মুছে ফেলার চক্রান্ত তখন সবে শুরু করেছে মুসলিম লীগ সরকার, সেই তখনি সুদীপ্ত এসেছেন পাকিস্তান। হয়ে গেল একুশ বছর। সেদিনের সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুরা আজ অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে সুদীপ্তর ছাত্র।
ছাত্র অবস্থায় সুদীপ্তর অসুবিধা খুব একটা হয় নি। হতে পারত। তখনি কথাটা উঠতে পারত-সুদীপ্ত শাহিন নাম মুসলিম সমাজে চলবে না। কিন্তু সে সময় ইংরেজি বিভাগের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল একজন ইংরেজ অধ্যাপিকার উপর। ইংরেজ অধ্যাপিকা পাকিস্তানের রহস্য ঠিক জানতেন না। অতএব সুদীপ্ত ইংরেজি বিভাগের ছাত্র হতে পেরেছিলেন। এবং এম. এ. ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে কিছুকাল একটা ইংরেজি পত্রিকায় চাকরিও করেছিলেন। তার পরেই শুরু হয়েছিল সেই কান্ডটা। পাস করে সুদীপ্ত কলেজে চাকরির চেষ্টা করলে তখনি উঠেছিল কথাটা–
আপনি সুদীপ্ত শাহিন? এমন নাম তো শুনি নি।
না শুনে থাকলে এখন শোন—বলতে ইচ্ছে করেছিল সুদীপ্তর। কিন্তু বলেন। নি। কারণ চাকরিটার দরকার ছিল তাঁর। অতএব ঐ বেয়াড়া প্রশ্নটাকে তিনি হজম করেছিলেন। তবু রেহাই মেলে নি। আবার একটা প্রশ্ন হয়েছিল।
কি জাতের মানুষ? হিন্দু? না ক্রিশ্চান?
আমার দরখাস্তেই সে কথার উল্লেখ আছে।
খুব ছোট করে একটা উত্তর দিয়ে সুদীপ্ত থেমেছিলেন। কিন্তু সে কথায় প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো অনেকখানি–
মনে তো লয় যে, দরখাস্তে আপনি মিছা কথা বানাইছেন। সুদীপ্ত কি কখনো মুসলমানের নাম হয়?
কথা হচ্ছিল ইন্টারভিউয়ের সময়। ইন্টারভিউ বোর্ডের অন্য এক সদস্য দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন—
সুদীপ্ত কথাডার মানে কি?
ততক্ষণে সুদীপ্ত বুঝে ফেলেছেন তার চাকরিটা হচ্ছে না। তিনি বললেন
উত্তমরূপে দীপ্যমান যাহা।
এ তো তবে বাংলা কথা হৈল সাব। আপনি তবে হিন্দু হইবার চান?