সময় এলে এবার দেখবেন স্যার, দেশকে বিহারিশূন্য করে ছাড়ব।
সেটা খুব সহজ। বাংলাদেশে বিহারিদের সংখ্যা কত? সুদীপ্ত সেটা জানেন না। খুব বেশি হলেও সংখ্যাটা শতকরা দশভাগের উর্ধে যাবে না। নব্বইজন ইচ্ছা করলে দশজনকে দশ মিনিটেই সাবাড় করতে পারে। কিন্তু সেটা কি নব্বই জনের পক্ষে গৌরবের কাজ হবে? সুদীপ্ত বললেন—
কাজটা সেই পাঞ্জাবিদের মতো হবে আমরা এখন যাদেরকে প্রবলভাবে ঘৃণা করছি। আমরা চাইছি নির্ভেজাল গণতন্ত্র! তার অন্যতম মূল কথাটি হচ্ছে, বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে কাউকে শাস্তি দেওয়া হবে না। এবং মতামতের স্বাধানতার সঙ্গে তার দায়-দায়িত্বটাও হবে প্রত্যেকের ব্যক্তিগত।
তা ছাড়া, আমি জানি, নাজিম বলল, অনেক বিহারীই এখনো আমাদের আন্দোলনের সাথে যুক্ত আছেন। তাঁরা আমাদেরই ভালো-মন্দের সাথে নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে নিয়েছেন।
সে কথা ওয়াজেদও কিছু কিছু জানে। সেই যে এক বিহারি ভদ্রলোকের দোকান ছিল নিউ মার্কেটে,মাঝে মাঝে দুএকটা জিনিস কিনত, সেই সূত্রে পরিচয়। কাল থেকে দু-তিনবার অন্ততঃ ওয়াজেদের খোঁজ নিয়ে গেছেন। ওয়াজেদ সে জন্য কৃতজ্ঞ বৈকি! কিন্তু সেটা তো ব্যক্তিগত ব্যাপার, জাতিগত প্রশ্ন উঠলে ওই জাতকে আর ক্ষমার কথা উঠতেই পারে না। সে বলল
হাঁ, সেই রকম দু-চারজনকে বাদ দিয়ে বাকিগুলোকে ধরব আমরা।
সেটা বলতে পার।—নাজিম ওয়াজেদকে সমর্থন জানাল।
না, তাও নয়। সুদীপ্ত মাথা নাড়লেন, ব্যাপারটা ঠিক উলটো হওয়া উচিত। যারা যারা এখন দুষ্কর্মে লিপ্ত কেবল তাদেরকেই চিহ্নিত করে রাখ। তখন খুঁজে বের করে শাস্তি দেব। শাস্তিটা কখনোই সমষ্টিগতভাবে কোননা। সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না।
এ কথায় কেউই সন্তুষ্ট হল না। নাজিমও না। ওয়াজেদ তো নয়ই। তবু তাদের স্যার বলছেন। অতএব আর তারা কিছু প্রতিবাদ জানাল না। স্যাররা। ওই রকম বলেই থাকেন। সব শুনলে চলে না।
একটি মেয়ের কথা তাদের শুনতে হলো! সদর রাস্তা ছেড়ে একটি গলি পথে অনেকখানি ঘুরে যাচ্ছিলেন তারা। টিচার্স ট্রেনিং কলেজের মিলিটারি ছাউনি এড়াবার জন্যই এই প্রচেষ্টা। গলিটার বেশ অভ্যন্তরে একটি বাড়ির দরজায় মেয়েটি দাঁড়িয়ে ছিল। পিঠের দিকটায় দরজার চৌকাঠে হেলান দিয়ে। গালে বাঁ হাত ডান হাত পাশে ঝুলছিল, সে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পায়ের কাছে বসে ছিল পোষা কুকুরটা। তাদেরকে দেখে মেয়েটি ডান হাত তুলে থামতে ইশারা জানাল। এবং গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে জানলার কাছে এগিয়ে কোনো ভূমিকা না রেখে সরাসরি শুধাল—
আপনারা ভদ্দরলোক, আমার একটা কথার জবাব কইতে পারেন? বলেই আনমনে গাড়ির জানলার কাচে নখ ঘষতে শুরু করল।ঐ দিকটায় বসেছিলেন সুদীপ্ত। তিনিই অতএব বললেন–
বলুন।
আমি মুরুক্ষু মাইয়া লোক। কিন্তু পাশের বাড়ির মৌলভি সাব আমারে কন কি, তোর ছাওয়ালের লগে দুখ করিস না। জেহাদের ছওয়াব পাইবি। আপনারা কন তো, হেই সব কামেরে কি জেহাদ কয়? আর তাতে ছাওয়াল। মাৱা গোলে কি ছওয়াব হয়?
ছেলে মারা গেলে কি পুণ্য হয়?-এমন অদ্ভুত প্রশ্ন সুদীপ্ত কখনো শোনেন। নি। পুরো বৃত্তান্ত না শুনলে সব বোঝাও যাবে না। তবে এক মৌলভির রেফারেন্স থেকে তার মনে হল কথাটা বোধ হয় উঠেছে সান্তনা দেবার জন্য। হয়ত মেয়েটির ছেলে এই পাকিস্তানি বর্বরদের হামলার শিকারে পরিণত হয়েছে। এবং তা যখন হয়েছেই তখন অগত্য। সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর উপায় কি? প্রতিবেশী হিসাবে মৌলভি সাহেব তাই সান্ত্বনা দান করেছেন। কাজটা ভালোই তো।
কিন্তু হায় আল্লাহ! এ কি শোনাচ্ছে মেয়েটি! এই বিধবা মেয়েটির একমাত্র ছেলে মারা গেছে সে এবার তো নয়। সেই উনিশ শো পঁয়ষট্টিতে। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে! পঁয়ত্রিশ বছরের বিধবাটিকে তখনি যেন আবিষ্কার করেছিল এ পাড়ার সদ্য বিপত্নীক সোবহান মৌলভি। সোবহান ঐ সময় বুঝিয়ে দিয়েছিল–
এ তো যেমন তেমন লড়াই না। এ হল জেহাদ। হিন্দুস্থানের সাথে পাকিস্তানের জেহাদ। সেই জেহাদে মারা গেছে তোর ছাওয়াল। জেহাদে মারা গেলে আল্লাহ তারে বেহেস্তে লন। তোর ছাওয়ালের লগে লগে তোরেও বেহেস্তে লইবেন। আমাদের তখন ভুলিস না যেন।
বলতে বলতে সোবহান মৌলভি মিসি দেওয়া কালো দাঁত বের করে হেসেছিল। কিন্তু পরক্ষণে সংযত দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে গম্ভীর হয়ে উপদেশ দিয়েছিল–
তুই সবুর কইরা থাক। তোর ছওয়াব হইব।
তা সবুর মেয়েটি করেছিল। এই ক বছরে সে বিস্তর নামায-রোজা করেছে। এবং ছেলের জন্য দোয়া করেছে! একটি মহৎ কার্যের জন্য ছেলে জীবন দিয়েছে এমনি একটি ধারণা তার মনে বদ্ধমূল হওয়ার পর সে যথেষ্ট সান্ত্বনা পেয়েছিল। এমনি কি মৌলভি যে তাকে নেকা করতে চেয়েছিল সেই সুখের কামটাতেও আর আপত্তি জানাবে না বলে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিল। এমন সময় এল একাত্তরের পঁচিশে মার্চ। রাত্রে প্রচন্ড গোলাগুলির শব্দে ভয়। পেয়ে তখনি সে ছুটে গিয়েছিল সোবহান মৌলভির কাছে–
ওগো মৌলভি সাব কি হৈল গো! একি ওজ কেয়ামত শুরু হইল গো! ওগো আল্লাহ কী হবে গো।
সোবহান মৌলভি বিবি সাবেরে ঘরে নিয়ে বিস্তর ঝাড়-ফুক করেছিল। সাহস দিয়েছিল
আরে ভয় করিস না। এ রোজ কিয়ামত না। কাফের গো মারন লগে জেহাদ শুরু হইছে।
এ্যা! এ্যারে বুঝি জেহাদ কয়! আমার ছাওয়াল এই জেহাদ করছিল। এই কাম করলে বেহেস্ত পাওন যায়!