বারোটা থেকে কারফিউ শুরু হয়েছে। কোন্ আক্কেলে বাইরে ছিলে? এলে। কি ভাবে?
নাজিম তার স্যারকে গেটের কাছে নামিয়ে দিয়ে চলে গেছে, এঁরা কেউ। তা জানেন না। এবং তাদের জানা আছে, বারোটা থেকে কারফিউ শুরু হয়ে গেছে। নাজিমও প্রথমে তাই জানত। তাই স্যারকে নিয়ে ঢুকেছিল এলিফ্যান্ট রোডের এক বাড়িতে। ঐখানে তার এক বন্ধু থাকে। নিজের বাড়ি অনেক দূর সেই র্যাঙ্কিন স্ট্রীটে। এত অল্প সময়ে সেখানে পৌঁছানো যাবে না। ফিরোজের। বাড়ি পৌঁছতে হলেও টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সামনেটা মাড়িয়ে যেতে হবে। এখানে আবার মিলিটারি ছাউনি পড়েছে। অতএব সুদীপ্ত চিন্তা করে দেখলেন, সবচেয়ে নিরাপদ এখন নাজিমের বন্ধুর বাড়ি। কোন মতে বিশ ঘণ্টা সেখানেই কাটাতে হবে। কিন্তু কথাটা কি সুদীপ্ত ভাবেন নি? আমিনাকে একটা প্রবল দুশ্চিন্তা পোহাতে হবে না? তা হলেও, এর চেয়ে অধিকতর নিরাপদ কোন ব্যবস্থার কথা মাথায় এল না। সামনে ঝা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্র, বন্দরে বিষয়। উপায়ন্তবিহীন নাবিকসুদীপ্তর দশা হল অনেকটা তেমনি।
বন্ধুর বাড়ি পৌঁছতেই রাস্তার অনেকখানি জুড়ে রক্তের ছাপ দেখে চমকে উঠেছিল নাজিম। এবং সুদীপ্ত চমকে উঠেছিলেন যখন নাজিমের বন্ধ ওয়াজেদের কাছে শুনেছিলেন–
ওটা লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের রক্ত। বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে রাস্তায় দাড় করিয়ে মেরেছে।
সেই তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম প্রধান আসামী লেফটেন্যান্ট কমাণ্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন? তাকেও ওরা মেরেছে নাকি? সার্জেন্ট জহুরুল হককে মেরেছিল ক্যান্টনমেন্টের ভিতরেই। মোয়াজ্জেম হোসেনকে মারবার আগেই আয়ুব খান ভয় পেয়ে মামলা উঠিয়ে নিলেন। নাহ, ঐ রকম ভীতু আদমী দিয়ে দেশের শাসন চলে না। পাঞ্জাবি আর্মি অফিসারদের মনে মনে দারুণ একটা ক্ষোভ ছিল। আর্মিতে পাঞ্জাবিদের একটা স্পেশাল খাতির আছে না! আশ্চর্য, ঐ মোয়াজ্জেমটা সে কথা মানতে চায় না। পাঞ্জাবি-পাঠান-বালুচ-বাঙালি সব এক করে দেখতে চায়। আর বলে কি না, আর্মিতে বাঙালিদের পথে আমরা কাঁটা বিছিয়ে রাখি! হাঁ বটে, বাধা না দিলে বিস্তর বাঙালি আর্মিতে ঢুকত, আমাদের একাধিপত্য খর্ব হত! অতএব কিছু কিছু বাধা আরোপ দেশের স্বার্থেই করতে হয় আমাদের। বাঙালি তো সব গাদ্দার। পাকিস্তানে সাচ্চা ঈমানদার নাগরিক যদি কেউ থাকে সে তো। আমরা-পাঞ্জাবিরা। কথাটা সকলেই মানবে। খালি মানতে চায় না বাঙালিরা। অতএব বাঙালিদের হত্যা করা দেশের স্বার্থে ও ইসলামের স্বার্থে হবে খুবই নেকির কাম! কিন্তু ঐ পাঠান আয়ুবটার ভীরুতার জন্য সেবার একটা জবর গাদ্দারকে খতম করার সুযোগ হারাতে হয়েছে। দিলের ভেতর সাংঘাতিক ক্ষোভ ছিল একটা। সেই ক্ষোভের খানিকটা উপশম হয়েছে এবার। হাজার হাজার মানুষের রক্তে পিপাসার নিবত্তি হয়েছে। কিন্তু মফঃস্বল থেকে কি যে সব। খবর আসছে! বাহাত্তর ঘণ্টা পর বিজয় মহোৎসবের সেই কর্মসূচীটা কি বাতিল হয়ে যাবে?
মোয়াজ্জেম হোসেনকে ঘরেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু সেই কর্ণেল ওসমানীকে পাওয়া যায় নি। সেইটেই ভয়ের কথা। বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই. পি. আর. বিদ্রোহ করল, কর্ণেল ওসমানী অদৃশ্য হলেন—দুয়ের মধ্যে কোনো সময় থাকলে রীতিমত ভয়ের কথা বৈ কি। মোয়াজ্জেম হোসেনকে মারার আনন্দ ইতিমধ্যেই তাই ফিকে হয়ে গেছে। খায়েশ ছিল, মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো সান্দেহজনক কিছু বাঙালি সামরিক অফিসারকে সাবাড় করে ভবিষ্যৎটাকে নিরাপদ করে ফেলা হবে। কিন্তু সকলেই মোয়াজ্জেম হোসেনের মতো সহজ লভ্য হন নি। ওদের মতলব পূর্বেই টের পেতে অনেকে কেটে পড়েছেন—
ওয়াজেদ তখন বাড়ি ছেড়ে ঐ মহল্লা থেকে কেটে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল-নাজিম তার স্যারকে নিয়ে পৌঁছল সেখানে। আমরা এলাম, ওরা। বেরুচ্ছে। ব্যাপার কি? কারফিউ না? তখনি জানা গেল–
কারউফিউ যথারীতি চারটে থেকে।
ঠিক জাননা তো?
না জানলে এখন সে স্ত্রী ও ভাই-বোনদের নিয়ে বেরুবে কেন? কিন্তু। যাচ্ছটা কোথায়?
আর ভাই বোলো না। এদের বোঝানো যাচ্ছে না। বলে, পুরোনো ঢাকা। নাকি নিরাপদ। তাই বহু কষ্টে সেখানে একটা ঘর জোগাড় করেছি। বিস্তর কষ্ট হবে। কিন্তু কি আর করব। আপাতত সেখানেই কিছুকাল বনবাসে থাকব।
অনেকে আবার পুরোনো ঢাকা ছেড়ে ধানমন্ডি এলাকায় পারলে চলে আসছে তা জান!
এরি নাম বোধ হয় দিশেহারা অবস্থা! প্রত্যেকে ভাবছে, শহরের ঐ অংশ নিরাপদ। অবশ্য অবস্থাটা কেবল তাদের জন্য যারা শহরে থাকতে চায়। কিন্তু থাকতেনা চাওয়াদের সংখ্যা শতকরা নব্বইয়ের কাছাকাছি। তারা সহসা গান্ধীজীর “গ্রামে ফিরে চল” নীতির ভক্ত হয়ে উঠে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিতে শুরু করেছে। কিংবা গাড়ি থাকলে পালাচ্ছে নরসিংদীর পানে। সাভারের দিকে যাবার উপায় নেই। ওদিকে যেতে পথে মীরপুরের কাছে বিহারিরা গাড়ি থামিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে, আর বাঙালি বেঈমান পেলে ধরে জবাই করছে।
একটি পরিবারের কথা ওয়াজেদ বলল। গতকাল পালাবার সময় মীরপুর ব্রিজের কাছে বিহারিদের কবলে পড়েছিল। সবাই মারা পড়েছে। কেবল দুজন যুবক নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব-সাঁতার দিয়ে কোনো মতে প্রাণরক্ষা করেছে। বাংলাদেশে বসে বহিরাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হাতে বাঙালিকে মার খেতে হল এ অতি নিদারুণ লজ্জা বটে, কিন্তু সময় এলে শশাধ নেবার চিন্তাটাও কাপুরুষতা। ওয়াজেদ বলেছিল—